এশিয়ায় তেজ কম কেন করোনার? জোড়া তত্ত্ব বাঙালি বিজ্ঞানীদের মাইক্রোস্কোপে

বুধবার পর্যন্ত বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০ কোটি ৭৫ লক্ষ। এর ৫৫% আক্রান্তই আমেরিকা আর ইউরোপে। মৃত্যু হয়েছে ২৩.৫ লক্ষের। এরও প্রায় ৫২% আমেরিকা আর ইউরোপে। সেই তুলনায় জনসংখ্যা, জনঘনত্বের বিচারে ভারতে সংক্রমণ, মৃত্যু-- দুই-ই কম।

এশিয়ায় তেজ কম কেন করোনার? জোড়া তত্ত্ব বাঙালি বিজ্ঞানীদের মাইক্রোস্কোপে
ফাইল ছবি
Follow Us:
| Updated on: Feb 10, 2021 | 9:47 PM

কমলেশ চৌধুরী: করোনার (Coronavirus) দাপট বিশ্ব জুড়ে। তবু তেজ কি বেশি ইউরোপ-আমেরিকাতেই? বিশ্বব্যাপী মহামারীর এক বছর পর নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়। শুধু মুখের কথা নয়, হাতে গরম তথ্যও রয়েছে। কিন্তু কোন জাদুতে একটু হলেও ছাড় পাচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা? পর পর দু’টি গবেষণায় উঠে এসেছে দু’টি তত্ত্ব। একটি গবেষণা হয়েছে কল্যাণীতে, অন্যটিতেও গবেষকদলের অন্যতম সদস্য এক বাঙালি।

বুধবার পর্যন্ত বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০ কোটি ৭৫ লক্ষ। এর ৫৫% আক্রান্তই আমেরিকা আর ইউরোপে। মৃত্যু হয়েছে ২৩.৫ লক্ষের। এরও প্রায় ৫২% আমেরিকা আর ইউরোপে। সেই তুলনায় জনসংখ্যা, জনঘনত্বের বিচারে ভারতে সংক্রমণ, মৃত্যু– দুই-ই কম।

কিন্তু কেন কম?

মহামারীর শুরুতে আলোচনায় উঠে এসেছিল বিসিজি টিকার প্রসঙ্গ। এশিয়া, আফ্রিকায় বিসিজি টিকাকরণের সাফল্যই ঠেকিয়ে রাখছে করোনাকে, দাবি তুলেছিলেন একদল বিজ্ঞানী। পরে পোলিও টিকাকরণের কথাও উঠে আসে। একটি গবেষণাপত্রে বাঙালি বিজ্ঞানী তন্ময় মজুমদার দাবি করেন, করোনাভাইরাসের কয়েকটি প্রোটিন ও হিউম্যান পোলিয়ো ভাইরাসের প্রোটিনের মধ্যে অনেকটাই মিল রয়েছে। ফলে পোলিয়ো টিকা দেওয়ায় শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল, তা করোনার বিরুদ্ধেও দ্রুত জমজমাট রক্ষণ তৈরি করে ফেলছে। এ বার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি বিশেষ প্রোটিন, ধনী-গরিব দেশের স্বাস্থ্যবিধির রকমফেরও।

ইনফেকশন, জেনেটিক্স অ্যান্ড ইভোলিউশন পত্রিকায় বিজ্ঞানীদের দাবি, খানিকটা হলেও ফারাক গড়ে দিচ্ছে আলফা-ওয়ান অ্যান্টিট্রিপসিন প্রোটিন। গবেষণাটি করেছেন কল্যাণী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স (এনআইবিজিএম)-এর দুই বিজ্ঞানী নিধান বিশ্বাস ও পার্থ মজুমদার। তাঁদের ব্যাখ্যা, করোনাকে শরীরে ঢুকতে সাহায্য করে স্পাইক প্রোটিন। সিঁদ কাটার সময় মানবশরীরের এসিই-টু রিসেপ্টরের সঙ্গে জোট বাঁধে করোনার এই প্রোটিন। এর পর মানবশরীরেরই প্রোটিয়েজ TMPRSS2-র সাহায্যে স্পাইক প্রোটিনের দেওয়াল চিড়ে কোষে ঢুকে পড়ে ভাইরাল আরএনএ। করোনায় আক্রান্ত হয় শরীর।

নিধান বলেন, ‘গত এপ্রিলেই আমরা দেখেছি, করোনার ডি৬১৪জি সাব-টাইপই সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকায় যা সংক্রমণের হার, এশিয়ার তার চেয়ে অনেক কম। এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমরা দেখি, ডি৬১৪জি সাব-টাইপের ক্ষেত্রে TMPRSS2-র পাশাপাশি নিউট্রোফিল ইলাস্টেজও স্পাইক প্রোটিনের দেওয়াল চিড়তে সাহায্য করছে।’ ঘটনা হল, নিউট্রোফিল ইলাস্টেজ বেশি ক্ষরণ হলে ফুসফুসের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি ঠেকাতে শরীরই আলফা-ওয়ান অ্যান্টিট্রিপসিন প্রোটিন তৈরি করে। নিধান বলেন, ‘আলফা-ওয়ান অ্যান্টিট্রিপসিন প্রোটিন বেশি থাকলে নিউট্রোফিল ইলাস্টেজ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেই সঙ্গে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে করোনার কোষে ঢোকার প্রক্রিয়াও। কিন্তু এই প্রোটিনের ঘাটতি রয়েছে ইউরোপ, আমেরিকায়। তাই সংক্রমণের বাড়াবাড়ি দেখা গিয়েছে সেখানে। এশিয়ায় ঘাটতি তুলনায় কম, তাই বাড়াবাড়িও কম অনেকটা।’

অন্য গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে কারেন্ট সায়েন্স পত্রিকায়। গবেষকদলের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সারির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএসআইআরের ডিরেক্টর জেনারেল শেখর মান্ডে। দলে রয়েছেন পুনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সেল সায়েন্সের বাঙালি বিজ্ঞানী বীথিকা চট্টোপাধ্যায়ও। করোনা যে প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়েছে, সেটাই তুলে ধরেছেন তাঁরা।

যেমন, এতদিনের অভিজ্ঞতা, গরিব দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, নিকাশি ব্যবস্থা যেহেতু খারাপ, স্বাস্থ্যবিধি মানার লোক কম, তাই সংক্রামক রোগের বাড়াবাড়ি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু করোনা দেখাল, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, আমেরিকার মতো ধনী দেশেই সংক্রমণ বেশি, মৃত্যু বেশি। কোনও কোভিড-বিধি না মানা এশীয় দেশেই বরং কাবু করোনা। বিশেষ করে পাকিস্তানের উদাহরণ তুলে ধরছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। আলাদা করে গবেষণাও হচ্ছে। মান্ডেদের দাবি, গরিব দেশের স্বাস্থ্যবিধি না-মানার দীর্ঘ দিনের ধারাই এক্ষেত্রে সুবিধা করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: বন্ধ ঘরে বিধানসভা কর্মীর ঝুলন্ত দেহ, পাশে ঝুলছে স্ত্রী-ছেলে! জোকায় ভয়ানক ঘটনা

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ছোট থেকেই নানা জীবাণুর সঙ্গে লড়াই চলে। তাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। সেটা না-হলেই বরং প্রতিরোধী শক্তি দুর্বল থাকে। বিশেষ করে অটোইমিউন ডিজিজের সম্ভাবনা বাড়ে। যে রোগে বিদ্রোহ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই। আর কোভিডে দেখা গিয়েছে, অটোইমিউন ডিজিজ থাকলে মৃ্ত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ধনী দেশে গড় আয়ু বেশি থাকায় বয়স্কদের সংখ্যা গরিব দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এবং করোনায় বয়স্কদের মৃত্যুহারও বেশি। তারুণ্যের রক্তেও গরিব দেশে করোনা কাবু হয়েছে, তা-ও তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানীরা।

দু’টি গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে রাজ্যের প্রাণী ও মত্‍স্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলেন, ‘আমি এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় যোগ করতে চাই। ইউরোপ বা আমেরিকার চেয়ে এশীয় বা ভারতীয়দের জিনের গঠনগত ফারাক রয়েছে। সেই কারণেই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও আলাদা হয়। এটা আগেই জানা ছিল। করোনা সেটাই আবার আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল। তাই ভবিষ্যতের মহামারী মোকাবিলায় এই ধরনের বিষয়গুলি আরও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেই মনে হয়।’

আরও পড়ুন: রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বড় রদবদল করল স্বাস্থ্য দফতর