কোরিয়ান ড্রামার কিউট নায়কই তাহলে পছন্দ জেন জ়ি কিশোরী-যুবতীর?
সবচেয়ে বয়স্ক জেন জ়ি-এর বয়স ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে ২৭। কেউ বিয়ে করে গুছিয়ে সংসার করছে, আবার কেউ হয়তো ডেটিং অ্যাপে লেফট-রাইট সোয়াইপ করছে। সবচেয়ে কনিষ্ঠ জেন জ়ি-এর বয়স মাত্র ১২ বছর। অর্থাৎ, টিনএজ-এর স্বাদ সে এখনও পায়নি। ২৭ এবং ১২—এদের মধ্যে দু’টো বিষয় কমন। এরা জেন জ়ি-এর সদস্য। আর এদের মোবাইল ছাড়া চলে না।
মেঘা মণ্ডল
২০২০ সালের লকডাউন জেন এক্স (১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে যে সব মানুষের জন্ম) থেকে জেন আলফা (২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করা মানুষ) সবার জীবনে পরিবর্তনের ঢেউ এনেছে। জেন আলফা-র হাতেখড়ি হয়েছে অনলাইনে। জেন এক্স-এর নেশা লেগেছে রিলসের। আর এদের মাঝে রয়েছে জেন ওয়াই (১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যারা জন্মেছে) ও জেন জ়েন (১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যে সব মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে)। জেন ওয়াই ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সঙ্গে নিজেকে খাপ-খাইয়ে নিয়েছে। আর জেন জ়েন অনলাইন ক্লাস, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, সিরিজ় দেখার এবং রিলস বানানোকেই স্বাভাবিক যাপনের অঙ্গ করে নিয়েছে। কোন প্রজন্মের কাছে ঘরবন্দি অবস্থা সবচেয়ে বেশি উপযোগী বা কষ্টকর ছিল, তা বলা কঠিন। কিন্তু জেন জ়ি-এর জীবনে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে এই সময়কালে। হয়তো সদ্য ২৩-এ পা দেওয়া জেন জ়ি বিয়ে করে নিয়েছে সেই সময়। আবার হয়তো কেউ-কেউ একাকিত্ব এড়াতে ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস’, ‘সিচুয়েশনশিপ’-এর মতো সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে ছিল। লকডাউন কেটে গিয়েছে বছর দুয়েক হল। সবচেয়ে বয়স্ক জেন জ়ি-এর বয়স ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে ২৭। কেউ বিয়ে করে গুছিয়ে সংসার করছে, আবার কেউ হয়তো ডেটিং অ্যাপে লেফট-রাইট সোয়াইপ করছে। সবচেয়ে কনিষ্ঠ জেন জ়ি-এর বয়স মাত্র ১২ বছর। অর্থাৎ, টিনএজ-এর স্বাদ সে এখনও পায়নি। ২৭ এবং ১২—এদের মধ্যে দু’টো বিষয় কমন। এরা জেন জ়ি-এর সদস্য। আর এদের মোবাইল ছাড়া চলে না। আর এদের মাঝে যারা রয়েছে, তারাও কিন্তু জেন জ়ি আর তারাও সময় কাটায় মুঠোভর্তি ফোনের স্ক্রিনে। এই স্ক্রিনে প্রতিদিন কত রকমের মিম, মোটিভেশনাল কোটস, রিলস উঠে আসে। উঠে আসে পছন্দের সিনেমা বা সিরিজ়ের কোনও দৃশ্য বা সংলাপ। কিন্তু জেন জ়ি কোন ধরনের সিনেমা বা সিরিজ়ের পোস্টে বেশি লাভ ‘রিঅ্যাক্ট’ করে জানেন? হাই-স্কুল ড্রামা।
২৭ বছর বয়সি জেন জ়ি-এর প্লে-লিস্টে ‘চন্দ্রবিন্দু’ থাকে। তবে, দিনের শেষে তারা ‘খো গয়ে হম কঁহা’ (Kho Gaye Hum Kahan)’ দেখে নিজেদের জীবনের সঙ্গে একাত্মবোধ অনুভব করে। লকডাউনে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে যখন এই ১০-১২ বছর আগে স্কুল পাশ করা জেন জ়ি ‘নেভার আই হ্যাভ এভার’ (Never Have I Ever) দেখছিল, সে-ও ফিরে গিয়েছিল তার কলেজ জীবনে। টিনএজ ও ২০-এর দশকে পা রাখা জেন জ়ি-দেরও ভাল লেগেছিল এই হাই-স্কুল ড্রামা। শুধু তাই নয়, জেন জ়ি-দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় কে-ড্রামা। দেখতে গেলে, গোটা বিশ্ব এখন কোরিয়ান কালচারে আক্রান্ত। কে-পপ মিউজিক, ড্রামা থেকে শুরু করে সে দেশের খাবার, বিউটি ট্রেন্ড নিয়েও চর্চা চলছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সেখানে ভারতও রয়েছে। আর ভারতের জেন জ়ি সবচেয়ে বেশি এই জ্বরে ভুগছে। কে-ড্রামা হোক বা আমেরিকান হাই-স্কুল ড্রামা, বাঙালির জেন জ়ি-দের জীবনে কতটা ভূমিকা রাখে এগুলো?
‘নেভার আই হ্যাভ এভার’-এ দেবী তার স্কুল জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। যেখানে সে তার ‘ভার্জিনিটি লুজ়’ করতে চায়, তার সঙ্গে আবার ‘True Love’-ও পেতে চায় জীবনে। স্কুলের ঠিক কোন ছেলেটির প্রতি তার অনুভূতি রয়েছে, সে নিজেও বুঝতে পারে না। তাই প্যাক্সটন হল-ইয়োসিদা থেকে শুরু করে ইথান, নির্দেশকে ‘ডেট’ করে দেবী। অবশেষে আসল ভালবাসা খুঁজে পায় বেনের মধ্যে। এই যে তিন-চারটে পুরুষকে দেবী ‘ডেট’ করেছিল, এর মাঝে যে সময়কালে এই সিরিজ়ে দেখানো হয়েছে, তা খুব বেশি হলে মাস দুয়েক। অর্থাৎ, দেবী খুব বেশি সময় নেয়নি পুরোনো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে। প্রেমের দিক দিয়ে কিছুটা প্রাসঙ্গিক ‘সেক্স এডুকেশন’, ‘থার্টিন রিজ়নস হোয়াই’-এর মতো একাধিক হাই-স্কুল ড্রামা। এমন সিরিজ়ের আরও উদাহরণ রয়েছে কে-ড্রামাতেও। Crash Landing On You, Nevertheless, Time Called You, Start Up, All of Us Dead, Hometown Cha Cha Cha, My Liberation Note, Celebrity, True beauty-র মতো একাধিক কোরিয়ান ড্রামা জেন জ়ি-এর ‘মাই লিস্ট’-এ থাকে। এই ধরনের ড্রামাগুলো জেন জ়ি-র কাছে খুব প্রাসঙ্গিকও। যেমন জেন জ়ি টেক্সটিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে ইমোজি, স্টিকার ও GIF। কথাও বলে সেই ভাষায়। সেখানে সম্পূর্ণ বাক্য তাতে থাকে না বললেই চলে। তাদের টেক্সটের মধ্যে ঢুকে পড়ে ‘GOAT’, ‘IYKYK’, ‘IDK’, ‘Rizz’, ‘NGL’, ‘FAM’, ‘Ghosting’-এর মতো শব্দ। এমন শব্দের full form হয়তো আপনি জানেন, কিন্তু ‘শর্ট ফর্ম’-এ ব্যবহার করায় ধরতে পারছেন না।
জেন জ়েড যে শুধু টেক্সটিংয়ের ক্ষেত্রে নিত্যনতুন ভাষা ব্যবহারকে অভ্যাসে পরিণত করেছে, এমনটা নয়। প্রেম-ভালবাসার ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। ‘গোস্টিং’, ‘সিচুয়েশনশিপ’, ‘রেড ফ্ল্যাগ’, ‘স্পেস’, ‘ব্রেক’—এর মতো একাধিক শব্দ ব্যবহার করে তারা। পাশাপাশি একটা সম্পর্ক থেকে বেরোতে এবং নতুন সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে একদমই ‘Old School Type’ নয় তারা। এখানেই হাই-স্কুল ড্রামাগুলোর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় জেন জ়ি-এর। কিন্তু সত্যি কি হাই-স্কুল ড্রামাগুলো জেন জ়ি-এর লাইফস্টাইল, প্রেমজীবন ও সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে? এ প্রসঙ্গে TV9 বাংলা ডিজিটালকে অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির সহ-অধ্যাপক সংহিতা স্যানাল বলেন, “আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের মুখে এমন অনেক শব্দ শুনি, যা বেশ নতুন। তারা কোরিয়ান সিরিজ় দেখতে বেশ ভালবাসে। আর কোথাও জেন জ়ি-এর জীবনধারার উপর প্রভাব ফেলছে এই ধরনের সিরিজ় ও সিনেমাগুলো।” সংহিতার সঙ্গে একমত অধ্যাপিকা তথা সাইকোলজিস্ট ও গায়িকা সোমলতা আচার্য চৌধুরী। সোমলতা বলেন, “এই প্রজন্ম ভীষণ পছন্দ করে কে-ড্রামা দেখতে।” সমাজকর্মী তথা গায়িকা পিয়া চক্রবর্তীর মনে হয়, এই ধরনের সিরিজ় জেন জ়ি-এর উপর প্রভাব ফেলে। পিয়া বলেন, “অনেকেই এই ধরনের সিরিজ় ও সিনেমা দেখেন এবং তারা ভাল রিভিউই দেন। আগামিদিনে আমিও হয়তো কে-ড্রামা দেখব।”
তাহলে কি ধরে নিতে হয়, জেন জ়ি-এর জীবনধারা, প্রেমকে ভীষণ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে হাই-স্কুল ও কে-ড্রামা? চাপ দাড়িওয়ালা বয়ফ্রেন্ডের বদলে ক্লিন শেভড বয়ফ্রেন্ড খুঁজে নিচ্ছে জেন জ়ি মেয়েরা? সিনেমা-সিরিজ় বরাবরই সমাজের উপর প্রভাব ফেলেছে। কখনও বেশি, কখনও কম। কিন্তু জেন জ়ি সম্পূর্ণরূপে হাই-স্কুল ড্রামার মতোই জীবনকে সাজাতে চায়, এমনটা নয়। আরজে ‘সদা সিঙ্গল অগ্নি’ বলেন, “এই বিষয়টা সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। সিনেমা আপনাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং করেও কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত। আপনি যদি মনে করেন যে একজন ব্যক্তিকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন, সেটা হাই-স্কুল ড্রামা হলে হবে।” অর্থাৎ, আপনিই ঠিক করবেন যে কোন সিনেমার কোন অংশটি আপনার জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক।
তবে, একেবারেই হাওয়া উড়িয়ে দেওয়া যায় না ‘Never Have I Ever’, ‘Sex Education’ কিংবা সদ্য রিলিজ় হওয়া ‘Kho Gaye Hum Kahan’-এর জনপ্রিয়তা। হয়তো কোথাও গিয়ে এই জেন জ়েড নিজেকে দেখতে পায় এসব সিরিজ়, সিনেমায়। আর কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তারা মনেও করে, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক থেকে যত দ্রুত ‘মুভ অন’ করব, নিজের জন্য ভাল। তাছাড়া যৌনতা নিয়ে যে ট্যাবু সেটা ভেঙে দিয়ে, নিজের যৌন চাহিদা এবং পার্টনারের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়াও জরুরি। যেটা কোনও রাখঢাক ছাড়াই কিংবা ভয়ভীতিকে হার মানিয়ে প্রতিনিয়ত করে চলেছে জেন জ়ি। একটা সম্পর্কে থাকাকালীন একে-অপরের ভাল লাগাকে গুরুত্ব দেওয়া, একে-অপরের জন্য নুডলস রান্না করা, এমনকি ছুটির দিনে একসঙ্গে জামাকাপড় কাচাও জরুরি। তাই সিড ও আইশার সম্পর্কটা ‘Wake Up Sid’-এ এতো শক্তপোক্ত ছিল। এখানেই হয়তো অন্যান্য প্রজন্মের থেকে জেন জ়ি এগিয়ে গিয়েছে। তবে প্রশ্নটা শেষমেশ মৌলিক প্রশ্নটা থেকেই যায়: এই এগিয়ে যাওয়া আসলে অগ্রগতি নাকি স্রেফ একটা গতিময় দৈনন্দিনের যাপন?