সুস্থ হয়ে উঠলেও শরীরে ফের বাসা বাঁধতে পারে করোনা, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

বিশ্বে করোনার পুনঃসংক্রমণের ঘটনা প্রথম হংকংয়ে ২০২০ সালের অগস্ট মাসে জানা যায়। ৩৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি স্পেনে থেকে ফেরার পর অগস্ট মাসে ফের করোনা আক্রান্ত হন।

সুস্থ হয়ে উঠলেও শরীরে ফের বাসা বাঁধতে পারে করোনা, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
ছবি:PTI
Follow Us:
| Updated on: Apr 07, 2021 | 3:33 PM

জ্যোতির্ময় রায়: আগেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, তাই ভবিষ্যতে আপনার আর করোনা হবে না, এই কথা ভেবে থাকলে বড় ভুল করছেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR)-র তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ৪.৫ শতাংশ মামলা করোনাভাইরাসের পুনঃসংক্রমণের খোঁজ মিলছে। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৪.৫ জনই প্রথমবার করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন।

বর্তমানে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখের গণ্ডি পার করায় তা চিকিৎসক, গবেষকদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে করোনার পুনঃসংক্রমণ আরও চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে।

করোনার পুনঃসংক্রমণ কী?

করোনার পুনঃসংক্রমণের অর্থ হল করোনা ভাইরাসে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হওয়া। আইসিএমআরের তরফে জানানো হয়েছে যে, যদি কোনও ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং তার ১০২ দিনের মধ্যেই আবার করানো আক্রান্ত হন, তবে তা পুনঃসংক্রমণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আইসিএমআরের বিজ্ঞানীদের একটি দল দুবার করোনা সংক্রমিত হয়েছেন, এমন ১,৩০০জন রোগীদের উপর গবেষণা করেন। গবেষকরা জানান, এরমধ্যে ৫৮টি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে পুনঃসংক্রমণ বলা যেতে পারে। সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, SARS-CoV-2 পুনঃসংক্রমণ-র জন্য নজরদারি চালানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যেই গবেষণাপত্রটি এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ইনফেকশন জার্নালে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে।

পুনঃসংক্রমণ না হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া কি ইতিবাচক?

জনস্বাস্থ্য ও নীতি বিশেষজ্ঞ ডঃ চন্দ্রকান্ত লাহারিয়া বলেন যে পুনঃসংক্রমণ কী, তা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। করোনার রিপোর্ট পজি়টিভ আসার পর জিনোম সিকোয়েন্সিং না হওয়া অবধি কেউ দাবি করে বলতে পারেন না যে করোনার পুনঃসংক্রমণই হয়েছে।

মুম্বইয়ের জসলোক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের পরামর্শদাতা তথা জেনারেল মেডিসিনের চিকিৎসক রোহান সিকোইয়া জানিয়েছেন, করোনার পুনঃসংক্রমণ ঘটাতে পারে কিনা তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে আলোচনা চলছে। করোনা সংক্রমণের পর সুস্থ হয়ে ওঠার পরে শরীরে তৈরি অ্যান্টিবডিগুলি চিরকাল থাকবে, না তার স্থায়ীত্ব কয়েকদিন, এটি এখনও সুস্পষ্ট নয়। এখনও পর্যন্ত খুব কম ক্ষেত্রেই পুনঃসংক্রমণ রিপোর্ট করা হয়েছে। তিনি জানান, করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও দেহে অল্প পরিমাণে ভাইরাস থেকে যায়। একে বলা হয় পারসিস্টেন্স ভাইরাস শেডিং। এই ভাইরাসগুলি এত কম পরিমাণে থাকে, যে কারণে শরীরে জ্বর বা অন্য কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। এমনকি, এরকম ব্যক্তি অন্যকে সংক্রমিত করতেও পারেন না। তবে পরবর্তী সময়ে করোনা পরীক্ষা করা হলে, রিপোর্ট পজিটিভ আসতেই পারে। এক্ষেত্রে জিনোম সিকোয়েন্সিং-র মাধ্যমেই পুনঃসংক্রমণ হয়েছে কিনা, তা জানা সম্ভব।

আরও পড়ুন: ভয় বাড়াচ্ছে করোনা, মহারাষ্ট্র-দিল্লির পর পঞ্জাবেও নৈশ কার্ফু, বন্ধ রাজনৈতিক সমাবেশ

বিশ্বে করোনার পুনঃসংক্রমণের ঘটনা প্রথম হংকংয়ে ২০২০ সালের অগস্ট মাসে জানা যায়। ৩৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি ফের অগস্ট মাসে স্পেনে থেকে ফেরার পর করোনা আক্রান্ত হন। সেই রোগীর দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়। এরপরই পুনঃসংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা। এরপর একে একে চিন, বেলজিয়াম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও করোনার পুনঃসংক্রমণের বেশ কয়েকটি ঘটনা জানা যায়। এক্ষেত্রেও জিনোম বিশ্লেষণ করা হয়। ভারতে ২০২০ সালের অগস্ট মাসে করোনাভাইরাসের পুনঃসংক্রমণের তিনটি কেস আইসিএমআর নিশ্চিত করে।

করোনার পুনঃসংক্রমণের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হল করোনা ভাইরাসের রূপান্তর। দেখা গিয়েছে, ভাইরাস দ্রুত নতুন রূপে, নতুনভাবে নিজেকে পরিবর্তন করে নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি কোনও ব্যক্তি প্রথমবার করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও ফের করোনার নতুন স্ট্রেনে আক্রান্ত হতে পারেন।

সরকারী সূত্রে জানা গিয়েছে, মহারাষ্ট্রেও ডবল মিউট্যান্ট ভাইরাসের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও ১৮টি রাজ্যে ভেরিয়েন্ট অফ কনসার্নের (VOC) রূপগুলি পাওয়া যায়, যা পুনঃসংক্রমণের কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। হংকংয়ে পুনঃসংক্রমণের ক্ষেত্রেও মিউটেশন এবং নতুন স্ট্রেনকেই দায়ী করা হয়েছিল।

ভোপালের করোনা নিয়ে গবেষণারত ডঃ পুনম চন্দনির মতে, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে তৈরি অ্যান্টিবডিগুলির স্থায়ীত্ব নিয়ে ভিন্ন মত পাওয়া গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিলিত সমীক্ষা অনুসারে, করোনায় সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির দেহে ৮ থেকে ১০ মাস অবধি অ্যান্টিবডি পাওয়া গিয়েছে। তবে এতে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে তাদের দেহে পুনঃসংক্রমণ ঘটবে না। ডাঃ চন্দনী বলেন, “করোনার প্রতিটি নতুন স্ট্রেনের পাশাপাশি উপসর্গেও পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, শরীরের ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এবং বমি, ডায়রিয়া। তবে এই সমস্ত উপসর্গ ফ্লু-র কারণেও ঘটতে পারে। এই পরিস্থিতিতে উপসর্গগুলিকে সাধারণ ফ্লু হিসাবে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।”

বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, আইসিএমআরের গবেষণার জন্য ২০২০ সালের অক্টোবর অবধি তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ভারতে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আক্রান্তের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে পুনঃসংক্রমণের সংখ্যাও বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসে পুনরায় সংক্রামিত ব্যক্তিদের হার এক শতাংশ হলেও ভারতে এই হার ৪,৫ শতাংশ। এটি যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়।

ক্রিস্টান মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও দেশের খ্যাতনামা টিকাবিজ্ঞানী ডঃ গগনদীপ কং বলেন, “সংক্রমণের ঢেউ আসতেই থাকবে। যতক্ষণ না সবাইকে টিকা দেওয়া হবে, ততদিন সংক্রমণও এই ভাবেই বাড়তে থাকবে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদেরই বুঝতে হবে যে কোভিড-১৯ ভয়ঙ্কর ও করোনাভাইরাস এখনও দেশ থেকে নির্মূল হয়নি। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করতে হবে। ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। এছাড়াও মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও জনবহুল এলাকা এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।”

আরও পড়ুন: হাসপাতালে নিম্নমানের খাবার, সরবরাহকারীকে চড় মারলেন মন্ত্রী!