ভয়ে বারবার বমি-প্রস্রাব, বন্ধ খাওয়া! যুদ্ধে নষ্ট গাজার একটা গোটা প্রজন্ম

Gaza children mental health: শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষার পুরো দায়িত্ব বর্তেছে তাদের বাবা-মায়েদের হাতেই। বর্তমানে তাঁরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মোকাবিলা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এই অবস্থায়, নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে গাজার একটা গোটা প্রজন্ম।

ভয়ে বারবার বমি-প্রস্রাব, বন্ধ খাওয়া! যুদ্ধে নষ্ট গাজার একটা গোটা প্রজন্ম
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাImage Credit source: Twitter
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 17, 2023 | 7:00 AM

গাজা সিটি: গাজায় ইজরায়েলি বিমান হানা চলছেই। একেকটা করে বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে, আর অনেকটা দূরে থেকেও আতঙ্কে থম মেরে যাচ্ছে আট বছরের কিশোরী, প্রিটি আবু-গাজাহ। পাঁচ বছর বয়সী দুই যমজ ভাই ছুটে যাচ্ছে মা এজরার দিকে। আর একেবারে ছোট বোন, তার দুই বছর বয়স। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু বিস্ফোরণের শব্দ পেলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠছে। এজরাদের আসল বাড়ি, মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহ এলাকায়। সেখানে এখন ভারী বোমা বর্ষণ চলছে। হামলার হাত থেকে বাঁচতে, এজরা তাঁর সন্তানদের নিয়ে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছেন। গাজা ভূখণ্ডের মধ্যে হলেও, সেখানে ইজরায়েলি হামলা অনেক কম। কিন্তু, তারপরও আতঙ্ক যাচ্ছে না এজরার ছেলে-মেয়েদের। আসলে, গাজায় ইজরায়েলের হামলায় হামাস গোষ্ঠী নির্মূল হোক না হোক, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্যালেস্টিনীয় একটা গোটা প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য।

এজরা জানিয়েছেন, তাঁর বাচ্চারা ভয়ে কাঁপছে। তাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক এবং ভয়ে তাদের বেশ কয়েকবার করে বমি হচ্ছে। বমির পাশাপাশি, ভয়ে যখন-তখন প্রস্রাব করে ফেলছে তারা। গাজায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা নতুন নয়। তবে, বমি-প্রস্রাব হওয়ার মতো সমস্যা, তাঁর সন্তানদের মধ্যে আগে ছিল না বলেই জানিয়েছেন বছর ত্রিশের এজরা। তাঁর কাছাকাছিই বয়স রাওয়ানের। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর তিন মেয়ে – ৯ বছরের আয়সেল, ৬ বছরের আরিন এবং ৪ বছরের অ্যালিনও যুদ্ধের বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়েছে। সবথেকে খারাপ অবস্থা তাঁর বড় মেয়ে আয়সেলের। যুদ্ধ কি তা বোঝার মতো বয়স হয়েছে তার। গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে ভয়ে তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বেড়ে গিয়েছে হৃদস্পন্দনের গতি। এমনকি, আরিন এবং অ্যালেনের খাওয়ায় অনীহা দেখা দিয়েছে। ঘন ঘন বোমার শব্দে কেঁপে উঠছে তারা।

গাজার জনসংখ্যা ২৩ লক্ষ। এর প্রায় অর্ধেকই শিশু। সাম্প্রতক ইজরায়েলি হামলার আগে থেকেই বছরের পর বছর ধরে অবরোধ ও যুদ্ধের কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগছে তারা। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ জানিয়েছিল, গাজার প্রতি পাঁচ জন শিশুর মধ্যে চারজনই অবষাদ, শোক এবং আতঙ্কে ভুগছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার ৭৯ শতাংশ শিশুই রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়ে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৩ শতাংশে। অর্থাৎ, বছর বছর এই প্রবণতা বাড়ছে। কথা বলা, ভাষার প্রয়োগ, অন্যদের যোগাযোগের মতো ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়ছে গাজার শিশুরা। স্বাভাবিক কাজকর্ম করার ক্ষেত্রেও অক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। শিশুদের খেলার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে যুদ্ধ। যুদ্ধের সময় বাবা-মায়েরা যেভাবে অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনদের ফোন করে খোঁজখবর নেন, তা অনুকরণ করছে তারা।

এই অবস্থায় শিশুদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে, ভিডিয়ো গেমস, ইউটিউব ভিডিয়োর উপরই ভরসা রাখছেন গাজার অভিভাবকরা। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশুদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন, কীভাবে তাদের অভয় দেবেন, আশেপাশে কী ঘটছে তাদের কীভাবে জানাবেন – সেই বিষয়ে ইউটিউব ভিডিয়ো এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন নিবন্ধ নিয়ে চর্চা করছেন বাবা-মায়েরা। শিশুদের বিনোদন দিয়ে ভুলিয়ে রাখতেও সেই ইন্টারনেটই ভরসা।

গত সোমবার থেকে গাজায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। তার মধ্যেই যেটুকু বিদ্যুৎ পাচ্ছেন, বাচ্চাদের জন্য মোবাইল, ল্যাপটপ, আইপ্যআডে চার্জ দিয়ে রাখছেন বাবা-মায়েরা। বিমান হামলার সময় শিশুদের কানে হেডফোন লাগিয়ে গেমস খেলতে কিংবা কার্টুন দেখতেবসিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। এমনি সময়ে, তাদের কার্টুন দেখা বা গেমস খেলার সময় বাঁধা থাকলেও, এখন যুদ্ধের সময় অবস্থাটা বদলে গিয়েছে। মোবাইল-ল্যাপটপে চার্জ না থাকলে, এজরার মতো অভিভাবকরা তাঁদের শিশুদের গল্পের বই পড়েও শোনাচ্ছেন। শিশুরা যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুললেই, অন্য কথায় প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। আর একটু বড় যারা, তাদের বাবা-মায়েরা বলছেন সৃজনশীলতায় ডুব দিতে। গল্প লিখে বা ছবি এঁকে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে।

রাষ্ট্পুঞ্জের মানবিক প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক কার্যালয় ২০২২-এ জানিয়েছিল, প্যালেস্টাইন জুড়ে ৬,৭৮,০০০ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যগত এবং মনোসামাজিক সহায়তার প্রয়োজন। গাজার অর্ধেকেরও বেশি শিশুর এই ধরনের সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, যুদ্ধের মধ্যে এই ধরনের পরিষেবা পাওয়াটা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কিছু মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকারী সংস্থা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিনামূল্যে পরামর্শ দিচ্ছে। ফেসবুক পোস্টে, ফোন কলে এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিনামূল্যে সাহায্য প্রদান করছে। যুদ্ধের ভয়াবহতায় আতঙ্কিত শিশুদের কীভাবে সহায়তা করা যায়, সেই সম্পর্কে টিপস দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় এই শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষার পুরো দায়িত্ব বর্তেছে তাদের বাবা-মায়েদের হাতেই। বর্তমানে তাঁরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মোকাবিলা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এই অবস্থায়, নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে গাজার একটা গোটা প্রজন্ম।