‘আই অ্যাম’-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও ছ’বছর কোনও টেলিভিশন চ্যানেল আমার ছবি দেখায়নি: ওনির
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তূলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। বার্লিনে ফিল্ম নিয়ে আরও পড়াশোনা। ফিরে এসে শুধু ছবি আর ছবি। জাতীয়পুরস্কারও পেয়েছেন তাঁর পরিচালিত ছিবি ‘আই অ্যাম’-এর জন্য। সমকাম থেকে ‘ক্লাসলেস’ সমাজ। রাখঢাক না রেখে মুখ খুললেন ওনির।
‘আই অ্যাম’ এবং ‘উই আর’ এবং মাঝের দশ বছর…
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮। সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বর্ণনা করা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। সে দিন আমি ঠিক করেছিলাম এর একটা সেলিব্রেশনের প্রয়োজন। আবার এ-ও ভেবেছিলাম যে আমরা একটা মাইলস্টোন ক্রস করে ফেললাম, বাকিগুলো টপকানো এখনও বাকি আছে। কিন্তু তারপর কোভিড, লকডাউন সব ওলটপালট হয়ে গেল। অন্য দিকে, এ বছরই আমার ছবি ‘আই অ্যাম’ দশে পা দিল। সব মিলে কোথাও একটা কানেকশন খুঁজে পেলাম। দশ বছরের উদযাপন করতে শুরু করলাম ‘উই আর’। আমার ছবি ‘আই অ্যাম’-এর গল্পে নিজের পরিচিতি খোঁজার চেষ্টা ছিল আর ‘উই আর’-এ তুমি পছন্দ করো কিংবা না করো আমরা আমাদের গল্প বলবই! ক্যুয়ের (Queer) জীবন এবং প্রেমের গল্প রয়েছে আমার নতুন ছবিতে। এলজিবিটিকিউ (LGBTQ) সম্প্রদায়ের মানুষজন কিছু করলে একটা ইস্যু তৈরি হয়ে যায়। হেটেরোসেক্সুয়াল (Heterosexual) করলে হয় না। আমি তাই-ই আমাদের গল্পগুলো বলতে চাই। আমি পরোয়া করি না সেক্সুয়ালিট নিয়ে কে কী ভাবল, কে কী বলল। আমি আমাদের গল্প বলার ছবি বানাব, ব্যস।
ছবি বানাতে গিয়ে ভাগাভাগি—হেটেরোসেক্সুয়াল, এলজিবিটিকিউ- ক্যুয়ের। এত সব কিছু কেন? সব শুধু ‘মানুষের’ জন্য ছবি হয়ে উঠছে না কেন?
আমি বাস্তবে বিশ্বাস করি। আমাদের সমাজ ‘ক্লাসলেস’ নয়। যতই মানুষ বোকা বানানোর চেষ্টা করুক না কেন। প্রত্যেকদিন দেশের মানুষকে বিভিন্ন স্তরে-পর্যায়ে-ভাগে বিচার করা হচ্ছে। যতই আমরা বড় গলায় বলি না কেন আমি বর্ণপ্রথায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু সত্যিই কি তা-ই হচ্ছে? সব গাঁজাখুরি! ক্যুয়ের (Queer) কমিউনিটি স্ত্রী-পুরুষের কথা বলে না। তৃতীয় লিঙ্গের কথা বলে, তাঁদের ভাবনার কথা বলে। আজকাল কেন আলাদা করে ক্যুয়ের কমিউনিটির জন্য ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে? কারণ এই বৈষম্য-ভেদাভেদ আজও রয়েছে। নিজেদের কাজ করার জায়গা ক্রমশ কমে আসছে। তাই-ই তো আলাদা করে এমন ছবি বানাতে হবে, আমাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন এটাই যে এমন এক জায়গায় পৌঁছনো যা জন লেনন বলেছেন ‘ইম্যাজিন’ গানে কিংবা রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’তে। এক দিকে, স্ট্রেইট ওয়ার্ল্ড আমাদের দেখছে না আর আমাদের কমিউনিটির অনেকে বলছে “আমরা তো বেশ আছি”। সবার মনে একটা ‘কিন্তু-কিন্তু ভাব’। এটাই তো মুখ খোলার সময়। নিজেদের গল্প নিজেরা বলার সময়।
তার মানে বলছেন ৩৭৭ ধারা বাতিলের পর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি?
স্বাধীনতার পর বলা হয়েছিল আমাদের সমাজ ক্লাসলেট-কাস্টলেস। তা কি হয়েছে? আমাদের বাবা-মায়েরা কি তা মেনে নিয়েছেন? নেননি। আমরা কি ভারতীয় নারীদের সমান অধিকার দিয়েছি? দিচ্ছি? এটা ভুল যে রাতারাতি সব বদলে যাবে এমন তা নয়, আশাও করা উচিৎ নয়। এত বছরের ঘৃণা, মিস-কমিউনিকেশন, মিস-ইন্টারপ্রিটেশন চলছে। এসব মিটতে সময় লাগবে। অনেকেই জানেন না, আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জানতে পেরেছিলাম ‘সমকামী’ বিষয়টি আদপে কী! আমার নিজের পরিচিতির বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কারণ ছবিতে দেখিনি, স্কুলের বইতে পড়িনি, বিজ্ঞাপনে দেখিনি। শিবাজিদা (শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়) যখন গ্রিক সাহিত্য পড়াচ্ছিলেন, তখন সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কে পড়াতে শুরু করেন। তারপর বুঝতে পারি। নিজেকে চিনতে পারি। তা-ই পরিবর্তনের একটা সময় তো লাগবে। এমন নয় যে বদল আসেনি, ঠিক যেমন আমার মা-বাবার লেগেছিল। এখন যেমন তাঁরা আমার সেক্সুয়ালিটির বিষয়ে অবগত এবং আমরা একসঙ্গে থাকি। আবার সমাজে এ-ও দেখেছি এখনও অন্য জাতের মানুষকে বিয়ে করায় খুন হতে হয়েছে… তা-ই সব নিয়েই চলছে।
নিজের ছবির জন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী জোগাড় করাটা চাপের নিশ্চয়ই।
অভিনেতা-অভিনেত্রী খোঁজা চাপের নয়। চাপের এটা যে তাঁদের দেখে টাকা ঢালতে এগিয়ে আসবে যে সব মানুষ, তাঁদের খোঁজা। (হাসি) আসলে অভিনেতা অনেকে রয়েছেন, কিন্তু ওঁরা অভিনয় করলে পয়সা পাব না। আই অ্যাম’-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও ছ’বছর কোনও টেলিভিশন চ্যানেল আমার ছবি দেখায়নি। তখনও স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এখনও করতে হচ্ছে। তবে কোনওকিছুই আমাকে ছবি বানানোর থেকে আটকাতে পারেনি।
এ বছর ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মেলবোর্ন শর্ট ফিল্ম কম্পিটিশনে জুরি আপনি এবং রিচা চাড্ডা। রিচার মতো দাপুটে অভিনেত্রীকে ছবিতে কাস্ট করার কথা ভাবেননি?
আমি যখন ছবি বানাই অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পরে আসে, আগে যা আসে তা হল গল্প। একটা গল্প যা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়, সেটাই প্রাধান্য দেয়। আমার ছবির কাস্টিং একটু অন্য ধরণের হয়।
যেমন ‘উই আর’…
ইয়েস, কাস্টিংটা একটু অরগ্যানিক। কুব্রা সাইত রয়েছে। নিমিশা সাজায়ান রয়েছে। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ এ নিমিশাকে দেখে আমি জাস্ট অবাক হয়ে গিয়েছি। ভালবেসে ফেলেছি। ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা হয়েছে। তা-ই বলছি ওঁকে ভালবাসতেই হবে। নিমিশা খুব সুন্দর একজন মানুষ।