ঘটনা ১: বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করবেন বলে বেরিয়েছিলেন মধ্য তিরিশের যুবতী। কেউই কারও পার্টনারকে সেখানে আনছেন না। তিনিও তাই বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাননি। বাড়ি ফিরতেই শুনতে পেলেন, স্টাডি রুম থেকে একটা গোঙানি ভেসে আসছে। দৌড়ে গিয়ে দেখেন ভিতর থেকে বন্ধ ঘর। কী হয়েছে? অনেক সাধ্যসাধনার পর স্টাডির দরজা খুলল বটে… কিন্তু তার পর… বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার আনন্দ ম্লান কয়েক মুহূর্তে। প্রেমিকা হিসেবে তিনি কতটা খারাপ, অসংবেদনশীল… ঠায় শুনতে হয়েছিল যুবতীকে। বয়ফ্রেন্ডকে বাদ দিয়ে আনন্দ-হইহুল্লোড় বন্ধ সে দিন থেকেই।
ঘটনা ২: প্রেমিক রাতে মোটে ঘুমোন না। তাই দু’চোখের পাতা এক করতে পারবেন না প্রেমিকাও। করলেই ঠেলা। আধোঘুমে শুনতে হবে, তিনি পার্টনারের ব্যাপারে আদৌ তোয়াক্কা করেন না। অত্যন্ত অমানবিক, তাঁর সঙ্গে থেকে নিজের জীবন দুর্বিষহ করে ফেলেছেন আদ্যন্ত নিরীহ ও গোবেচারা পুরুষটি। শুধু ঘুম নয়, উঠতে-বসতে নানা ভাবে প্রেমিকাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর যাবতীয় খারাপ থাকার কারণ এই যুবতীই। কখনও-সখনও এর সঙ্গে আবার ভয় দেখানোর চেষ্টা, মহিলামহলে যথেষ্ট কদর আছে তাঁর। চাইলেই অন্য সঙ্গিনী পেতে পারেন। সুতরাং যুবতী যেন নিজেকে শুধরে নেন।
গ্রাফিক্স- অভিজিৎ বিশ্বাস
বছরের পর বছর ধরে প্রেমিকের কথা শুনে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টাও করে গিয়েছিলেন প্রেমিকা। ধরা যাক তাঁর নাম ক্যাথারিন। ভাবছেন গাঁজাখুরি গপ্পো? আজ্ঞে না। নামটি কাল্পনিক হলেও ঘটনাটি মোটেও কল্পনাপ্রসূত নয়। ব্রিটেনের বাসিন্দা ওই যুবতী দীর্ঘ কয়েক বছর প্রেমিকের কথামতো নিজেকে নানা ভাবে শোধরানোর চেষ্টা করে দেখেন, কিছু না কিছু ত্রুটি থেকেই যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসতে না খসতেই শুরু হচ্ছে গঞ্জনা। একটা সময়ে নিজেকে নিয়ে ধন্দ শুরু হয়েছিল ক্যাথারিনের– আমি কি এতটাই খারাপ? প্রেমিকের প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলে সে ভুল ভাঙে। হুবহু এক অভিজ্ঞতা তাঁর, সে কারণেই ভেঙেছিল সম্পর্ক। কিন্তু কেন এমন করেন পুরুষটি?
থেরাপিস্টের কাছ থেকে একটি শব্দ তার আগেই শুনেছিলেন ক্যাথারিন—Gaslighting। গুগল সার্চ করে মানেও বুঝেছিলেন। এ বার দুয়ে-দুয়ে চার। সমস্যা তাঁর নয়, প্রেমিকের। এক ধরনের নিগ্রহ (abuse)-এর শিকার ক্যাথারিন। মনোবিজ্ঞানীরা সেটিরই নাম দিয়েছেন Gaslighting।
নির্যাতনের মাত্রা বুঝবেন কীভাবে?
বিষয়টি ঠিক কী? সহজ ভাষায়, নানা ছলে ও কৌশলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, তাঁর মধ্যে বিভিন্ন খামতি রয়েছে। পদে-পদে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যে, এক সময়ে ওই ব্যক্তি নিজেই নিজের মানসিক অবস্থা নিয়ে সন্দেহে ভুগতে শুরু করেন। ১৯৩৮ সালের একটি বিখ্যাত নাটকের নাম থেকেই Gaslighting শব্দবন্ধটির সূত্রপাত। পরে তা বিশ্ববন্দিত হয় ইনগ্রিড বার্গম্যান অভিনীত বিখ্যাত ছবির সূত্রে। সেটিরও বিষয়বস্তু ছিল এক রকম। সম্প্রতি আবারও এই Gaslighting-এর প্রত্য়ক্ষ উল্লেখ মিলেছে নেটফ্লিক্সের ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ ছবিতে (রিভু দাশগুপ্ত পরিচালিত এই ছবি হলিউড ছবি ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’-এর অফিশিয়াল হিন্দি রিমেক)।
যদি মনে করেন, এ ধরনের abuse শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কেই হয়ে থাকে, তা কিন্তু নয়। অফিসের বস থেকে শুরু করে আপনার পাশের টেবিলে বসা আপাত-নিরীহ সহকর্মী, যে কেউ এমন হতে পারেন। কাজ থেকে শুরু করে আচার-ব্যবহার, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন অধস্তনের সমালোচনা করতে-করতে তাঁর মধ্যে self-doubt তৈরি করে দেওয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আপনার-আমার নেহাত অজানা নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তো বটেই, স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যেও এমন প্রবণতা থাকতে পারে। আমরা তাদের bully বলি বটে, কিন্তু কে বলতে পারে এদের মধ্যেই কেউ Gaslighter নয়?
নিজস্ব চিত্র
মনোবিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, কাউকে যেনতেনপ্রকারেণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই এই ধরনের abuse-এর গোড়ার কথা। এর মধ্যে power dynamics-এর জটিল সমীকরণ কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, Gaslighter-দের মধ্যে কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ব্যতিক্রমী রকমের আলাদা মাত্রায় থাকে। Manipulation ও অন্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা শুরু সেখান থেকেই। আপাতভাবে এঁদের অনেকে কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়, চালচলন মুগ্ধ করার মতো। তাতেই আকৃষ্ট হন আশপাশের মানুষজন। এর পরেই শুরু abuse।
নিজস্ব চিত্র
ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক মনোবিদ পৌরবী চৌধুরী এর আরও একটি অভিনব দিকের কথা জানালেন। তাঁর বয়ানে, ‘বহু সময় abuser ও নির্যাতিত, দু’পক্ষের কেউই কিন্তু এই ধরনের abuse সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। তাতে বিষয়টি আরও মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে।’ তাঁর ব্যাখ্যা, কাউকে নিয়ন্ত্রণের এই চেষ্টা বহু ক্ষেত্রেই সমাজস্বীকৃত। আরও সহজ করে বললে, সমাজের মধ্যে থেকেই শিখি আমরা। ফলে সেই শিখন থেকেই abuser মনে করতে পারেন, যে এটি তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে। নির্যাতিতও ভাবতে পারেন, এটি দস্তুর। কাজেই তাঁকে সবটা মেনে চলতে হবে, এ ভাবেই থাকতে হবে। ফল? স্বাদহীন বেঁচে থাকা।
নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: শোয়ার ধরণের ভুলে ক্ষতি হচ্ছে ত্বক! আপনি কেমনভাবে শুয়ে থাকেন?