ঘুড়ির মতো স্বাধীনচেতা হতে পারলাম কই! খানিক ভেতো, একটু অলস: রূপঙ্কর বাগচী

ভোকাট্টা মানে কি শুধুই প্রেমের ঘুড়ি কেটে যাওয়া বা নতুন ঘুড়ির সন্ধান? না, রূপঙ্কর বাগচী অন্তত তা মানেন না। মনে করেন, জীবনের যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও সময়ে ভোকাট্টা হতেই পারে।

ঘুড়ির মতো স্বাধীনচেতা হতে পারলাম কই! খানিক ভেতো, একটু অলস: রূপঙ্কর বাগচী
গ্রাফিক- অভীক দেবনাথ।
Follow Us:
| Updated on: Sep 17, 2021 | 5:58 PM

 

‘ভো…কা…ট্টা…’— চেনা কয়নেজ, চেনা শব্দ। প্রতিবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সেই শব্দের ব্যবহার যেন বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ছাদের ধার ঘেঁষে খালি গায়ে দামাল ছেলে লাটাই হাতে খানিক বিপজ্জনক ভাবেই তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে…উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে ক্রমশ, হঠাৎই এক অদ্ভুত নীরবতা…আর তারপরেই গগনভেদী চিৎকার… ‘ভোকাট্টা’।

একদিকে বিশ্বজয় করার এক অপার্থিব আনন্দ … আর অন্যদিকে হতাশায় ঘেরা এক ক্লান্ত মুখ। পরমুহূর্তেই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাটাই তুলে নেয় হেরে যাওয়া হাত… নতুন উদ্যমে সুতোয় পড়ে টান…’কাঞ্চি কর্নাটের যুদ্ধে’ এবার জিৎ হয় কর্নাটেরই…
মনে করিয়ে দেয় গায়ক রূপঙ্কর বাগচীর না পুরনো হওয়া সেই গান…

“ভোকাট্টা তোমার ভালবাসা, ভোকাট্টা জমানো অভিলাষা
ভোকাট্টা সুখি সুখি বাঁচা, ভোকাট্টা বাঁচার কামনায়…”

আজ বিশ্বকর্মা পুজো। গায়কের সেই না পুরনো হওয়া আইকনিক গান আর তার নেপথ্যের না জানা গল্প জেনে নিতেই টিভিনাইন বাংলা যোগাযোগ করেছিল রূপঙ্করের সঙ্গে। বিশ্বকর্মা পুজোয় কেটে যাওয়া ঘুড়ি দেখতে দেখতেই কি ওই গান লিখেছিলেন গায়ক? রূপঙ্করের কথায়, “পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতাম দেখতাম এক এক জনের প্রেম হত আর কেটে যেত। ওদের দেখতাম ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছে। আমার কোথাও গিয়ে মনে হত একটা ঘুড়ি কেটে গেলেও আর একটা ঘুড়ি ওড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ওদের বলতাম সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে তো গিয়েছে তো আবার একটা হবে…”। শুধুই কি বন্ধুদের? নিজের জীবনের প্রেমের ঘুড়ির ভো-কাট্টা, হয়েছে কখনও। গায়ক জানালেন, না। স্কুলে পড়াকালীন একজনকে মনে ধরলেও লাটাই ধরার আগেই সুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল। পাত্তা দেয়নি সে।

পরবর্তীতে স্ত্রী চৈতালির সঙ্গে জীবনের সুতো জুড়েছিল তাঁর। ঘুড়ির সুতোর মতোই মজবুত সেই বন্ধন। “ওর প্রেমে আজও পড়ে রয়েছি…’, অকপট স্বীকারোক্তি রূপঙ্করের।

ভোকাট্টা মানে কি শুধুই প্রেমের ঘুড়ি কেটে যাওয়া বা নতুন ঘুড়ির সন্ধান? না, রূপঙ্কর অন্তত তা মানেন না। মনে করেন, জীবনের যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও সময়ে ভোকাট্টা হতেই পারে। বললেন, “এই যেমন এখন, কোভিড পরিস্থিতিতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কিন্তু তবুও তো মানুষ বাঁচে, আবারও ফিরে দেখার স্বপ্ন দেখে। এই যে ফিরে দেখার গল্পটাই আদপে ভোকাট্টা। অর্থাৎ ভোকাট্টা না হলে নতুন ঘুড়ি উড়বে কী করে? যতই ঘুড়ি কেটে যাক না কেন, ঘুড়ি কিন্তু ওড়ে…”।

এ দিন সকাল জুড়ে বৃষ্টি হয়েছে বেশ। কাগজের ঘুড়ির সংখ্যা নেহাতই কম, এরই মধ্যে দোসর কোভিড, তাই দামাল ছেলের দলের আয়োজনে বেশ ভাঁটা, তবুও বিকেল গড়াতেই গাছে আটকে থাকা ঘুড়ির কঙ্কাল জানিয়ে দিচ্ছে, জীবনঘুড়ি চলছে ঠিকই। খানিক নস্টালজিক রূপঙ্কর। মনে পড়ে যাচ্ছে শ্যামবাজারের বাড়ির কথা। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর কথা। তবে বিপত্তিও ছিল। তাঁর কথায়, “তখন অল্প বয়স। পয়সা টয়সা জমিয়ে মদ্যপানটানও হতো। বন্ধুরা সব বমি-টমি করে ভাসিয়ে যে যার বাড়ি চলে যেত। আর পরিষ্কার করতে হতো এই আমাকে।”

প্রতি প্রজন্মেই কি এই ভোকাট্টার গল্পগুলো এক? রূপঙ্কর যে সময় গানটি লিখেছিলেন, যেভাবে জীবন-প্রেম আর ঘুড়ির সুতোকে মিলিয়েছিলেন একই পংক্তিতে নিউএজ ওই গানের সঙ্গে রিলেট করতে পারবে কি? স্মার্টফোন-যুগে ভার্চুয়াল ঘুড়ির গেমে কি ফিকে হয়ে যায় না সেই ‘ভোকাট্টা আওয়াজ’? গায়কের স্পষ্ট উত্তর, “গানটি এখন আরও সময়োপযোগী। আমাদের সময় চ্যালেঞ্জ কম ছিল। অনেক দেখা কম ছিল, দেখার প্রয়োজনও ছিল না। এখন ওদের ছোটার ইচ্ছে বেড়েছে , তাই হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। উঠে আবার একটা দৌড়ে সামিল হচ্ছে। তাই তাদের কাছে তো আরও বেশি গ্রহণযোগ্য এই গান।”

ঘুড়ি উড়ে যায় এক আকাশ থেকে অন্য আকাশ। হাওয়া তার সঙ্গে থাকে, থাকে সাহস জোগায়। ঘুড়ি ছিঁড়ে যায়, ঘুড়ি কেটে যায়। আবারও সে ওড়ে মাথা উঁচু করে। রূপঙ্কর বাগচীও কি ওই উড়তে থাকা ঘুড়ির মতো? একটু থামলেন। তারপর বললেন, “ঘুড়ি স্বাধীনচেতা। যাকে কাটলে কাটে, না কাটলে সে উড়ে পাগল করে দেবে। অতটা দুঃসাহস আমার নেই…অতটা বৈপ্লবিক নই। একটু ভেতো, একটু অলস, একটু ঘরের কোণে থাকা চাপা স্বভাবের এক মানুষ।” আবারও এক নিস্তব্ধতা। তারপর বললেন, ” বরং আমার স্ত্রী চৈতালী অনেক বেশি দুঃসাহসী, ও ঘুড়ির মতো উড়ে যেতে পারত, আমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েই খানিক বাধা পড়েছে, নয়তো ও আরও অনেক কিছু করে ফেলত পারত বলে আমার ধারনা।”

জমানো অভিলাষা আর বাঁচার কামনা নিয়ে গান বেঁধেছিলেন রূপঙ্কর। ঘুড়ি আর জীবনের গতিপথ কোথাও গিয়ে বাঁধা পড়েছিল এক সুতোয়। গায়ক বিশ্বাস করেন, ভোকাট্টা না হলে এগনো যায় না। সবশেষে যোগ করলেন, “যত ভোকাট্টা হবে ততই আবারও সেই গোড়ায় ফিরতেই হবে।” ভোকাট্টা মন্দ নয় তবে?