India’s Foreign Policy: চিন-আমেরিকার সাঁড়াশি চাপেও ‘শিরদাঁড়া’ সোজা ভারতের, স্বাধীন বিদেশনীতিই নজর কাড়ল ইমরানের

India's Foreign Policy: চিনও বোঝে ভারতকে ঋণের লোভ দেখিয়ে কব্জা করা যাবে না। তাই কয়েকদিন আগে চিনের বিদেশমন্ত্রী ভারতে এসে পার্টনারশিপের প্রস্তাব দিয়েছেন। বেজিং চায় লাদাখ, গালওয়ান ভুলে ভারত আবার চিনের সঙ্গে দোস্তি করুক।

India's Foreign Policy: চিন-আমেরিকার সাঁড়াশি চাপেও 'শিরদাঁড়া' সোজা ভারতের, স্বাধীন বিদেশনীতিই নজর কাড়ল ইমরানের
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Apr 09, 2022 | 12:48 PM

প্রদীপ চক্রবর্ত্তী : অনাস্থা ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে ভারত প্রশস্তি! ইমরান খানের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? পাকিস্তানের সাংবাদিকরা হতভম্ভ। ভারতের সাংবাদিক মহলও অবাক। পাকিস্তানে বসে ভারতের প্রশংসা করলে জনতা কি মেনে নেবে? রাজনৈতিক মহলের মত, ইমরান খান হিসেব করেই ঝুঁকি নিয়েছেন। তিনি পাক রাজনীতির চিরাচরিত রীতি ভাঙার চেষ্টা করেছেন। ভারত সম্পর্কে যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা পাক আওয়ামের মধ্যে রয়েছে, তাকেই উস্কে দিতে চেয়েছেন।

কী বলেছেন ইমরান?

খান নিয়াজির দাবি, পাকিস্তানিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে ভালভাবে ভারতকে চেনেন। এই দাবিতে কোনও ভুল নেই। ক্রিকেটার জীবন থেকেই ভারতে ইমরানের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। রয়েছে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগও। কলকাতা শহরে বহুবার এসেছেন তিনি। তবে গতকাল পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতীয়দের জাতিগতভাবে সত্‍ ও সাহসী বলেছেন। একইসঙ্গে বলেছেন যে, ভারতকে হুকুম করার স্পর্ধা কোনও সুপার পাওয়ারের হবে না। ইমরান হয়তো ভারতের উদাহরণ তুলে ধরে পাকিস্তানিদের মনে জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সেটা তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা হতে পারে। কিন্তু, ভারতের বিদেশনীতি নিয়ে তিনি যা বলছেন, তা একেবারে হাওয়ায় ভাসানো কথা নয়। এর পিছনে সারবত্তা রয়েছে।

চলতি সপ্তাহেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদ থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ৯৩টি দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ২৪টি দেশ ভোট দিয়েছেন রাশিয়ার পক্ষে। আর ভারত সহ ৫৮টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে। ভারত যে পক্ষ নেবে না, তা আগে থেকেই জানা ছিল। এই নিরপেক্ষতা শুধু আমেরিকা নয়, রাশিয়ারও পছন্দ হওয়ার নয়। কেন? মানবাধিকার পরিষদের নিয়ম অনুযায়ী কোনও দেশকে বহিষ্কার করতে প্রদত্ত ভোটের দুই তৃতীয়াংশ প্রয়োজন। কোনও দেশ ভোটদানে বিরত থাকলে সেই ভোট গ্রাহ্য হয় না। ভারত সহ ৫৮টি দেশ ভোট না দেওয়ায়, তাদের উপস্থিতি গ্রাহ্য হয়নি। প্রদত্ত ভোটের দুই তৃতীয়াংশ বিপক্ষে যাওয়াতেই মানবাধিকার পরিষদ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত আরও একবার প্রমাণ করেছে, তাদের বিদেশনীতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই নিয়ে মোট ১১টি ভোটাভুটিতে ভারত ভোটদানে বিরত রইল। মনমোহন জমানায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিল ভারত, তাও আমেরিকার চাপে। কিন্তু তার আগে ও পরে কখনও আমেরিকা ভারতের বিদেশনীতিকে পরিচালিত করতে পারেনি। রাশিয়া ইউক্রেনের উপরে আক্রমণ শুরু করার পরই ভারত বিদেশনীতিতে অকল্পনীয় দৃঢ়তা দেখিয়েছে। যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে ভারত। ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। ইউক্রেনে মানবিক ত্রাণও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, নেটো বনাম রাশিয়ার মধ্যে যে চাপা সংঘাত শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে ভারতের দূরদূরান্তে কোনও সম্পর্ক নেই। তাই এই বিষয়ে নাকও গলায়নি। বরং রাশিয়ার সস্তায় তেল বিক্রির অফার সাগ্রহে স্বীকার করে নিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, দেশবাসীর স্বার্থই আগে।

ডলার নয়, রাশিয়ার থেকে ভারত টাকার বিনিময়েই তেল কিনবে। কীভাবে? অতীতে ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময়ও এই বন্দোবস্ত প্রচলিত ছিল। রাশিয়া ও ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মেলবন্ধনে এই কেনাবেচা সম্ভব। রাশিয়ার ব্যাঙ্কের এক কূটনৈতিক শাখা এখানে থাকবে। তার অ্যাকাউন্টে তেলের দাম দিয়ে দেবে ভারত। সেই ব্যাঙ্ক রাশিয়ার মূল শাখায় ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দেবে। এই দোস্তি স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার পছন্দ হয়নি। যেমন, রাশিয়ার থেকে ভারতের অস্ত্র কেনাও আমেরিকার নাপসন্দ। পুরনো বন্ধুর থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করে ভারত। তার মধ্যে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে মার্কিন মুলুকের আপত্তি দীর্ঘদিনের। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব এমনও প্রস্তাব দিয়েছেন যে, রাশিয়ার সমমানের অস্ত্র আমেরিকা ভারতকে দেবে। কিন্তু, ভারত নিজের বাণিজ্যিক স্বাধীনতা আমেরিকার কাছে বন্ধক রাখতে রাজি নয়।

মেপে পা ফেলার বিদেশনীতি কতটা কার্যকর, তার হাতেগরম প্রমাণ তো রয়েইছে। বছর পনেরো আগে “ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড” প্রকল্প হাতে নেয় চিন। উদ্দেশ্য, সারা বিশ্বকে একটি অভিন্ন বাণিজ্যিক পরিকাঠামোয় যুক্ত করা। যে পরিকাঠামোয় উচ্চগতির একাধিক লেনের সড়ক থাকবে, বন্দর থাকবে। সকলে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। যাদের পরিকাঠামো তৈরির সামর্থ্য নেই, তাদের ঋণ দেবে চিন। এই প্রস্তাবে উন্নয়নশীল দেশগুলি সুদিনের স্বপ্ন দেখল। এদেশে যাঁদের বুদ্ধিশুদ্ধি বেজিংয়ের কাছে জমা রাখা আছে, তাঁরাও ধন্যধন্য করলেন। বর্তমানে দেড় দশক পরে সেই রোগের লক্ষণ বেরিয়ে আসছে। শ্রীলঙ্কার হাড়পাঁজরা বেরিয়ে গিয়েছে। একটি বন্দর চিনকে দিয়ে দিতে হয়েছে। এবার দেশটাই না চিনকে বেচে দিতে হয়। আর পাকিস্তান তো ভিতরে ভিতরে কবেই চিনের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র ভৌগলিক পরিস্থিতি ও আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণেই এখনও চিন পুরো দখল নিতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে রেষারেষি করতে গিয়ে চিনা ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশও। তারাও দুরুদুরু বুকে দুনিয়া দেখছে। আর চিনা লটারি না কাটা ভারত এখন নিশ্চিন্তে। পেট্রোলের দাম প্রতিদিন বাড়তে পারে। কিন্তু দেশবাসী না খেয়ে মরছে, এমন পরিস্থিতি হয়নি।

চিনও বোঝে ভারতকে ঋণের লোভ দেখিয়ে কব্জা করা যাবে না। তাই কয়েকদিন আগে চিনের বিদেশমন্ত্রী ভারতে এসে পার্টনারশিপের প্রস্তাব দিয়েছেন। বেজিং চায় লাদাখ, গালওয়ান ভুলে ভারত আবার চিনের সঙ্গে দোস্তি করুক। চিন-রাশিয়া ঐক্যে ভারতও যোগ দিক। আর আমেরিকা শুধু আমেরিকাতেই কোণঠাসা হয়ে পড়ুক। ভারত যদি চিনের সঙ্গে হাত নাও মেলায়, নিদেনপক্ষে কোয়াডে নিষ্ক্রিয় থাকুক। এমনটাই চায় বেজিং।

কোয়াড কী?

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্দেশীয় ঐক্যই হল কোয়াড। চিনের আগ্রাসন প্রতিরোধ করতেই এই জোট তৈরি করা হয়েছিল। এই ঐক্যের বড়দাদা আমেরিকা। ভারত তার সদস্য। তবে, অক্ষের অংশ হয়েও বিদেশনীতিতে ভারত স্বাধীন। তার উল্লেখ বারবার ইমরান খানের বক্তব্যে পাওয়া গিয়েছে। ভারত কোয়াডের অংশ হলেও, বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগরে কোয়াডকে ঢুকতে দেয়নি।

বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলির যে ঐক্য রয়েছে, তার নাম বিমস্টেক। এর নেতা ভারত। থাইল্যান্ড থেকে নেপাল, সকলেই এর সদস্য। বঙ্গোপসাগরে চিনের অগ্রগতি রুখতে এই ঐক্য সক্রিয়। হালেই নেপাল চিনকে জানিয়ে দিয়েছে, উন্নয়নের নাম করে ঋণের জালে জড়াতে তারা রাজি নয়। চিন যদি অনুদান দিতে চায় তো দিক। এদিকে বেজিং বুঝে যায় নেপালের হৃদয় পরিবর্তনের কারণ কী? করোনাকালে বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলিতে নামমাত্র দামে অথবা বিনামূল্যে টিকা দিয়েছে ভারত। সেই বিদেশনীতিরই সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।

চিন-রাশিয়া ও আমেরিকা। তিন মহাশক্তিধরের চাপ এভাবে অগ্রাহ্য করে চলা সহজ নয়। তার উপরে আবার ইউরোপের বন্ধুদেশগুলির পরোক্ষ চাপও রয়েছে। ব্রিটেন ও জার্মান বিদেশ সচিবরা এসে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দরবার করে গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের সেই আগের প্রতাপ আর নেই। বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতরে উচ্চতা যে বেড়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে আরও একটি ঘটনায়। যুদ্ধ থামানোর জন্য ভারতকে মধ্যস্থতা করতে বলেছে ইউক্রেন। রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেউ লাভরভও জানিয়েছে দিল্লি যদি মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয়, মস্কো তাতে সাড়া দেবে। ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে আলোচনায় বসতে অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুতিনের টিম কথাও বলেছে। কিন্তু, সরাসরি অন্যের যুদ্ধে মধ্যস্থতার পথে ভারত পা বাড়ায়নি। কারণ ভারতের বিদেশনীতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।