আটক সু কি: মায়ানমারের সেনা হেফাজতে এক ক্লাইম্যাক্সময় জীবন
সেনার হাতে থাকা মায়নমারের নাগরিকদের মধ্যে এখনও জনপ্রিয়তার শিখরে সু কি। বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী, সু কির জীবনেও একাধিক মোড়।
নেপায়িত: ১৯৯১ সালে তাঁর হাতে নোবেল তুলে দিয়ে পুরষ্কার কমিটি বলেছিল, “সাম্প্রতিক কালে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টিকারী একজন।” সেই আং সান সু কিকে (Suu kyi) আটক করেছে মায়ানমারের সেনা। যা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। কিন্তু মায়ানমারের নেত্রীকে নিয়ে এত প্রশ্নচিহ্নের পরেও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। সেনার হাতে থাকা মায়নমারের নাগরিকদের মধ্যে এখনও জনপ্রিয়তার শিখরে সু কি। বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী, সু কির জীবনেও একাধিক মোড়।
সু কির বেড়ে ওঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন রণ দামামা বাজছে, ঠিক তখনই ১৯৪৫ সালে জন্মেছিলেন আং সান সু কি। পরাধীন বার্মায় শুরু হয়েছিল ভবিষ্যতের নেত্রীর জীবন। তবে জন্মানোর ঠিক ২ বছর পর পিতৃহারা হতে হয় তাঁকে। সু কির বাবা অং সান ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তবে স্বাধীন মায়ানমার দেখে যেতে পারেননি তিনি। স্বাধীনতার মাত্র ১ বছর আগে খুন হতে হয় অং সানকে।
ভারত ও ইংল্যান্ডে সু কি: ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে মুক্ত হয় বার্মা। তবে স্বাধীন মায়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। ১৯৬২ সালে মায়ানমার তখন সেনা শাসনে। সু কির অবশ্য শিক্ষাজীবন কেটেছে ভারত ও ইংল্যান্ডে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পড়াশোনা করছেন সু কি। সে সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মাইকেল অরিসের।
মায়ানমারে সু কি: ১৯৮৮ সালে ৪৩ বছর বয়সী সু কি ফেরেন মায়ানমারে। তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশজুড়ে প্লাবন উঠেছে ৮৮৮৮ আপরাইজিংয়ের। সু কিও গা ভাসালেন সেই আন্দোলনে। গণতন্ত্র আন্দোলনে দাঁড়িয়ে সু কি বলেছিলেন, “আমাদের লক্ষ্য মানুষের মধ্যে যে বহুদলীয় গণতন্ত্রের আগ্রহ আছে তা দেখানো।”
দল গড়লেন সু কি: দেশে ফেরার ২ বছর মধ্যে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি গড়লেন সু কি। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেল তাঁর দল। ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেলেন সু কি। তবে তিনি জিতলেও সেনা ক্ষমতা হস্তান্তরে নারাজ সেনাবাহিনী। অগত্যা সু কিকে থাকতে হল গৃহবন্দি হয়ে। এই সময় ১৯৯৫ সালে তিনি শেষবারের মতো দেখেন তাঁর স্বামীকে। ৪ বছর পর ১৯৯৯ সালে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান মাইকেল।
গণতান্ত্রিক মায়ানমার: ২০১০ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল মায়ানমারে। মুক্তি পেলেন গৃহবন্দি সু কি। তবে গৃহবন্দি থাকলেও সু কির আন্তর্জাতিক সুখ্যাতিতে কোনও প্রভাব পড়েনি। সু কি মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর জীবন নিয়ে নাটক তৈরি করলেন ফ্রান্সের ডিরেক্টর লুক বেসন।
সংসদে সু কি: এই সময় আন্তর্জাতিক সাহায্য পেল মায়ানমার। তাঁর সুখ্যাতির জন্য দ্বিপাক্ষিক সাহায্য করতে এগিয়ে এল আমেরিকা। ২০১২ সালে তিনি পুরষ্কৃত হলেন কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডালে। বারাক ওবামা মায়ামমার সফরে এসে তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “গণতন্ত্রের আইকন যিনি শুধু দেশের নয়, বিশ্বের একাধিক মানুষকে উৎসাহিত করেছেন।” এই ২০১২ সালেই সংসদে নির্বাচিত হলেন আং সান সু কি। ২০১৫ সালে ফের বিপুল ভোটে জয়ী হল তাঁর দল। সংবিধানে অনুমতি না থাকলেও সু কি পেয়েছিলেন স্টেট কাউন্সিলরের তকমা।
রোহিঙ্গা তরজা: সু কি ক্ষমতায় থাকাকালীনই রোহিঙ্গা ইস্যুতে একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল মায়ানমারকে। সে সময় সু কিই ছিলেন একমাত্র কোনও ‘হেড অব স্টেট’ যিনি আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারালয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। আর সেখানে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারন করতেও নারাজ হন সু কি। এই সময় মায়ানমারের একাধিক নেতা সু কির সঙ্গ ছাড়েন। সেই সময় তাঁর দীর্ঘ দিনের সঙ্গী রিচার্ডসনও পদত্যাগ করেন। এতকিছুর পরেও ৪৭৬ আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসনে জয়ী হয় ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি।
আরও পড়ুন: ৪ বছরের লিলি খুঁজে পেল ২২ কোটি বছরের অতীত
আটক সু কি: গত সোমবার মায়ানমারে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে দিনই সকালে মিলিটারি বাহিনী সু কিকে আটক করে। একবছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে শাসনব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নেয় সেনা। গত নভেম্বরে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে গত সপ্তাহেই সেনাবাহিনী জানিয়েছিল তাঁরা ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। এরপরই সোমবার সকালে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রাসি দলের মুখপাত্র মিও নিউন্ট জানান, ভোরবেলায় সু কি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটক করেছে সেনাবাহিনী।