Margo soap: ১০০ বছর আগে খগেনচন্দ্র দাসের হাতে ‘মার্গো সাবান’ তৈরির গল্প শুনলে শিহরিত হবেন

Margo soap: শুষ্ক ত্বকে জেল্লা আনতেই হোক কি , ত্বকের চুলকানি বা জ্বালা দূর করা, ছত্রাক-ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে ব্যবহার করত মার্গো নিম সাবান। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, ভারতের এই সুপরিচিত সাবান নিয়ে গবেষণা, তার বিকাশ এবং বাজারজাত করার পিছনে ছিল এক একজন বাঙালি উদ্যোগপতির হাত। তিনি খগেন্দ্রচন্দ্র দাস।

Margo soap: ১০০ বছর আগে খগেনচন্দ্র দাসের হাতে ‘মার্গো সাবান’ তৈরির গল্প শুনলে শিহরিত হবেন
১০০ বছর আগে ব্রিটিশ বিরোধিতায় মার্গো সাবান তৈরি করেছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র দাসImage Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Jan 11, 2024 | 6:54 PM

কলকাতা: এক সময় ছিল যখন ভারতে এফএমসিজি, অর্থাৎ, ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস সেগমেন্টে শীর্ষস্থানে ছিল মার্গো সাবান। এখনকার প্রজন্মের অনেকে হয়তো এই সাবানের নামই শোনেনি। কিন্তু, তার আগে যারা, তারা শুষ্ক ত্বকে জেল্লা আনতেই হোক কি , ত্বকের চুলকানি বা জ্বালা দূর করা, ছত্রাক-ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে ব্যবহার করত মার্গো নিম সাবান। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, ভারতের এই সুপরিচিত সাবান নিয়ে গবেষণা, তার বিকাশ এবং বাজারজাত করার পিছনে ছিল এক একজন বাঙালি উদ্যোগপতির হাত। তিনি খগেন্দ্রচন্দ্র দাস। শুধু মার্গো সাবান নয়, দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ এবং মাড়ির রোগ নিরাময়ের জন্য নিম টুথপেস্ট, দেশিয় ল্যাভেন্ডার পাউডার-পারফিউমের মতো আরও বেশ কয়েকটি দেশিয় পণ্যের জন্ম দিয়েছিলেন এই বাঙালি উদ্যোগপতি। আসলে এই সকল উদ্যোগ তার জন্য ছিল স্বদেশী আন্দোলন।

খগেন্দ্রচন্দ্র দাসকে বলা যায় ইতিহাসের এক বিস্মৃত নায়ক। এই ভারতীয় তথা বাঙালি উদ্যোগপতি স্থাপন করেছিলেন কলকাতা কেমিক্যাল কোম্পানি নামে এক দেশিয় সংস্থা। এই সংস্থা পরবর্তী সময়ে ভারতের সবথেকে সুপরিচিত স্বদেশী ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। মার্গো, নিম টুথপেস্ট, ল্যাভেন্ডার পারফিউমের মতো অনেক পণ্যের জন্য জনপ্রিয় ছিল তাঁর এই সংস্থা। খগেন্দ্রচন্দ্র দাস বা কেসি দাস জন্মেছিলেন বাংলার এক ধনী পরিবারে। তিনি ছিলেন রায়বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত বিচারক, তারকচন্দ্র দাস এবং মোহিনী দেবীর পুত্র। এই মোহিনী দেবী পরবর্তী সময়ে কট্টর গান্ধীবাদী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামে এক মহিলা বাহিনীর সভাপতিও ছিলেন তিনি। তাই, শৈশব থেকেই স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর মায়ের যোগদান প্রত্যক্ষ করেছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র দাস। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করার বিষয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

মার্গো সাবানের পুরোনো বিজ্ঞাপন

পড়াশোনা শেষ করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছলেন তিনি। এই সময়ই ঘটেছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ। সেটা ছিল ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর। ইংরেজদের এই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি ধরে ফেলেছিল ভারতীয়রা। শুধু বাংলা নয়, ভারত জুড়েই এই নিয়ে বিষয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসকদের এই ন্যক্কারজনক পদক্ষেপের প্রতিবাদে, ভারতীয়রা ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করে, শুধুমাত্র দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। শুরু হয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন। আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো এবং ক্রমে আত্মনিরঅভর হয়ে ওঠা। ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের সামিল হয়েছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র দাসও। আন্দোলনের শুরু থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ। সেই কর্তারা তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি যদি কোনও ব্যবস্থা না নেন, তাঁর ছেলেকে শিগগিরই গ্রেফতার করা হবে। এই অবস্থায় ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডনে যেতে চাপ দিয়েছিলেন তারকচন্দ্র দাস। বাবার আদেশ মানতে বাধ্য ছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র। কিন্তু ব্রিটেনে না যাওয়ার বিষয়ে তিনি অনড় ছিলেন। তাই, তিনি নিজস্ব কৌশলে বাবার অবাধ্য হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে তাঁকে বৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই বৃত্তি গ্রহণ করে, এক মার্কিন জাহাজে চড়ে রওনা দেন ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে।

১৯০৭ সালে, খগেন্দ্রচন্দ্র এবং তাঁর সহপাঠী সুরেন্দ্রমোহন বসুকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করেছিল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই সুরেন্দ্রমোহন বসুই পরে ডাকব্যাক ওয়াটারপ্রুফ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯১০-এ দুজনেই স্ট্যানফোর্ড থেকে রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়া প্রথম ভারতীয় তাঁরা দুজনই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে করতেও সক্রিয়ভাবে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র। ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের সদস্য হন তিনি। সংগঠনের নেতা লালা হরদয়াল, সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে যে সকল ভারতীয় ছাত্র পড়াশোনা করতেন, তাদের জন্য সভা-সেমিনারের আয়োজন করতেন। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে তারা যাতে সংবেদনশীল হয়, রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কে জড়িত হয়, সেটাই ছিল হরদয়ালের লক্ষ্য। আর এই সব সভা-সমিতিতে নিয়ম করে পা পড়ত খগেন্দ্রচন্দ্র দাসের।

বদলেছে বিজ্ঞাপন, ১০০ বছরের বেশি টিকে রয়েছে খগেন্দ্রচন্দ্রের তৈরি মার্গো সাবান

স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর, খগেন্দ্রচন্দ্র এবং সুরেন্দ্রমোহন দুজনেই ভারতে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ভারতে আসার আগে তাঁরা জাপান গিয়েছিলেন। আর এই জাপান সফরই এই দুই বাঙালি উদ্যোগপতির ভবিষ্যতের উদ্যোগের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল। খগেন্দ্রচন্দ্র শুরু করেন ফার্মাসিউটিক্যালস এবং সুরেন্দ্রমোহন বসু ওয়াটারপ্রুফিং-এর ব্যবসা। ভরতে ফেরার পর, ১৯১৬ সালে আরএন সেন এবং বিএন মৈত্রর সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতা কেমিক্যাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র দাস। ৩৫ পন্ডিতিয়া রোডে ছিল অফিস। আর তিলজলায় ছিল সংস্থার কারখানা। ১৯২০ সালে ডাকব্যাক ব্র্যান্ডের নামে ছাতা এবং রেইনকোট তৈরি করা শুরু করেছিলেন বন্ধু সুরেন্দ্রমোহন। আর ওই একই বছরে, খগেন্দ্রচন্দ্র দাস তাঁর সংস্থার প্রসার ঘটিয়ে প্রসাধন সামগ্রী তৈরি করা শুরু করেছিলেন।

নিম গাছের নির্যাস আহরণের এক নিখুত প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র। আর এর থেকেই তৈরি হয়েছিল দুটি দীর্ঘস্থায়ী ব্র্যান্ড – মার্গো সাবান এবং নিম টুথপেস্ট। দাম রেখেছিলেন একেবারে কম। লক্ষ্য রেখেছিলেন, যাতে সমাজের প্রতিটি স্তরের উপভোক্তাদের সেই পণ্য কেনার সামর্থ্য থাকে। আর একটু স্বচ্ছলদের জন্য তিনি বাজারে এনেছিলেন ল্যাভেন্ডার ডিউ পাউডার-সহ আরও বেশ কয়েকটি পণ্য। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর তৈরি এই সকল স্বদেশী পণ্যের চাহিদা হু-হু করে বাড়ে। দেশের প্রায় সকল বড় শহরেই বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেছিল কলকাতা কেমিক্যাল কোম্পানি। তামিলনাড়ুতে নতুন কারখানাও স্থাপন করা হয়। এরপর, দেশএর বাইরে পাড়ি দেয় এই সংস্থা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই ভারতীয় পণ্যগুলি রফতানি করা হত। সিঙ্গাপুরে একটি বিতরণ চেইনও তৈরি করেছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে প্রয়াণ ঘটে তাঁর। সেই সময় তাঁর সংস্থা দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের সবথেকে সুপরিচিত এবং স্বীকৃত ভোগ্য পণ্য সংস্থার একটি ছিল। এখন, বাজার কিছুটা পড়ে গেলেও, শতবর্ষ পেরিয়ে এখনও যাত্রা জারি রেখেছে মার্গো সাবান।

আমজনতার জন্য মার্গো আর স্বচ্ছলদের জন্য ল্যাভেন্ডার ডিউ এনেছিল ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি

আসলে, খগেন্দ্রচন্দ্র দাস আজীবন বিশ্বাসী ছিলেন স্বদেশী দর্শনে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও তিনি ছিলেন কট্টর ব্রিটিশ বিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান থেকে ফিরে আসার পর তিনি শুধু খাদির পোশাক পরতেন। তবে, এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন চাকরি বিরোধী। কারও গোলামি নয়, নিজে কোনও উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেই মন ছিল তাঁর। আর এই আদর্শকে তিনি অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। তাঁর মৃত্যুর পর, সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ এগিয়ে এসে বলেছিলেন খগেন্দ্রচন্দ্র দাস তাদের সবসময় চাকরি খোঁজার বিষয়ে নিরুৎসাহ করতেন। তার পরিবর্তে তিনি তাঁদের নিজস্ব কোনও উদ্যোগ শুরু করতে উত্সাহিত করতেন। সেটা কোনও অত্যন্ত ছোট উদ্যোগ হলেও অসুবিধা নেই।