Left front in Bengal: ৩৪ বছরের শাসক থেকে তৃতীয় শক্তি, বাংলায় ‘লাল’ক্ষয় কোন পথে?

Left front in Bengal: সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট বাংলায় ক্ষমতায় আসে ১৯৭৭ সালে। তারপর ৩৪ বছর বাংলার মসনদে ছিল বামেরা। জ্যোতি বসু আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই ৩৪ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয় বামেরা। তারপর কেটেছে ১৩ বছর। এই কয়েক বছরে রাজ্যে 'লাল'ক্ষয় চোখে পড়ার মতো। আজ বাংলায় বিধানসভায় সিপিএমের কোনও প্রতিনিধি নেই। লোকসভায়ও বাংলা থেকে কোনও প্রতিনিধি নেই সিপিএমের।

Left front in Bengal: ৩৪ বছরের শাসক থেকে তৃতীয় শক্তি, বাংলায় 'লাল'ক্ষয় কোন পথে?
৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর কীভাবে রাজ্যে মাটি হারাল সিপিএম?
Follow Us:
| Updated on: Jun 21, 2024 | 4:20 PM

কলকাতা: নকশাল আন্দোলন। জরুরি অবস্থা। সাতের দশকের মাঝামাঝি অস্থির বাংলা। রাজ্যে ক্রমশ বাড়ছে লাল ঝান্ডা। এই অবস্থায় এল সাতাত্তরের নির্বাচন। এমন একটা নির্বাচন, যা আগামী ৩৪ বছরের বামশাসনের পথচলার সূত্রপাত ঘটাবে। সেই সূচনাও হল জাঁকজমকভাবে। তারপর ৩৪ বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বইল। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ, কৃষক-শ্রমিকদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেল সিপিএম তথা বামেরা। বিদায় পর্বের আগেও ঘটনার ঘনঘটা। যে কৃষক, গ্রামের মানুষের সমর্থন ৩৪ বছর ধরে পেয়ে এসেছিল লাল ঝান্ডা, তারাই সরে গেল। ২০০৬ সালের নির্বাচনেও যারা দুশোর বেশি আসন পেয়েছিল, তারাই মুখ খুবড়ে পড়ল ২০১১-র নির্বাচনে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৩ বছর কেটেছে। আর তার সঙ্গে রাজ্যে তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে সিপিএম তথা বামেরা। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার ৮ শতাংশও পেরোতে পারেনি। বাংলা থেকে উনিশের নির্বাচনে শূন্য হয়ে গিয়েছে বামেরা। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হাত ধরেও বাংলায় খাতা খুলতে পারেননি মহম্মদ সেলিমরা। একই ছবি চব্বিশেও। কংগ্রেসের হাত ধরেও বাংলায় শূন্য-ই রইল সিপিএম। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বাংলায় কেন এমন হাল বামেদের? বাংলায় ‘লাল’ক্ষরণের কারণ কী? ৩৪ বছরের শাসনের কোনও ভুল কি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সিপিএম-কে? রাজনৈতিক পরিসরে এইসব প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে।

সাতাত্তরে ক্ষমতায় আরোহণ-

ক্ষমতার চূড়ায় সাতাত্তরে পৌঁছলেও, বাংলায় বামেদের উত্থানের বীজ স্বাধীনতার প্রাক্কালেই বপন হয়েছিল। কিষাণ সভার তেভাগা আন্দোলনকে হাতিয়ার করে গরিব কৃষকদের ‘অবলম্বন’ হয়ে ওঠে তৎকালীন সিপিআই। ভাগ-চাষিরা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের দাবি ছিল, মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবেন চাষি এবং এক ভাগ পাবেন জমির মালিক। এই আন্দোলনকে হাতিয়ার করে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে বামেরা।

১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ছিল সিপিআই। বিরোধী দলনেতা হন জ্যোতি বসু। ১৯৬৪ সালের ৭ নভেম্বর সিপিআই ভেঙে সিপিএম নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তার বছর তিনেকের মধ্যেই একক দল না হলেও জোটে থেকে প্রথমবার ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে সিপিএম তথা বামেরা। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে প্রথমবার বাংলায় সরকার গড়ে অ-কংগ্রেসি সংগঠন। অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সেই ইউনাইটেড ফ্রন্টে ছিল সিপিএম-সহ একাধিক বাম দল।

তার পরের ১০ বছরে বাংলার রাজনীতির চিত্র অনেকটাই বদলে যায়। ১৯৭২ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ও সিপিআইয়ের জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। তবে নির্বাচনে রিগিংয়ের অভিযোগ তুলে সরব হয় সিপিএম।

বছর তিনেক পর দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন থেকে ২১ মাস জারি ছিল জরুরি অবস্থা। তার পর দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে কংগ্রেসকে হারিয়ে দেশে সরকার গঠন করে জনতা দল।

আর কেন্দ্রে জনতা দল সরকার গঠনের পর ৯টি রাজ্যের বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়। সেখানে নতুন করে নির্বাচন হয়। তার মধ্যে একটি পশ্চিমবঙ্গ। বাংলায় জনতা দলের সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনায় নামে সিপিএম নেতৃত্ব। জনতা দলকে ৫৬ শতাংশ আসন ছাড়তে চায় তারা। এমনকি, নির্বাচনে জিতলে জনতা দলের নেতা প্রফুল্ল সেনকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাবও দেওয়া হয় সিপিএমের তরফে। কিন্তু, জনতা দল জানিয়ে দেয়, তারা ৭০ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। ফলে সাতাত্তরের নির্বাচনে জনতা দলের সঙ্গে জোট হয়নি সিপিএমের। আর এই জোট না হওয়াই বামেদের ৩৪ বছর শাসনের সূত্রপাত ঘটায়।

সিপিএমের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালে বাংলায় মসনদ দখল বামেদের

১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ২২৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৭৮টি আসনে জেতে সিপিএম। অন্যদিকে, ২৮৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ২৯টি আসন পায় জনতা দল। সেখানে কংগ্রেস ২৯০টি আসনে লড়ে পায় ২০টি আসন। এভাবেই সাতাত্তরে বাংলার মসনদে বসে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। মুখ্যমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু। সাতাত্তরের ভোট প্রচারে বামেদের স্লোগান ছিল, কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। এই স্লোগানই ভোট প্রচারে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বামেদের। নির্বাচনে কার্যত কংগ্রেসকে গুঁড়িয়ে দিয়েই ক্ষমতা দখল করে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট।

নিরঙ্কুশ বাম-

ক্ষমতায় এসেই অপারেশন বর্গা ও ভূমি সংস্কারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় জ্যোতি বসুর সরকার। আর অপারেশন বর্গাকে হাতিয়ার করে ভাগচাষিদের কাছে আরও ‘আপন’ হয়ে ওঠে সিপিএম। যার সুফল তারা পেতে থাকে নির্বাচনগুলিতে।

১৯৮২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ২৩৮ আসনে জেতে। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে সেই সংখ্যা আরও বাড়ে। ১৯৯১ সালেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেন জ্যোতি বসু। সিপিএম একাই জিতেছিল ১৮২টি আসন। ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের কিছুটা ধাক্কা দিয়েছিল কংগ্রেস। সেইসময় কংগ্রেসের যুব নেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উদ্যোগেই যুব কংগ্রেসের অনেক নতুন মুখ টিকিট পান। কংগ্রেস পায় ৮২টি আসন। আর একানব্বইয়ের নির্বাচনের চেয়ে ২৯টি আসন কম পায় সিপিএম।

২০০১ সালের নির্বাচন-

২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য রাজনীতিতে দুটি পালাবদল ঘটে। প্রথমত, শারীরিক অসুস্থতার কারণে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়েন জ্যোতি বসু। তাঁর জায়গায় ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

দ্বিতীয়টি রাজনৈতিকভাবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গঠন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে তাঁর নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস।

বাংলায় একবিংশ শতকের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে তৃণমূল। ভোটের ফলেও তার ছাপ পড়ে। ২১১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সিপিএম জেতে ১৪৩টি আসনে। বামফ্রন্ট পায় ১৯৬টি আসন। অন্যদিকে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে নেমেছিল তৃণমূল। ২২৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬০টি আসনে জয়ী হয় ঘাসফুল শিবির। আর তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেস ৬০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২৬টি আসনে জেতে। বামফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও ১৯৭৭ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা সিপিএম প্রথমবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণ্ডি টপকাতে পারল না।

২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মসনদে বুদ্ধদেব-

পাঁচ বছর পর আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে বামফ্রন্ট। সিপিএম একাই পায় ১৭৬টি আসন। বামফ্রন্ট জেতে ২৩৫টি আসন। অন্যদিকে, ২০০৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের হাত না ধরে বিজেপির সঙ্গে জোট করে তৃণমূল। ঘাসফুল শিবির পায় মাত্র ৩০টি আসন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৪ সাল পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনেও বিপুল জনসমর্থন পেয়েছে বামেরা। ভোটের ফলের দিকে নজর দিলেই সেই চিত্র স্পষ্ট হবে।

বামফ্রন্ট বাংলায় সরকার গড়ার পর ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম পায় ২০টি আসন। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে খুন হন। তার জেরে লোকসভা নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে দেশজুড়ে কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতির ভোটের ছবি ধরা পড়ে। তারপরও বাংলায় কংগ্রেস পেয়েছিল ১৬টি আসন। সিপিএম পায় ১৮টি আসন। বাকি আসনগুলি জেতে তাদের শরিকরা।

১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় সিপিএমের আসন সংখ্যা আরও বাড়ে। সেবার তারা পায় ২৭টি আসন। ২ বছর পর ফের লোকসভা নির্বাচন হয়। সেবার ২৭টি আসন পায় সিপিএম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ২৩টি আসন পায় তারা। ২ বছর পর ফের লোকসভা নির্বাচন হয়। ১৯৯৮ সালের সেই নির্বাচনে সিপিএম জেতে ২৪টি আসন। ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃণমূল কংগ্রেস ৭টি আসনে জেতে।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফের লোকসভা নির্বাচন। ১৯৯৯ সালের সেই লোকসভা নির্বাচনে ২১টি আসন পেয়েছিল সিপিএম। তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩৫.৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে, তৃণমূল জিতেছিল ৮টি আসনে। তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২৬.০৪ শতাংশ।

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৩৫টি আসন জেতে। তার মধ্যে সিপিএম পায় ২৬টি আসন। বামফ্রন্টের শরিক দল সিপিআই, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক তিনটি করে আসন জেতে।

২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত বাংলায় কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সিপিএম। ২০০৬-র নির্বাচনে বামেদের স্লোগান ছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। ২০০৬ সালে ফের মসনদে বসার পর বাংলায় শিল্পের বন্ধ্যাদশা কাটাতে উদ্যোগী হন বুদ্ধদেব। শিল্পায়নে জোর দেন। তার জন্য জমি অধিগ্রহণ ঘিরেই বাংলার রাজনীতি নতুন মোড় নেয়।

সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের আঁচে টালমাটাল বামদুর্গ-

হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানা। ২০০৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার পরই কারখানার কথা ঘোষণা করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কারখানার জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকার। সেখানে ন্যানো কারখানার কাজও শুরু হয়। কিন্তু, জোর করে বহুফসলি জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। শুরু হয় আন্দোলন। সেই আন্দোলনে যোগ দেয় তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ধর্মতলায় ধর্নায় বসেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা ২৬ দিন অনশন চালান। জাতীয় রাজনীতি পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম এবং বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী অনশন প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতে অনড় থাকেন মমতা। শেষপর্যন্ত গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর প্রতিশ্রুতিতে অনশন প্রত্যাহার করেন তৃণমূল সুপ্রিমো। ধর্মতলার মঞ্চে রাজ্যপালের হাতে ফলের রস খেয়ে অনশন প্রত্যাহার করেন মমতা।

তৃণমূল সুপ্রিমোর এই অনশনকে প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়নি বাম সরকার। কিন্তু, সিঙ্গুরের আন্দোলনের বীজ যে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়। মমতার অনশন মঞ্চে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন জেলার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা। মমতার অনশনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে।

বাংলায় বামেদের পতনের অন্যতম কারণ সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলন

সিঙ্গুর নিয়ে আন্দোলন যখন তীব্র, তখন পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে দানা বাঁধতে থাকে আন্দোলন। ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠী নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব গঠনের বরাত পেয়েছিল। নন্দীগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠতে রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে বাধা দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জমি হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনে শুধু বিরোধীরা নয়, অনেক শাসকদলের কর্মী-সমর্থকরাও সামিল হয়েছিলেন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন আন্দোলনকারীরা।

২০০৭ সালের ১৪ মার্চ-

আন্দোলন থামাতে সেদিন অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। চলেছিল গুলি। প্রাণ হারান ১৪ জন। তৃণমূলের দাবি, সেই সংখ্যাটা আরও বেশি। সংখ্যা যাই হোক, ঘটনার প্রতিবাদে নানা মহল সরব হল। রাস্তায় নামলেন বিদ্বজ্জনরা। এমনকি বামফ্রন্টের মধ্যেও এই নিয়ে চাপানউতোর তৈরি হয়। বাম শরিকদের চাপে কেমিক্য়াল হাবের স্থান পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নয়াচরে কেমিক্যাল হাবের পরিকল্পনা করে বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু, ততদিনে রাজ্যে বাম বিরোধী আন্দোলন চরমে উঠেছে। তার প্রভাব স্পষ্ট হল ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনে।

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামেদের পিছনে ফেলল তৃণমূল-

সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আন্দোলনের পর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিন দশকের বাম শাসনের অবসানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক ধাক্কায় বামেদের ভোট অনেকটাই কমে যায়। ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৯ হাজার ১৩৭টি আসনের মধ্যে ৩২,৩০৭টি আসন জিতেছিল বামেরা। শতাংশের হিসেবে যা ছিল ৬৫.৭৫। সেখানে ২০০৮ সালে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪০ হাজার ৭৮৭টি আসনের মধ্যে ২১,৭০৮টি আসনে জেতে বামেরা। শতাংশের হিসেবে যা ৫২.৩০।

সিঙ্গুর আন্দোলনের পরও অবশ্য হুগলি জেলা পরিষদ নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিল বামেরা। হুগলি জেলা পরিষদের ৪৭টি আসনের মধ্যে বামেরা পায় ৩৬টি। আর তৃণমূল জেতে ১১টি আসনে।

তবে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ হারায় বামেরা। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পরিষদের ৫৩টি আসনের মধ্যে ১৭টি পায় বামেরা। তৃণমূল জেতে ৩৫টি আসন। পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়াও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল। এই জেলার ৭৩টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে ৩১টি আসন পায় বামেরা। তৃণমূল পায় ৩৪টি আসন। কংগ্রেস জেতে ৩টি আসন। মালদা ও উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদ আবার দখল করে কংগ্রেস।

সবমিলিয়ে ২০০৯-র লোকসভা নির্বাচনের আগেই ধাক্কা খায় বামেরা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রভাব যে রাজ্যজুড়ে পড়েছে, ২০০৯-র লোকসভা নির্বাচনে তা স্পষ্ট টের পায় বামেরা। এই নির্বাচনে বামেদের পিছনে ফেলে দেয় তৃণমূল। ঘাসফুল শিবির জেতে ১৯টি আসন। সেখানে সিপিএম পায় ৯টি আসন। তাদের জোটসঙ্গীরা জেতে ৬টি আসনে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসও জিতেছিল ৬টি আসন। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোনও লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের থেকে বাংলায় বেশি আসন জিতল অন্য কোনও দল।

নেতাই গণহত্যা-

এগারোর বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে বাম বিরোধী হাওয়া স্পষ্ট হতে লাগল। সেইসময় আরও একটি ঘটনা বাংলায় বামেদের কফিনে কার্যত শেষ পেরেক পুঁতে দিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। পশ্চিম মেদিনীপুরের (বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলা) নেতাই গ্রামে। সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি থেকে গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ উঠে। মৃত্যু হয় ৯ জনের। জখম হন আরও কয়েকজন। এগারোর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই এই ঘটনায় রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়। বছর তিনেক পরে নেতাই গণহত্যার জন্য ভুল স্বীকার করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

এগারোয় ৩৪ বছরের বামদুর্গের পতন বাংলায়-

২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ও পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে পালাবদলের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। ২০১১ সালের নির্বাচনে সেটাই বাস্তবায়িত হল। এগারোর নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল তৃণমূল। মমতার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণ্ডি পার করে। তৃণমূল পায় ১৮৪টি আসন। কংগ্রেস জেতে ৪২টি আসন। আর সিপিমাত্র ৪০-এ থমকে যায়। অন্য শরিক দলগুলি মিলিয়ে বামফ্রন্ট পায় ৬২টি আসন। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাদবপুর আসনে তৃণমূল প্রার্থী মণীশ গুপ্তর কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনে তৃণমূল পায় ৩৮.৯৩ শতাংশ ভোট। আসন বিপুল সংখ্যক কমলেও সিপিএম ৩০.০৮ শতাংশ ভোট পায়।

৩৪ বছর পর বাংলায় ক্ষমতার হাতবদল

চোদ্দোর লোকসভা এবং ষোলোর বিধানসভা নির্বাচনে আরও আসন কমে সিপিএমের-

এগারোর নির্বাচনে রাজ্যে পালাবদলের পর চোদ্দোর লোকসভা নির্বাচন ছিল বামেদের কাছে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। কিন্তু, তিন বছর আগে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের কাছে দাঁড়াতে পারেননি বাম প্রার্থী। ৩৪টি আসন জেতে ঘাসফুল শিবির। সেখানে বামফ্রন্ট জেতে ২টি আসন। ২ আসনই জেতেন সিপিএম প্রার্থী। চোদ্দোর নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৯.৭১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যার মধ্যে সিপিএম পেয়েছিল ২৩ শতাংশ।

ষোলোর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামেরা। কিন্তু, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও কোনও লাভ হয়নি। উল্টে আসন কমে সিপিএমের। ষোলোর নির্বাচনে সিপিএম ২৬টি আসন জেতে। কংগ্রেস জেতে ৪৪টি আসন। তৃণমূল একাই পায় ২১১টি আসন। ভোট শতাংশের হিসেবে তৃণমূল পায় ৪৪.৯১ শতাংশ ভোট। সিপিএম পায় ১৯.৭৫ শতাংশ ভোট।

উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বামেদের খালি হাত-

৩৪ বছরের বাম দুর্গের পতনের পর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দুটি আসনে জিতেছিল সিপিএম। বামফ্রন্টের অন্য কোনও শরিক কোনও আসনে জিততে পারেনি। কিন্তু, পাঁচ বছর পর সেই দুটো আসনও হারাতে হয় সিপিএম-কে। উনিশের নির্বাচনে বামেদের স্লোগান ছিল, ‘বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও; তৃণমূল হঠাও, বাংলা বাঁচাও’। কিন্তু, সেই স্লোগান যে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি, ভোটের ফলই তা ব্যক্ত করছে।

উনিশের নির্বাচনে বামেরা ৪১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। একটি আসনও জিততে না পারলেও বামেরা পায় ৭.৪৬ শতাংশ ভোট। তার মধ্যে ৬.২৮ শতাংশ ভোট পায় সিপিএম।

একুশের নির্বাচনে শূন্য বাম-

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সবে ১০ বছর কেটেছে। আর এই দশ বছরেই বিধানসভায় শূন্য হয়ে গেল বামেরা। একুশের নির্বাচনে কংগ্রেসের হাত ধরেছিলেন মহম্মদ সেলিমরা। তাদের সংযুক্ত মোর্চায় সামিল হয়েছিল সদ্য গঠিত ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট। বামফ্রন্ট প্রার্থী দিয়েছিল ১৭৭টি আসনে। তার মধ্যে ১৫৮টি আসনে বাম প্রার্থীদের জামানত জব্দ হয়। মাত্র ৪টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম। আর বামেদের সবচেয়ে খারাপ ফল দার্জিলিং আসনে। সেখানে তারা ছিল সপ্তম স্থানে। স্বাধীনতার পর প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কোনও বাম প্রতিনিধি রইল না। একুশের নির্বাচনে সিপিএম ভোট পেয়েছে মাত্র ৪.৭ শতাংশ।

চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনেও বাংলার ভোটাররা খালি হাতে ফেরাল বামেদের-

এগারোয় রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ক্রমশ বাংলায় শক্তি কমেছে সিপিএমের। কিন্তু, চব্বিশের নির্বাচনের আগে নিজেদের হারানো জমি কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধারের আশায় ছিলেন সিপিএম নেতারা। চব্বিশের নির্বাচনে সিপিএম যেমন প্রবীণ মুখকে প্রার্থী করেছিল। তেমনই ভোট ময়দানে নেমেছিলেন সিপিএমের নবীন ব্রিগেডও। কিন্তু, বামেদের মুখে হাসি ফুটল না। বাংলায় ৪২টি আসনের মধ্যে ২৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল সিপিএম। একটা আসনেও লাল আবির উড়ল না। উল্টে সিপিএমের ২৩ প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ২ জন জামানত রক্ষা করতে পেরেছেন। বাকি ২১ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামেদের এই ব্যর্থতার কারণ কী?

রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল একাধিকবার অভিযোগ করেছে, উনিশ সাল থেকে পরপর নির্বাচনে বামেদের ভোট গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে। তৃণমূলকে হারাতে তলে তলে বিজেপির সঙ্গে সিপিএম আঁতাত করেছে বলেও অভিযোগ ঘাসফুল শিবিরের।

বিজেপির সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বাম নেতারা। তবে তাঁরা স্বীকার করছেন, ২০১৯ এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে বাম সমর্থকদের একাংশের ভোট পেয়েছে বিজেপি। বাম নেতৃত্বের বক্তব্য, উনিশ ও একুশের নির্বাচনে বাংলায় তৃণমূল ও বিজেপির দ্বৈরথের তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছিল। বাম যুব নেত্রী দীপ্সিতা ধর বলেন, একুশের নির্বাচনে বিজেপি প্রচার করে বেড়িয়েছে, তৃণমূলকে হঠাতে পারে তারাই। বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র বলেন, রাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপির দ্বৈরথের আবহ তৈরি করা হয়েছিল। তৃণমূলকে শিক্ষা দিতে উনিশের লোকসভা নির্বাচনে অনেক বাম সমর্থক বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, একুশের নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে সেই ধারণা ভাঙছে। দীপ্সিতা বলেন, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই তার প্রভাব দেখা গিয়েছে। বহু জায়গায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছেন বাম প্রার্থীরা।

দ্বিতীয়ত, বাম নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ ওঠে, তারা পরবর্তী প্রজন্মকে সামনে আসার সুযোগ দেয় না। কিন্তু, একুশের নির্বাচনে একঝাঁক তরুণ মুখকে প্রার্থী করেছিল বামেরা। সৃজন ভট্টাচার্য, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দীপ্সিতা ধর, পৃথা তা, ঐশী ঘোষ, সায়নদীপ মিত্র, প্রতিকুর রহমানের মতো একঝাঁক পরবর্তী প্রজন্মের নেতা-নেত্রীকে ভোট ময়দানে নামিয়েছিলেন বিমান বসু-মহম্মদ সেলিমরা। তার পরও অবশ্য নির্বাচনে ছাপ ফেলতে পারেনি সিপিএম। চব্বিশের নির্বাচনে সেই একই ছবি দেখা গিয়েছে।

১৩ বছর পর কোথায় পিছিয়ে পড়ল বামেরা? কেন বামেদের ভোট শতাংশ এতটা কমল? আমরা যোগাযোগ করেছিলাম সিপিএমের কলকাতার জেলার সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কল্লোল মজুমদারের সঙ্গে। ভোট কমার কারণ নিয়ে তিনি বলেন, “এগারোর নির্বাচনের আগে তৃণমূল বলেছিল, বদলা নয়, বদল চাই। কিন্তু, এগারোর নির্বাচনের পর হিংসার শিকার হন বাম কর্মী-সমর্থকরা। সেইসময় দলের সংগঠনও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যা করার দরকার, সেইসময় সংগঠন তা করতে পারেনি। তার ফলে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে বামেরা। তার প্রভাব পড়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে।”

একের পর এক নির্বাচনে শূন্য হওয়ার কারণ নিয়ে কল্লোল মজুমদার বলেন, “উনিশ ও একুশের নির্বাচনের আগে রাজ্যে একটা বাইনারি তৈরি করা হয়েছিল। তৃণমূল বনাম বিজেপি। ফলে অনেকেই ভাবতে শুরু করলেন, তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিতে হবে। সেটাই দেখা গিয়েছিল উনিশ ও একুশের নির্বাচনে। মানুষ অবশ্য ধীরে ধীরে সব বুঝছেন।”

কংগ্রেসের সঙ্গে হাত ধরা নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা একসময় কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছি। সেইসময় পুঁজিপতিদের কাছে প্রধান দল ছিল কংগ্রেস। কিন্তু, এখন তারা কেন্দ্র কিংবা রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। পুঁজিপতিরা এখন বিজেপির হাত ধরেছেন। আমাদের এখন প্রধান বিরোধী বিজেপি। ফলে কংগ্রেসের হাত ধরে লড়াইয়ে সামিল হওয়ায় কোনও অসুবিধা নেই। মানুষকে আমাদের অবস্থান বুঝিয়েছি। সবাই বুঝছেন।”

২০১১ সালের পর বামেদের শক্তি ক্রমশ হ্রাসের কারণ নিয়ে কী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা? আমরা যোগাযোগ করেছিলাম রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্রের সঙ্গে। একাধিক প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামেদের ভোট ক্রমশ কমল কেন?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রে এটা হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তৃণমূল বিরোধী ভোটাররা বামেদের ভোট দিয়েছেন। যদি আমরা বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার দেখি, তাহলে দেখব, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০১৬ পর্যন্ত বামেদের ভোটের হার ধীরে ধীরে কমেছে। কিন্তু, ২০১৬ সালের পর যে ভোটগুলি হয়েছে, সেগুলির দিকে নজর দিলে দেখবেন, তৃণমূল বিরোধী ভোট বিজেপি পেতে শুরু করল। কারণ, মানুষ মনে করলেন, তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারবে বিজেপি। এটা প্রধান কারণ। বিরোধী দলের ব্যাটন বদলে গেল।

কিন্তু, ৩৪ বছরের শাসনকালে তো বামেদের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল। সেটা কেন সরে গেল?

শুভময় মৈত্র বলেন, বামেদের ভোটব্যাঙ্ক বলে কিছু হয় না। হয় শাসকের ভোট। নয় বিরোধীদের ভোট। বামেরা যখন ক্ষমতায় ছিল, মানুষ হয় শাসকদলকে ভোট দিতেন, নয়তো বিরোধীদের। বহুদলীয় গণতন্ত্রে এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে, একজন মানুষ কোনও একটি দলের প্রতি চিরকাল সমর্থন জানিয়ে যাবেন। বামেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন যে ভোটার বামেদের ভোট দিয়েছেন, হয়তো তিনি মনে মনে কিছুটা বামেদের সমর্থক কিংবা শাসকদলের সমর্থক ছিলেন। ফলে একজন ভোটারের মধ্যে দুই চরিত্র থাকতে পারে। ফলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলে যাওয়ার পর ওই ভোটারের ক্ষেত্রে দুই দিক থাকতে পারে। হয় তিনি শাসকের সঙ্গে থাকতে চাইতে পারেন। কিংবা তৃণমূল তাঁদের হারিয়েছেন, তাই তার বিরোধী দলকে ভোট দিতে চান। এই দিক দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বামেদের ভোট খুব একটা কমেনি। কারণ, তারা তখন বিরোধী দল ছিল। কিন্তু, বিরোধী দলের ভূমিকা বদলের পর বামেদেরও ভোট কমে।

কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের ফলে বামেদের সুবিধা হল না অসুবিধা?

শুভময় মৈত্র: এটা এক কথায় বলা যায় না। কেউ ভাবতেই পারেন, যে দলের এতদিন বিরোধিতা করলাম, তাকে কেন ভোট দেব। আবার এটা নাও হতে পারে। বিরোধী দলকে যাঁরা ভোট দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা ভোট দেবেন।

৩৪ বছরের শাসনে কোনও ভুলের জেরে কি বামেদের বর্তমান এই পরিস্থিতি?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, তা যদি হয়, তা হলে তো ২০১১ সালের পর বামেরা ভোটই পেত না। ২০১৪ সালেও বামেরা লোকসভায় আসন জিতেছে। বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার যদি দেখেন, ২০১৬ সালের পর খুব বেশি কমতে শুরু করেছে। মানুষ ভাবেন, বিরোধী দলের ভূমিকা কে নিচ্ছে, সেই মতো ভোট দিচ্ছেন। মানুষ যদি মত না বদলাতেন, তাহলে তো ভোট করার দরকারই পড়ত না। মানুষ সবসময় দেখে, কে তাদের নিরাপত্তা দেবে। মানুষের মনে একাধিক ভাবনা আসে। কিন্তু, ভোট তো দিতে পারবেন একটি দলকেই। সেই মতো সিদ্ধান্ত নেন।

বামেরা ক্যাডার ভিত্তিক দল। তারপরও তাদের সমর্থনে এমনভাবে ধস নামল কীভাবে?

শুভময় মৈত্র: ক্যাডার ভিত্তিক দল মানে এটা নয় যে, মানুষের সমর্থন নির্দিষ্ট থাকবে। সিপিএম ছেড়েও নেতারা অন্য দলে গিয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রে মানুষের সমর্থন বদলানো স্বাভাবিক।

৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ও মাত্র ১৩ বছরে রাজ্যে বামেদের তৃতীয় শক্তিতে নেমে আসা নিয়ে অধ্যাপিকা অর্পিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, ক্ষমতায় থাকলে অনেকসময় শাসকদলে বেনোজল ঢুকে। বামেদের সময়ও তা হয়েছে। ফলে ছোট ছোট জায়গায় মানুষের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু, বিকল্প না থাকায় মানুষ হয়তো বামেদের ভোট দিচ্ছিলেন। কিন্তু, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর সবাই বামেদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামলেন। এমনকি, বুদ্ধিজীবীরাও বামেদের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন। মানুষের মনে যে ছোট ছোট ক্ষোভ ছিল, সেগুলোই বড় আকার ধারণ করল।

বামেদের ভোট কমার কারণ নিয়ে অধ্যাপিকা অর্পিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, যাঁরা এত কষ্ট করে বামেদের ব্রিগেডে আসছেন, ভোটের বাক্সে তাঁরা অন্য দলকে সমর্থন করবেন, এটা হয় না। মানুষ ভোট সঠিকভাবে দিতে পারছেন কি না, সেটা দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলায় একটা দ্বৈরথ তৈরি করা হয়েছে। তৃণমূল বনাম বিজেপি। অনেকে মনে করছেন, তৃণমূলকে জব্দ করতে পারবে বিজেপি-ই। এটাও বামেদের ভোট কমার কারণ হতে পারে।

‘হাল ফেরাতে লাল ফেরাও’। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রচারে ঝড় তুলেছিল বামেদের এই প্যারোডি। ভোটের ফলে অবশ্য তাদের হাল ফেরেনি। তিন বছর পর চব্বিশের নির্বাচনেও সেই একই ছবি। ফলে বামেদের হাল কবে ফিরবে, সেই উত্তর লুকিয়ে সময়ের গর্ভে।