সেলেব সন্তান মুহূর্তে ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়, এ কেমন মানসিকতা?
পছন্দ আপনার হাতে। আপনি কীভাবে আপনার সন্তানের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচয় করিয়ে দেবেন, সে দায়িত্ব কিন্তু আপনারই।
ঘটনা এক: অপেক্ষার অবসান শেষে বিরাট কোহলি অনুষ্কা শর্মার ঘরে সোমবার জন্ম হয়েছে কন্যা–সন্তানের। প্রথম মা–বাবা হওয়ার খুশি তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় (social media) ভাগ করে নিয়েছেন সকলের সঙ্গে। পাশাপাশি অনুরোধ, “আশা করি, এই সময় আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তকে আপনারা গুরুত্ব দেবেন।” অনুষ্কা আগেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, সন্তানকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখতে চান। আজকের পৃথিবীতে ‘সেলেব কিড’–এর বড় হওয়ার ছবি যখন ধাপে–ধাপে সোশ্য়াল মিডিয়ায় ‘পোস্ট’ করা যখন একপ্রকার ‘ট্রেন্ড’–এ পরিণত হয়েছে, তখন বিরুষ্কার এই সিদ্ধান্ত অন্যরকম।
ঘটনা দুই: বয়স কয়েক ঘণ্টা। তোয়ালে মুড়িয়ে সদ্যোজাতকে তুলে দেওয়া হয়েছে বাবার কোলে। অথবা মায়ের পাশে শুয়ে হাত–পা ছুঁড়ছে সে। মুহূর্তে ভাইরাল (viral) হয়ে গেল খুদে। এক্ষেত্রে সে অর্থাৎ ইউভান। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী এবং অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম সন্তান। ইউভানের জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই তার ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল রাজ বা শুভশ্রীর ভেরিফায়েড সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট থেকেই। তারপরই দুই তারকার ফ্যান ক্লাবেও সে সব শেয়ারের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।
View this post on Instagram
শুধু ইউভান নয়। গত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়া যত দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় এনেছে, ততই সেলেব সন্তানদের ভাইরাল হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। বলিউডের অন্যতম উদাহরণ সইফ আলি খান এবং করিনা কপূরের প্রথম সন্তান তৈমুর আলি খান। নবাব পুত্রের নামে যেমন প্রচুর ফেক প্রোফাইল রয়েছে, তেমনই বহু সময় তৈমুরের ফেক ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ামে। করিনার বাবা রণধীর কপূর প্রতি মুহূর্তে খবরে নাতির ছবি দেখতে পছন্দ করেন না বলেই জানিয়েছিলেন। এর জন্য মিডিয়াকে দায়ী করেছিলেন তিনি। আবার করিনা প্রকাশ্য সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, স্বাভাবিক পরিবেশে তৈমুরকে বড় করতে চান। কোথাও গেলে যে ওর দিকে সকলের নজর থাকবে, তা ছোট থেকে জেনে বড় হলে আর ছেলেকে সমস্যায় পড়তে হবে না বলে মা হিসেবে মনে করেন করিনা।
কিন্তু যখন নিজেরাই সন্তানের ছবি শেয়ার করছেন সেলেবরা, তার পিছনে কী মানসিকতা কাজ করে? আর এই বিষয়ে ঠিক কতটা সচেতন থাকতে হবে তাঁদের?
View this post on Instagram
এ বিষয়ে সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ রাজর্ষি রায়চৌধুরি মনে করেন, “বিরাট–অনুষ্কার সিদ্ধান্ত নেটিজেনদের উপর সদর্থক অর্থে একটা মানসিক চাপ তৈরি করল। অর্থাৎ নেট এথিক্সের উপর ভরসা রাখা হল। ধরুন, চোরকে ডেকে বললাম, তোমার উপর আমার অগাধ ভরসা, তুমি চুরি করবে না। চোর তাহলে চুরির আগে দু’বার ভাববে। তেমনই নেট নাগরিকদের বলা আপনারা আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তকে গুরুত্ব দেবেন, এটা আশা করছি। উল্টো দিক থেকে একটা চাপ।”
পায়েল এবং দ্বৈপায়ন বাংলা টেলিভিশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ। দম্পতির একমাত্র ছেলে মেরাখের বয়স এক বছরের কিছু বেশি। ছেলের ছবি রয়েছে দু‘জনের ফেসবুকেই। ছবি শেয়ার করার সিদ্ধান্ত কি সচেতন ভাবে নেওয়া? পায়েল বললেন, “আসলে সকলে তো মেরাখের সঙ্গে সরাসরি ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারেননি, তাঁদের জন্য আমাদের বিশেষ মুহূর্ত শেয়ার করেছি। ও কী খেল, বা স্নান করছে, এমন অপ্রাসঙ্গিক ছবি দিইনি। আর ছবি দেওয়ার আগে আমি আর গোগোল (দ্বৈপায়ন) নিজেদের মধ্যে কথা বলেই দিয়েছি।“ পায়েল জানালেন, সো কলড সেলিব্রিটি বিষয়টা থেকে ছেলেকে দূরে রাখতে চান। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের নিজস্ব জগৎ তৈরি হবে, ছেলে সেটাতেই থাকুক, সেটাই মা হিসেবে পায়েলের চাওয়া।
View this post on Instagram
কিছুদিন আগেই মেয়ের মা হয়েছেন ‘জড়োয়ার ঝুমকো’ ধারাবাহিকের অভিনেত্রী অঙ্কিতা মজুমদার। প্রথমে মেয়ে আরুণ্যার শুধুমাত্র আঙুলের ছবি শেয়ার করেছিলেন। ধীরে ধীরে মেয়েকে সোশ্যাল অডিয়েন্সের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন তিনিও। “আমি সব সময় ব্যালান্স করে চলি। কখনই খুব বেশি ওপেন হতে পারি না। মেয়ের ছবিও কিন্তু সে কারণেই প্রথম দিন থেকে দিইনি। প্রথমে ভেবেছিলাম হাসপাতাল থেকেই বেবির ছবি শেয়ার করব। কিন্তু ডেলিভারির পরে সেই ভাবনা বদলে গিয়েছিল। ফলে এক মাস হওয়ার পর প্রথম ছবি দিয়েছি। আসলে সেলেব সন্তানের ছবি দিয়ে এত ফেক প্রোফাইল তৈরি হয়ে যায় এখন, খুব বিরক্ত লাগে। তবে পুজো বা ওর জন্মদিনের মতো কোনও অনুষ্ঠানে নিশ্চয়ই ছবি শেয়ার করব,” বললেন করলেন অঙ্কিতা।
Happy 4months, my precious! ????
Posted by Ankita Majumder Paul on Thursday, January 7, 2021
এই প্রবণতাকে নিজস্ব পেশার চোখ দিয়ে ব্য়খ্যা করলেন পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষ। তাঁর কথায়, “সব সময় আমাদের খবর হয়ে থাকতে হবে, এই ইনসিকিওরিটিতে ভোগেন অনেকে। ফলে আমাকেও গুরুত্ব পেতে হবে, এটা বাচ্চাটিও ছোট থেকেই ভাবতে থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ফোনও থাকছে। আবার একদল এর বিরোধী। কারণ সেই সেলেব হয়তো ছোটবেলায় সারাক্ষণ লাইমলাইটে থাকতে হত বলেই বাবা–মায়ের সময় আর আলাদা করে পায়নি। তবে একটা বিষয় মনে রাখলে ভাল হয়, ছোটদের নিয়ে সেলফি বা ভিডিও তোলায় কিন্তু আলোর জন্য ওদের চোখের ক্ষতি হয়। অন্তত একটা বয়স পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাভয়েড করে শিশুকে পারিবারিক বৃত্তে রাখা ভাল।“
কখনও অভিনেতা, কখনও বা রিয়ালিটি শোয়ের উপস্থাপক হিসেবে ছোট বয়সেই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন অরিত্র দত্ত বণিক। ছোট বয়সেই তুমুল সাফল্য পান। পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয় চর্চা যেমন চলেছে, তেমনই ক্যামেরার পিছনের কাজকেও ভালবেসেছেন অরিত্র। তিনি সেলেব কিড নন। কিন্তু জনপ্রিয়তায় যে কোনও সেলেব সন্তানকে চ্যালেঞ্জ দিতে পারেন অনায়াসে। এ বিষয়ে তিনি বললেন, “আমি যে সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলাম, তখন তা বোঝার মতো বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটাই আমার হয়নি। আমার কাছে অভিনয় করতে যাওয়াটা মজার ছিল। আমার পরিবারের কেউই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে আমার বাড়ি বা স্কুলের শিক্ষায় আমি বুঝতে শিখেছিলাম, সিনেমা একটা অলটারনেটিভ প্রফেশন। কেউ এটা মনে করায়নি, আমি অভিনয় করছি বলে বিরাট কেউ হয়ে গিয়েছি। আমি ট্রামে, বাসেই যাতায়াত করতাম। স্কুলে গার্জেন কলও হত। এখনও মেট্রোতে যাতায়াত করি। কেউ হয়তো চিনতে পেরে সেলফি তুলতে চান, কিন্তু সেটাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার শিক্ষা আমার নেই।“
আরও পড়ুন, কিছু আনন্দ ব্যক্তিগত, চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন বিরুষ্কা
অরিত্র মনে করেন, মিডিয়াম অব কমিউনিকেশন পাল্টেছে। আইডিয়া অব সিনেমাও বদলেছে। আগে সিনেমা ছিল লার্জার দ্যান লাইফ কনটেক্ট। তাই সিনেমা নিয়ে দর্শকের কৌতূহল থাকত। এখন সেটা নেই। যত দিন যাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের নিজেকে গ্রো করানোর আগ্রহ এত বাড়বে যে, পাবলিক ফিগার বলে আর কিছু থাকবে না। একই ফেসবুকে অমিতাভ বচ্চনেরও প্রোফাইল আছে আবার পাড়ার রতনেরও রয়েছে। হতে পারে অমিতাভের ফলোয়ার বিলিয়নে আর রতনের কয়েক হাজার। কিন্তু দুজনেই একই প্ল্যাটফর্মে রয়েছে বলে পাবলিক ফিগারের ধারণা বদলে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন, সেলেব হোক বা সাধারণ মানুষ প্রিভেসিকে সম্মান জানানো উচিত
অরিত্রর উপলব্ধি, “স্টারডমের ধারণা বদলে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। কোভিড আক্রান্ত পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে মনে হয়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এখনও টাকা আছে বলে ইচ্ছে হলে আমি একটা আইসক্রিম কিনে খেতে পারছি। এখানেই তো আমি স্টার। আমরা যে অর্থনীতিতে বাস করি সেখানে স্টার বা স্টারকিডের এ ছাড়া তো আর কোনও সংজ্ঞা রয়েছে বলে মনে হয় না।”
এবার পছন্দ আপনার হাতে। আপনি কীভাবে আপনার সন্তানের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচয় করিয়ে দেবেন, সে দায়িত্ব কিন্তু আপনারই।