Bangladesh: ‘ভয় পেলে তুমি শেষ, রুখে দাঁড়ালে বাংলাদেশ’
Bangladesh: ‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান ক্ষিপ্ত তীর ধনুক, আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ’, ভিড়ে ঠাসা রাস্তা হোক বা একাকী চায়ের দোকান, ব্যস্ত বাস-ট্রেন-ট্রাম হোক পাড়ার ঠেক, প্রতুল মুখোপাধ্য়ায়ের কণ্ঠে এই গান একবার বেজে উঠলেই ধুতি-পাঞ্জাবির ছেড়ে ‘হাফসোল’ খাওয়া ‘শ্যুটেড-বুটেড’ বাঙালি কিন্তু আজও কেমন যেন আনমোনা হয়ে ওঠে।
সালটা ছিল ১৯৫২। দিনটা ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলায় ৮ ফাল্গুন। ফাগুনের বাতাসে তখন বসন্তের রঙ। আর সেই বসন্তেই রক্ত স্নান করেছিল ‘বাংলাদেশ’। ভাষা আন্দোলনের আবহে গোটা দেশ উত্তাল। ওই দিনই ১৪৪ ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাকাকাছি আসতেই বসন্তের বারবেলায় শুরু হয়ে গিয়েছিল গুলির বৃষ্টি। বাকিটা ইতিহাস। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজটা যেন বপন হয়ে গিয়েছিল তখনই। ওই সময়েই তৈরি ‘বাংলার জয়’ শব্দ দু’টি ওপার বাংলার বাঙালির ভাগ্যই একেবারে বদলে দেয়। চেতনা, ঐক্য, দেশপ্রেম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসাবে উঠে আসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) নির্মমতার বিরুদ্ধে এক মূর্ত প্রতীক হিসাবে উঠে আসে এই স্লোগান। ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে বাড়তে থাকা জনরোষ একাত্তরে মুক্তির স্বাদ এনে দেয় ওপার বাংলার মানুষকে। ঝড় তোলে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, ‘নাজিম-নূরুল দুই ভাই/এক দড়িতে ফাঁসি চাই’, এর মতো স্লোগান। স্লোগান ঝড়ের সেই তো শুরু। দিন যত গড়িয়েছে, সময় যত বয়েছে তাতেই যেন ধারে-ভারে-শক্তিতে আরও হয়েছে ঝাঁঝালো, আরও হয়েছে তীব্র। আর আজ তাই যেন কোটা আন্দোলনের আবহে বারবার শোনা যাচ্ছে ‘ভয় পেলে তুমি শেষ, রুখে দাঁড়ালে বাংলাদেশ’ এর মতো স্লোগানের গর্জন।
‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান…’
২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন থেকে হালের কোটা আন্দোলন, ছবিটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের ‘কলরবে’ মুখরিত হয়েছে এপার বাংলাও। ‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান ক্ষিপ্ত তীর ধনুক, আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ’, ভিড়ে ঠাসা রাস্তা হোক বা একাকী চায়ের দোকান, ব্যস্ত বাস-ট্রেন-ট্রাম হোক পাড়ার ঠেক, প্রতুল মুখোপাধ্য়ায়ের কণ্ঠে এই গান একবার বেজে উঠলেই ধুতি-পাঞ্জাবির ছেড়ে ‘হাফসোল’ খাওয়া ‘শ্যুটেড-বুটেড’ বাঙালি কিন্তু আজও কেমন যেন আনমোনা হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে সোশ্যাল মিডিয়ায় তো একেবারে বাঙালির ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হয়ে ওঠে এই ‘গণ গান’। সেই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতে রাজনীতির আঙিনা হোক বা কোনও সমাজিক আন্দোলন, কিংবা স্বাধীন ভারতে নানা ইস্যুতে বারেবারেই হিন্দোলিত বাঙালির মন। একেবারে প্রথমসারিতে থেকে আন্দোলনের হাল ধরতে দেখা গিয়েছে কত শত বাঙালিকে। স্লোগান হোক বা স্লোগান মুখর বাঁধা গান, এ মাঠে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। স্বাধীনতা আন্দোলন হোক বা জরুরি অবস্থা, খাদ্য আন্দোলন হোক হালফিলের যাদবপুর-প্রেসিডেন্সির ছাত্র আন্দোলন। বারবারই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে রকমারি সব আগুনে স্লোগান। তবে ক্ষেত্রে এপার বাংলাকে কিছুটা হলেও বেশি গোল দিয়ে এগিয়ে রয়েছে ওপার বাংলা।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান হোক বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ…
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান হোক বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বা হালের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, সব ক্ষেত্রেই ও পার বাংলার স্লোগানের ঝড় এতটাই তীব্র হয়েছে তা ছড়িয়ে পড়েছে এবার বাংলার সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে। ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, হোয়াটসঅ্যাপ হোক বা ফেসবুক, গত কয়েক সপ্তাহে সর্বাধিক শেয়ারের তালিকায় একেবারে ‘এক নম্বরে’ উঠে এসেছে কোটা আন্দোলনের আবহে তৈরি এই স্লোগান। আর তাতেই মিলেমিশে একাকার দুই বাংলা।
এদিকে ১৯৬৫-৬৬ সালেও যখন এ পার বাংলায় খাদ্যসঙ্কট তীব্র আকার নেয় তখনও কিন্তু গোটা দেশ দেখেছিল বড়সড় ছাত্র আন্দোলন। খাবার আর কেরোসিনের দাবির মিছিলে গিয়ে নুরুল ইসলাম আর আনন্দ হাইত নামে দুই অল্পবয়সি ছাত্র মারা যেতেই সংগ্রামের রাস্তায় হেঁটেছিলেন বিমান বসু থেকে দীনেশ মজুমদার, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা। ‘গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরি হও, কার ঘরে জ্বলেনি দীপ চির আঁধার তৈরি হও, কার বাছার জোটেনি দুধ শুকনো মুখ তৈরি হও। জোট বাঁধো তৈরি হও।’ সলিল চৌধুরীর লেখা কবিতার লাইনই ঘুরতে থাকে মুখে মুখে। এদিকে ওই সমসাময়িক সময়েই ততক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে ওপার বাংলায়। এবারের কোটা আন্দোলেনর হাত ধরে উঠে আসে একের পর এক স্লোগনের হাত ধরেই অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন সেই সব স্মৃতির পাতায়।
‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’
অনেকেই বলছেন শুরু থেকেই স্লোগানের তীব্রতা, স্লোগানের ঝাঁঝ, স্লোগানের দীপ্তি-গভীরতা-ব্যাপকতাই যেন এবারের আন্দোলনকে আরও বেশি করে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ছাত্ররাই হয়ে উঠেছেন ‘বিপ্লবের’ পুরোধা। হাসিনার ‘রাজাকার’ মন্তব্য থেকে হাসিনার ‘পদত্যাগ-দেশত্যাগ’ অস্ত্রধারী পুলিশের সামনে অস্ত্রহীন ছাত্রদের কাছে এই স্লোগানই হয়ে উঠেছে সবথেকে বড় হাতিয়ার। সে কারণেই হয়তো যে আন্দোলন শুরুতে দানা বেঁধেছিল ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’ এর মতো স্লোগানের হাত ধরে শেষে তাই যেন বলে ওঠে ‘ভয় পেলে তুমি শেষ, রুখে দাঁড়ালে বাংলাদেশ’।
‘সুবোধ তুই…’
তবে এখানেই শুরু, এখানেই শেষ, ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয়। উঠেছে পাকিস্তান বিরোধী স্লোগানও। সে কারণেই হয়তো যে দেশে এক সময় কেউ বলে উঠেছিল ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ সেই দেশই এখন গর্জে ওঠে ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘দেশটা নয় পাকিস্তান, কোটার হোক অবসান’, ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি রাজপথে’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’ এর মতো সব সংগ্রামী স্লোগানের হাত ধরে। আর তার রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছে গোটা বিশ্ব….