সাবধান! সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বন্ধু’ করার আগে সতর্ক হোন, লকডাউনেই বাড়ছে বিপদ, বলছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা

কলকাতা: দেশে বেলাগাম করোনা (COVID19)। অনিয়ন্ত্রিত মৃত্যু। জারি লকডাউন। আর এই লকডাউনে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। অচিরেই জালিয়াতের ফাঁদে পড়ছে সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি, শহরের একাধিক এটিএম থেকে অভিনব কায়দায় চুরি হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। এটিএম মেশিনে (ATM) বিন্দুমাত্র আঁচড় না কেটে কী করে লক্ষাধিক টাকা নিজেদের ঝুলিতে ভরল তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়েছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। […]

সাবধান! সোশ্যাল মিডিয়ায় 'বন্ধু' করার আগে সতর্ক হোন, লকডাউনেই বাড়ছে বিপদ, বলছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা
প্রতীকী ছবি
Follow Us:
| Updated on: Jun 04, 2021 | 12:46 PM

কলকাতা: দেশে বেলাগাম করোনা (COVID19)। অনিয়ন্ত্রিত মৃত্যু। জারি লকডাউন। আর এই লকডাউনে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। অচিরেই জালিয়াতের ফাঁদে পড়ছে সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি, শহরের একাধিক এটিএম থেকে অভিনব কায়দায় চুরি হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। এটিএম মেশিনে (ATM) বিন্দুমাত্র আঁচড় না কেটে কী করে লক্ষাধিক টাকা নিজেদের ঝুলিতে ভরল তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়েছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বন্ধু’ করে অশ্লীল ভিডিয়ো চ্যাটের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত পাটুলির যুবক! লকডাউনের জেরেই বাড়ছে বিপত্তি, দাবি করছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা।

লালবাজার সাইবার সেলের সূ্ত্রে খবর, শহরে ফের গোপন আসর জমিয়েছে রাজস্থানের ভরতপুর গ্যাং। সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্বের ফাঁদ পেতে অশ্লীল চ্যাট ও ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেওয়ার নামে কালোডাকের ফাঁদে পড়েন এক যুবক। দক্ষিণ কলকাতার পাটুলির বাসিন্দা ওই যুবকের অভিযোগ, কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় (Social Media) একটি ‘ডেটিং অ্যাপের’পেজ দেখতে পান। সেই পেজে ক্লিক করতেই সেখানে এক যুবতীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই যুবতী নিজেকে ‘রত্না’বলে পরিচয় দেয়। ধীরে ধীরে আলাপ বাড়তে শুরু করে। ওই চ্য়াটেই ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে দুজনে ঘনিষ্ঠও হন। তাঁদের একান্ত মুহূর্ত নিজের ফোনে ওই যুবতী স্ক্রিনরেকর্ড করে রাখেন। যদিও যুবক এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে তখন। এরপরেই, ওই যুবকের কাছে টাকা চেয়ে হুমকি আসতে থাকে বলে অভিযোগ। টাকা না দিলে ওই ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভইরাল করে দেওয়া হবে এমনই হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতে থাকা হয় বলে অভিযোগ। কিছুদিন টাকা দেওয়ার পর ওই যুবকের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে দিল্লির সাংবাদিক আশিস কুমার বলে পরিচয় দেয়। এমনকী একটি জাল পরিচয়পত্রও হোয়াটস্যাপ করে পাঠায়। বলা হয়, তাঁদের কাছে ওই যুবকের সমস্ত ভিডিয়ো আছে। পাঁচলক্ষ টাকা না দিলে ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেওয়া হবে। যুবক প্রথমে জানান, তিনি অত টাকা দিতে পারবেন না। প্রায় ছয়হাজার টাকা অনলাইনে পাঠান। কিন্তু রেহাই মেলে না। দিনে দিনে কালোডাকের প্যাঁচে জড়িয়ে পড়েন ওই যুবক। ক্রমে দফায় দফায় পরিবারের জমানো পাঁচ লক্ষ টাকা পাঠান যুবক। কিন্তু, গত ২৬ মে আরও পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য হুমকি আসতে থাকে ওই যুবকের কাছে। তখন বাধ্য় হয়ে লালবাজার সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন যুবক।

লালবাজারের গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, পাটুলির যুবকই এই ধরনের প্রতারণার ফাঁদের প্রথম শিকার নন। সম্প্রতি, নারকেলডাঙাতেও একই ঘটনা ঘটে। সেখানে জালিয়াত নিজেকে পুলিশ কর্মী বলে পরিচয় দিয়েছিল। এছাড়াও,২০২০-র লকডাউন থেকে রঘুনাথগঞ্জ-সহ একাধিক এলাকায় প্রায় ২০টির বেশি এই ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সম্পূর্ণ একটি ‘রেকর্ডেড’ চ্যাটের মাধ্যমে অভিযোগকারীর সঙ্গে চ্যাট করে জালিয়াতরা। মনে হয়, যেন কোনও মহিলাই চ্যাট করছেন। ভিডিয়ো চ্যাট রেকর্ডিং-এর পরেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং। ফোন করে কেউ নিজেকে পুলিশকর্তা, কেউ সাংবাদিক, আবার কেউ প্রশাসনিক কর্তা বলে পরিচয় দেয়। জাল কার্ড দেখায়। লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে অধিকাংশ ব্য়ক্তিই টাকা দিয়ে দেন। আর এতেই সুযোগ পেয়ে যায় জালিয়াতরা।

তবে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদ নয়, জালিয়াতরা তাদের জাল বিস্তার করেছে এটিএমেও (ATM)। সম্প্রতি, শহরের একাধিক এটিএম থেকে ‘ভুতুড়ে’ কায়দায় লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছে দুষ্কৃতীরা। এটিএম ভাঙচুর বা কার্ড সোয়াইপ না করেই চলেছে এই অর্থ লুঠ। গ্রাহক নয়, এ বারে সরাসরি ব্যাঙ্কে নজর পড়েছে জালিয়াতদের। শহরে পরপর তিনদিন একই পদ্ধতিতে এটিএম থেকে টাকা লুঠের ঘটনায় তৎপর লালবাজার। প্রাথমিক তদন্তের পর লালবাজার কর্তাদের অনুমান, জামতাড়া গ্যাং-এর মতো ফরিদাবাদের একটি গ্যাং বিশেষভাবে এই কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। এটিএমের থেকে টাকা তুলতে তাঁরা বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

তবে, শহরের বুকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনাই নয়, করোনাকালে ওষুধের জালচক্র কাজ করার পেছনেও এরকম একাধিক ছোট ছোট গ্যাং কাজ করছে বলে দাবি তদন্তকারী গোয়েন্দাদের একাংশের। সব ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়াকে বিশেষ ভাবে ব্যবহার করছে জালিয়াতরা। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায়, ‘জীবনদায়ী ইঞ্জেকশনের’ খোঁজ চেয়ে আবেদন করে বা ‘রেমেডিসিভির পেতে ইনবক্স করুন’ এই ধরনের নানা বার্তা ঘুরে বেরাচ্ছে। রাজ্য় সরকারের নির্দেশিকা সত্ত্বেও সেই সব পোস্ট আটকানো যাচ্ছে না। ফলে চোখের সামনেই চলছে কালোবাজারি। শুধু, ওষুধ নয়, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের ক্ষেত্রেও সংক্রিয় এই কালোবাজারির দুনিয়া। মহারাষ্ট্রের এক চিকিৎসক বিভা আগরওয়াল রেমিডিসিভির কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। পরিবারের এক সদস্য করোনা আক্রান্ত হওয়ার জেরে রেমডিসিভিরের (Remdesivir) খোঁজ করছিলেন চিকিৎসক। হোয়াটস্যাপের দৌলতে রেমডিসিভিরের খোঁজ পেয়ে আর দেরি করেননি তিনি। কিন্তু, তখনও বোঝেননি, সুদূর বাংলা থেকে নিয়ন্ত্রিত কালোবাজারির জালে জড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে পেটিএমের (Paytm) মাধ্য়মে দুটি ভয়েলের জন্য ৬০০০ টাকা অগ্রিম দেওয়ার পরেই প্রেরকের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি বিভা। সুদূর গাজিয়াবাদ থেকে সেই জাল এসে পৌঁছয় হুগলির চন্দননগরে। সে বার, দুই চক্রীকে পাকড়াও করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

কাট টু ২০১৭। গোটা বিশ্বে আচমকা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একটি মারণ খেলা। নাম ‘ব্লু হোয়েল’। নীল তিমির গ্রাস থেকে বাদ গেল না ভারতও। কেরলে সর্বপ্রথম এই খেলায় যোগদান করে আত্নহত্যা করেন দুই ব্যক্তি। এরপর এই মারণ খেলা প্রবেশ করে বাংলাতেও। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত, হাওড়ার শ্যামপুর এমনকী কলকাতাতেও একাধিক স্কুল পড়ুয়া আসক্ত হয়ে পড়ে এই মারণ খেলায়। এমনকী, এই খেলায় যোগ দিয়ে মৃত্যুও হয় দুই পড়ুয়ার। কী এই ভয়ানক ‘ব্লু হোয়েল গেম’? এই খেলায় গেমারকে নানারকম টাস্ক দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি টাস্কই চ্যালেঞ্জিং এবং ক্ষতিসাধক। কখনও নিজের ক্ষতি কখনও বা অন্যের। খেলার শুরুতে প্রথমে হাত কাটা, হাতে রক্ত দিয়ে নীল তিমির উল্কি কাটা এই ধরনের কাজ বা টাস্ক গেমারকে দেওয়া হয়। এইভাবে যত স্টেপ এগোয় তত কঠিন হতে থাকে টাস্ক। শেষ ধাপ মৃত্যু তথা আত্মহত্যা (Suicide)। কেউ যদি মাঝপথে গেম ছেড়ে বেরতে চায় তবে তার কাছে ক্রমাগত প্রাণনাশক হুমকি আসতে থাকে। খেলার শেষ ওই আত্মহত্যায়। মূলত, ডার্ক ওয়েবের (Dark Web) জগতেই এই খেলার জন্ম। সেই বছর রীতিমতো শোরগোল ফেলেছিল এই মারণ খেলা। রাতারাতি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এই মারণ খেলা।

কাট টু ২০২০। নীল তিমির গ্রাস থেকে মু্ক্ত হলেও নতুন করে ই-গেমের বাজারে আসে ‘পাবজি’-র মতো জনপ্রিয় খেলা। সেই খেলা নিষিদ্ধ করা হয় ভারতে। সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয় ১৫০ টি চিনা অ্যাপ। চিনের সঙ্গে ভারতের ‘ঠাণ্ডা লড়াই’য়ের জেরেই মূলত ওই পদক্ষেপ করে ভারত। কিন্তু, পাবজির আসক্তি রীতিমতো ভয় ধরিয়েছিল বিশেষজ্ঞদের। পাবজি খেলার জন্য ফোনের ডেটা ভরানোর টাকা না পেয়ে মাকে খুন, কিংবা আত্মহত্যা করার মত বেশ কয়েকটি ঘটনা শোরগোল ফেলেছিল গোটা দেশে। সম্প্রতি, বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে ফ্রি-ফায়ার ও পাবজি।

প্রশ্ন উঠছে, আচমকা কেন বাড়ছে এই ধরনের সাইবার অপরাধের প্রবণতা? কীভাবেই বা কাজ করছে এই জালিয়াতি চক্র?

সাইবার বিজ্ঞান বলে, সাধারণত সাইবার অপরাধ মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। ক. আর্থিক খ.ব্যক্তিক গ. প্রশাসনিক। আর্থিক সাইবার অপরাধের মধ্যে পড়ে মূলত ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, অনলাইন আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি। এই পদ্ধতিতে হ্যাকাররা মূলত গ্রাহকের ব্যাঙ্কিং ক্রেনডেনশিয়ালস নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। তারপর আচমকাই ফাঁকা হয়ে যায় গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট। ব্যক্তিক সাইবার অপরাধের মধ্যে পড়ে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে সোশ্যাল হ্যাকলিং, ভিডিয়ো ফাঁস করে টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেল করা ইত্যাদি। আর প্রশাসনিক হল সরকারি বিভিন্ন নথি ও তথ্য় পাচার। যা মূলত সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতা। এই তিনধরনের সাইবার ক্রাইমের পেছনে কাজ করে এক বা একাধিক গোষ্ঠী। মূলত দুটি বিভাগের মাধ্যমেই এই সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হয়। একটি, সাইবার অপরাধের জন্য কোনও বিশেষ নেটওয়ার্ক বা সিস্টেমকে টার্গেট করা। উদাহরণস্বরূপ, ভাইরাস, ম্যালওয়ার ও ডিনাইল অব সার্ভিস অ্যাটাক বা ডিওস অ্যাটাক। অন্যটি হল, অপরাধ নিষ্পত্তিকরণে সিস্টেমকে ব্যবহার করা। যেমন- ফিশিং মেইল, সাইবারস্টকিং, আইডেনটিটি থেফ্ট।

কীভাবে কাজ করে এই পদ্ধতিগুলি? সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও অনিরাপদ সাইটের ব্য়বহার বা সাইটে অনুপ্রবেশ এমনকি, কয়েক সেকেন্ডের শেয়ারেও ব্য়ক্তিগত ডিভাইসে চলে আসতে পারে ভাইরাস। শুধু সাইট নয়, অনিরাপদ ইন্টারনেট পরিষেবাও সুবিধা করতে পারে জালিয়াতদের। ফোনে বা ল্যাপটপে অজান্তেই চলে যেতে পারে ভাইরাস। একই পন্থায় ব্য়বহার হতে পারে ম্যালওয়ার, যার জেরে ডিভাইসের গোটা সিস্টেম সফটওয়্যারকে নিজের কবজায় নিতে পারে হ্যাকার। অন্যদিকে, ফিশিং মেইল, সাইবারস্টিকিং-এর মতো পন্থায় ইউজ়ারের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখে হ্যাকাররা। সাধারণত, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল সাইটেই এই অচেনা প্রতারক ফাঁদ পাততে পারে।

সাইবার বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “লকডাউন এবং মহামারী হল সাইবার ক্রাইমের স্বর্গরাজ্য। প্য়ান্ডেমিকের জেরে মানুষের ঘর থেকে বেরনোর উপায় নেই। সারাদিন, তাই অনলাইনেই কাটছে সময়। পেশায় টান পড়েছে। রোজগারপাতিও নেই। সহজে কী করে টাকা আয় করা যায় সেইদিকেই ঝুঁকেছে মানুষ। তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার ক্রাইমও।” প্রায়, একই সুর কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ও সাইবার বিশেষজ্ঞ মহম্মদ ওমর জাকির গলায়। তিনি বলেন, “লকডাউনে কাজ নেই। অবসাদ ও একাকীত্ব গ্রাস করেছে মানুষকে। ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। অনেকক্ষেত্রেই তাই না বুঝেও ফাটকা আয় করতে এই ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে দিচ্ছেন মানুষ।” সম্প্রতি, শহরের বুকে ঘটে যাওয়া এটিএম লুঠ ও পাটুলির যুবকের সোশ্য়াল ভিডিয়ো চ্য়াটের মাধ্যমে ফেঁসে যাওয়ার পিছনেও এই লকডাউনকেই দায়ি করছেন তাঁরা।

অশ্লীল ভিডিয়ো চ্য়াট ফাঁস করে দেওয়ার নামে টাকা চেয়ে ব্ল্য়াকমেল করার পেছনে রাজস্থানের যে বিশেষ ভরতপুর গ্যাংটির কথা উঠে আসছে সে প্রসঙ্গে সাইবার বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্য়ায় জানান, এই  বিশেষ জালিয়াতির দলটি  কেবল এই দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনেই সক্রিয় হয়নি, বরং ২০২০-এর সময় থেকেই সক্রিয় ছিল। সেই সময় থেকেই একাধিক এই ধরনের অভিযোগ এসেছে। পাটুলির ঘটনা নতুন নয়। অন্যদিকে, মহম্মদ জাকি সাহেব জানান, সাধারণত, এই ধরনের সাইবার ক্রাইমের পেছনে আন্ত্যরাজ্য চক্র কাজ করে। ফলে, দুষ্কৃতীরা সর্বদাই একটি আড়াল রেখে চলে। ব্ল্যাকমেইলের টাকা হাতানোর জন্য অনলাইন পরিষেবা ব্যবহারের কারণ হল, যাতে সহজে চিহ্নিত না করা যায়। কারণ, ভিক্টিম প্রদত্ত টাকা ক্রমশই হাত বদল হতে থাকে। সবটাই চলে অনলাইনে। সেক্ষেত্রে, জালিয়াতরা একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারে। তাই, মূল চক্রীর কাছে পৌঁছতে বেগ পেতে হয় গোয়েন্দাদের। সেই সুযোগটাই নেয় জালিয়াতরা।

পাশাপাশি, শহরের এটিএম থেকে অভিনব কায়দায় চুরির পেছনেও কাজ করছে সাইবার হ্যাকারদের একটা বড় অংশ এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাথমিকভাবে, এই চুরির পেছনে ম্যান ইন দ্য মিডল অ্যাটাক (Man in the Middle Attack) বা মন্সটার ইন দ্য মিডল (Monster in the Middle) পন্থাটি কাজে লাগানো হয়েছে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। এর অর্থ হল, দুই সংযোগকারীর মধ্যে তৃতীয় কারোর ঐচ্ছিক অনুপ্রবেশ এবং ক্ষতিসাধন, সহজ বাংলায় সিঁদ কাটা। এই পন্থাটি কেবল টাকা লুঠের ক্ষেত্রে নয়, সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়ার বাক্যালাপেও সম্ভব। সাধারণত, এটিএমের সার্ভারের সঙ্গে ব্যাঙ্কের যে সার্ভার যুক্ত থাকে, হ্য়াকাররা সেইটিকেই টার্গেট করে। সার্ভারে নিজেদের ম্যালওয়ার প্রবেশ করিয়ে গোটা সিস্টেমটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। কোনও প্রমাণ ছাড়াই হাতের মুঠোয় চলে আসে টাকা। সর্বপ্রথম রাশিয়াতে এই পদ্ধতিতে ব্যাঙ্ক লুঠ হয়। যদিও, সাইবার বিশেষজ্ঞ অভিরূপ গুহর অনুমান, এর পেছনে কাজ করছে ‘ব্ল্যাক বক্স থিওরি’। এটিএম হ্যাকাররা ব্ল্যাক বক্স ডিভাইস ব্যবহার করছে। সেই ডিভাইসে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্য়মে ব্যাঙ্কের সার্ভার থেকে কম্যান্ড আসার বদলে এটিএমের কম্পিউটারে ভুয়ো কমান্ড পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। যার মাধ্যমে এই চুরি সম্ভব হচ্ছে। প্রায় অনুরূপ কথা বলেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞ বিভাসবাবু। তাঁর মতেও, এটিএম লুঠের পেছনে এই ধরনের ছোট ডিভাইস ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে এবং মাস্টার কিই ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের কার্ড দিয়ে এটিএমের হায়ার ডিনোমেশন বাকেটের থেকে সর্বাধিক টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে।

২০১৭-তে জনপ্রিয় হওয়া মারণ খেলা ‘ব্লু হোয়েল’-এর সঙ্গে ডার্ক ওয়েবের সংযোগ  আছে বলেই মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত জানান, ডার্ক ওয়েবের মাধ্য়মে এই ধরনের খেলার গেমারদের কীর্তিকলাপে কোটি টাকার বাজি ধরা চলতে পারে। চ্যালে়ঞ্জার হাত কাটেন কি না বা আত্মহত্যা করেন কি না এই ধরনের বিষয় নির্ধারণ করে তার উপর বাজি ধরা চলতে পারে। যেখান থেকে কয়েক কোটি টাকা কামাতে পারেন গেমের অ্যাডমিনরা।

বর্তমান যুগে টেকনোলজি ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। করোনা মহামারী যান্ত্রিক সভ্যতায় বুঁদ হয়ে থাকার অভ্যেস আরও বাড়িয়েছে। কিছুদিন আগে, হোয়াটস্যাপের নতুন পলিসি নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল টেক দুনিয়ায়। ইউজ়ারের সুরক্ষার সঙ্গে কোনওরকম আপোষ করা যাবে না, এমনই বলেছিলেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। আতঙ্কিত ছিলেন সাধারণ নেটিজেনরাও। টেকনোলজির দুনিয়ায় পদে পদে ছড়িয়ে রয়েছে। না জেনেই সেই ফাঁদে পা দেন আমজনতা। তাই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তৃতীয় বিশ্বের দেশে, সাইবার সতর্ক হওয়ার অবকাশ কম, কারণ, আইন পোক্ত নয়। তবুও সতর্ক থাকতে হবে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য  বলতে আসলে কিছুই নেই। সব তথ্য়ই কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ফোন নম্বর থেকে শুরু করে আধার নম্বর, ব্যাংক ডিটেইলস থেকে রোজের রুটিন সবটাই চলে যেতে পারে হ্যাকারদের হাতে। এমনকী, ইউজার বা ভিক্টিম কখন কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, সবটাই চলে যেতে পারে হ্যাকারদের হাতের মুঠোয়।

নিজেকে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত রাখার উপায়? 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের সাইবার হ্যাকিংয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে বেশ কিছু সহজ পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

আত্মোৎসাহে কোনও পদক্ষেপ না করা। অনিরাপদ ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার না করা। যেমন তেমন কোনও ব্রাউজিং লিংক শেয়ার না করা। যেকোনও সাইট যাচাই না করে ব্য়বহার না করা। কোনও ওয়েবসাইটের নামের শুরুতে https:// এর বদলে http:// থাকলে সেখানে চ্যাটিং করা বা কোনও ডেটা শেয়ার করা বা কিছু লেখার থেকে বিরত থাকা। অনলাইন ব্যাঙ্কিং পরিষেবার ক্ষেত্রে ব্রাউজিং লিংক বা ইউআরএল যাচাই করা এবং না শেয়ার করা।                                              কোনওরকম প্রলোভন বা প্ররোচনায় পা না দেওয়া। যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী সাইবার ক্রাইম সেলে যোগাযোগ করা ও থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে সফটওয়্যার সিউকিউরিটি আরও জোরদার করা। লেটেস্ট অপারেটিং সফটওয়্যার ব্যবহার করা এবং এটিএম গুলিতে রক্ষীর ব্যবস্থা করা।

আরও পড়ুন: বদলে যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গন, বন্ধ স্কুলে তৈরি হচ্ছে কোভিড কেয়ার ইউনিট, উদ্বোধনে রাজ্যের দুই মন্ত্রী