রামলালার মঞ্চ থেকে কী ছিল মোদীর মনের কথা, কী ছিল সংঘ প্রধানের অভিপ্রায়

Ayodhya Ram Mandir: ২২ জানুয়ারি মোদী শুধু রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি যা করেছেন, তা মন্দির ও ধর্ম-সম্প্রদায়ের সীমানা পেরিয়ে আরও অনেক বড়। তাঁর এই বার্তা, সবার জন্য। তিনি বুঝিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠা শুধু জয়ের নয়, বিনয়েরও। এটা একটি উপলব্ধির মুহূর্ত। পরিপক্কতার উপলব্ধি।

রামলালার মঞ্চ থেকে কী ছিল মোদীর মনের কথা, কী ছিল সংঘ প্রধানের অভিপ্রায়
আজ বাংলায় নরেন্দ্র মোদী। Image Credit source: PTI
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 23, 2024 | 8:47 PM

পাণিনি আনন্দ (গ্রুপ এডিটর(HSM), টিভি৯ ডিজিটাল)

গোটা দেশ আজ যেন রামময়। আর রাম যেন মোদীময়। কারণও আছে বটে যথেষ্ট। ২২ জানুয়ারি বা তার আগে-পরে যখনই রামের কথা উঠে এসেছে, তখনই একইসঙ্গে উঠে এসেছে মোদীর কথাও। ঠিক যেন ভগীরথ আর গঙ্গার মতো। পুরাণ মতে, দেবী গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন রাজা ভগীরথ। ঠিক তেমনই এখানেও। রামের আগমন যদি গঙ্গার আগমনের মতো হয়, তবে সেখানে মোদী হলেন ভগীরথের মতো। রাজা ভগীরথ কিন্তু গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসে বসে থাকেননি। তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের লক্ষ্যের দিকে। মোদীর চিন্তাভাবনা ও প্রস্তুতিও ঠিক তেমনই। রাম মন্দিরের প্রাঙ্গণে বক্তব্য রাখার সময়, তার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিতও দিয়েছেন মোদী।

মোদী বলেছেন, রাম বিবাদ নয়, তিনি সমাধানের নায়ক। তিনি আগুন নন, তিনি শক্তি। মোদীর বক্তৃতায় উঠে এসেছে দায়িত্ববোধের কথা। ভারতের মতো দেশ, যেখানে এত জাতি, এত বর্ণের মানুষ রয়েছেন, সেখানে কেউ কারও থেকে খাটো নন, সেকথা বোঝানো হয়েছে। দেশের তরুণ ব্রিগেডকে মোদী বুঝিয়েছেন, দেশের ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে গর্বের কথা। ভারত যে আজ চাঁদের মাটি স্পর্শ করেছে, তার জন্য দেশের হাজার বছরের পরম্পরা ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত হতে শিখিয়েছেন। সমাজের কল্যাণ ও উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরে বলা হয়েছে, এই মন্দির আগামী দিনে এক উন্নত ভারতের সাক্ষী হতে চলেছে। তিনি বুঝিয়েছেন এই সময়টা হল ভারতের সময়। এটাই সময়, একেবারে সঠিক সময়।

২২ জানুয়ারি মোদী শুধু রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি যা করেছেন, তা মন্দির ও ধর্ম-সম্প্রদায়ের সীমানা পেরিয়ে আরও অনেক বড়। তাঁর এই বার্তা, সবার জন্য। তিনি বুঝিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠা শুধু জয়ের নয়, বিনয়েরও। এটা একটি উপলব্ধির মুহূর্ত। পরিপক্কতার উপলব্ধি। রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বসুধৈব কুটুম্বকম ও বিশ্বাত্মার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠা ভারতীয় সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ, আদর্শের প্রতিষ্ঠা। যা আজ গোটা বিশ্বের প্রয়োজন।

মোদীর কথার সুর ধরেই বক্তব্য রাখতে দেখা গেল সংঘ প্রধান মোহন ভাগবতকেও। তিনি মোদীকে ‘তপস্বী’ বলে ব্যাখ্যা করেন। একইসঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দিলেন, যে দেশকেও তপস্যা করতে হবে। এর জন্য তিনটি ব্রতের কথা বলেন সংঘ প্রধান – সমন্বয়, দয়া ও সংযম। বক্তব্য রাখার সময় মহাত্মা গান্ধীর কথা এমনি এমনি বলেননি তিনি। তাঁর কথায় উঠে আসে সেই রামের কথা, যিনি সবার। সমতা ও সকলকে নিয়ে চলার উপরেও জোর দেন তিনি।

PM Narendra Modi and RSS Chief Mohan Bhagwat

রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

মন কী বাত

মোদীর বক্তব্য এবং তাঁর সমসুরে সংঘ প্রধানের বক্তব্যের বিষয়টি বুঝতে গেলে, একটু পিছনের দিকে যেতে হবে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীকে তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ করে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছিল। চার দিকে স্লোগান ছিল, মোদী সরকার। দেশের একটি ছোট রাজ্য থেকে উঠে আসা মুখ্যমন্ত্রী। যাঁর একটি নিজস্ব মডেল ছিল। উন্নয়নের মডেল। আর সেই মডেল সামনে রেখেই তিনি মানুষের কাছে ভোট চাইছিলেন। সেই মডেলকে সামনে রেখে প্রচার ব্যাপক সাফল্য পায় এবং ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন মোদী। এর পাঁচ বছর পর, ২০১৯ সালে আবারও ভোটে জেতেন মোদী। সেই সময়ই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন টার্গেট। বলেছিলেন, আগামী পাঁচ বছর দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নপূরণের সময়।

গত দশ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একেবারে নীচু স্তরে হোক, বা ব্যাপক কোনও স্তরে, কোনও ক্ষেত্রেই তাঁর চেষ্টায় কোনও খামতি রাখেননি। রান্নার গ্যাসের কানেকশন থেকে শুরু করে শৌচাগার, পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবা হোক, বা শস্যের ক্ষেত্রে অন্ত্যোদয় হোক, কিংবা সেমি হাইস্পিড ট্রেন নতুন বিমানবন্দর, বড় বড় প্রকল্প হোক সব ক্ষেত্রেই সরকারের এই সাফল্যের এক দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ভারত নতুন শিখর স্পর্শ করেছে। দেশের প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি রাজ্যে… তা সে বিজেপির শক্ত ঘাঁটিই হোক বা সংগঠন দুর্বল হোক, মোদীর ক্যারিশ্মা সর্বত্র একইরকম। যেন দেশের প্রতিটি কোণাতেই মোদীর নাম পাথরে খোদাই করা আছে।

শুরুটা হয়েছিল একটি রাজ্যের মডেল দিয়ে। আর তারপর থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক ব্যাপক আকার নিয়েছে। ক্ষমতায় আসার প্রথম পাঁচ বছরে একেবারে মৌলিক বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। আর পরের পাঁচ বছরে দেশবাসীর স্বপ্নকে এক নতুন উড়ান উপহার। এবার অযোধ্যায় রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠাও হয়ে গেল। এরপর কী? কার্যত সেই রূপরেখাই দিতে দেখা গেল মোদী ও মোহন ভাগবতকে।

রাম ও রাজ্যের বিস্তার

রাম-নাম ‘কাজ’ করতে শুরু করে দিয়েছে। বিপক্ষ শিবির প্রথম থেকে টালমাটাল অবস্থায় ছিল। এখন যেন ঘেরাটোপে আবদ্ধ। সামর্থ্য ও সামঞ্জস্যের চেষ্টা অনেকটা বালির প্রাসাদের মতো। কখন কোন ঢেউ এসে তা ভেঙে দেবে, কেউ জানে না। রাম-নামের সামনে অন্য কোনও ন্যারেটিভ টিকতে পারে না। তাই মোদী এখন এই রামের ন্যারেটিভকেই ছড়িয়ে দিচ্ছেন, সকলকে একসঙ্গে নিয়ে চলার জন্য। আর মোহন ভাগবতও সেই ন্যারেটিভেই অনুমোদন দিচ্ছেন।

মোদীর ব্যাখ্যায়, রাম হলেন দেশের বিধান, দেশের চিন্তা, চেতনা, গৌরব, ভাগ্য ও নীতি। কেউ এটাকে পরোক্ষে রামরাজ্যের ঘোষণা হিসেবে দেখতেই পারেন, কিন্তু লক্ষ্য অন্য কিছু। টার্গেট হল, লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ২৭২-এর থেকেও বড়। দ্বিতীয় টার্মের থেকেও বড়। তৃতীয়বার, আরও বেশি আসন নিয়ে মোদী সরকার। এটাই হল অন্যতম এক অন্তর্নিহিত ভাবনা। কিন্তু এই পথ সহজ নয়, তাই এখানে রামের থেকেও বড় হয়ে উঠেছেন রাজা রাম।

রাজা রাম। যিনি সবাইকে নিয়ে চলেন। যিনি সবাইকে সমানভাবে দেখেন। জ্ঞানী। তিনি কারও মধ্যে ভেদাভেদ করেন না, কাউকে হীন মনে করেন না। তিনি গান্ধীতেও আছেন, সংঘেও আছেন। তিনি সাধু-সন্তদের মধ্যেও আছেন, আবার গৃহস্থের মধ্যেও বিরাজমান। তিনি জাত-পাতের বেড়াজাল ভেঙে রামজ্যোতির সঙ্গে মানুষকে আবদ্ধ করবেন। রাজনীতিতে আরও এক জয়ের উপাখ্যান লিখবেন। তিনি রাজা রাম। তিনি শুধু মর্যাদা পুরোষোত্তম নন, বিপক্ষের যে কোনও তির নিরস্ত্র করার রাম-বাণ হলেন তিনি।

বিজেপির জন্য, মোদীর জন্য এবং সংঘের জন্য এবার এক অভূতপূর্ব জয় ভীষণভাবে দরকার। রাম সেই মুড তৈরি করে দিয়েছেন। এখন এই রামের সঙ্গে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সেটা তখনই সম্ভব, যখন এক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। মোদী খুব বুঝে শুনেই বলেছেন, ইতিহাসের জটে আটকে পড়া অনেক দেশই, সেই অতীতের জট কাটাতে গিয়ে আরও বেশি জড়িয়ে পড়েছে। সেই জট ভেঙে বেরোতে চান মোদী। মোহন ভাগবতও। অর্থাৎ, একটা বার্তা মিলছে, জটে জড়িয়ে পড়লে চলবে না। তাহলেই জনমত আরও বড় হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মত আরও বড় হবে।

এটাই হল মোদীর রাম রাজ্য কেন্দ্রিক রাজধর্মের একটি রূপরেখা। আর এই রূপরেখার উপর দাঁড়িয়েই আগামীর নির্বাচন হতে চলেছে।