মাতৃস্নেহে লালন থেকে মুক্তমনা ভাবনা, ইমনের হাত ধরে ‘মুদ্রা’ বদলে দিয়েছে অসংখ্য মানুষের জীবন
ছোট থেকেই বাবা যেন ইমনের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ইমনের বাবা কাজ করতেন ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টে। রোজকার ব্যস্ততার মধ্যেও, ইমনের সমস্ত দিকে খেয়াল রাখতেন তিনি। তাঁর পড়াশুনা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, খেয়াল রাখা, আবদার মেটানো — ইমনের জীবনের সমস্ত দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি
প্রতিদিনের কাজ, সংসার সামলানো আর সময়ের অভাবে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজদের শখ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে দি। ইচ্ছে থাকলেও যেন হয়ে ওঠে না। যন্ত্রমানবের মতো নিয়মমাফিক গতে বাঁধা রুটিনে চলতে থাকে জীবন। যাপনের সেই রুটিনেই খানিক স্বস্তির নিশ্বাস দিতে, তথা নিজের মতো করে মুক্ত মনে জীবনের স্বাদ উপভোগ করার ঠিকানা নিয়ে হাজির হয়েছেন ইমন। জন্ম দিয়েছেন ‘মুদ্রা’র।
কলকাতার বুকে ‘মুদ্রা’ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে নাচ, গান, যোগা ইত্যাদি শেখানো হয়। মন খারাপ হয়ে থাকা, হতাশ হওয়া মানুষের ভাল থাকার ঠিকানা এই ‘মুদ্রা’। প্রাচীন আয়ুর্বেদে ‘মুদ্রা’র অর্থ বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি যার নিয়মিত চর্চা মানুষকে শারীরিক ও মনস্তাত্বিক উৎকর্ষতা প্রদান করে। ইমনের তৈরি ‘মুদ্রা’র কাজও ঠিক তাই। রোজকার চাপে মানুষ যখন ভারাক্রান্ত, সেই সময় তাঁদের পথ দেখিয়ে জীবনের মানে খুঁজে দেওয়ার কাজই করে ‘মুদ্রা’। কিন্তু ‘মুদ্রা’র জন্ম কী ভাবে? কোন ভাবনা থেকে ‘মুদ্রা’ তৈরির কথা ভেবে নিলেন ইমন? উত্তর রয়েছে ইমনের গল্পে।
ইমন একাধারে নৃত্যশিল্পী, অন্য দিকে যোগা প্রশিক্ষক। খুব ছোট থেকেই ইমনের জীবন জুড়ে ছিল নাচ ও যোগা। ছোটবেলায় গুরু সঞ্চিতা ভট্টাচার্যের কাছে ওডিসি শেখেন তিনি। তালিম নিয়েছিলেন তনুশ্রী শঙ্করের কাছেও। অবশ্য এখনও এক সঙ্গে পারফর্ম করেন তাঁরা। অন্য দিকে শিশির বিশ্বাসের কাছে যোগার সার্টিফিকেট কোর্সও করেছেন। আর এই দুই শখকে সঙ্গী করেই বিশ্বজয়ের পথে নেমেছেন ইমন।
ইমনের জীবন কেটেছে একদম অন্য ভাবে। ছোট থেকে নিজের মাকে পাননি। অথচ ‘মা’ শব্দটার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে তাঁর কাছে। মাতৃদিবস উপলক্ষ্যে এই প্রসঙ্গ উঠলে ইমন জানান, “ছোট থেকে আমি নিজের মাকে পাইনি। তার বদলে আমি তাঁদেরকে পেয়েছি, যাঁরা আমার এই বড় হয়ে ওঠার পথের সঙ্গী ছিলেন। আমায় রাস্তা দেখিয়েছেন। আমার সাফল্যের পথের পথিকৃৎ হয়েছেন। যাঁদের অবদান আমার জীবনে অনেকখানি। আমার কাছে এঁরা প্রত্যেকেই মা।”
ছোট থেকেই বাবা যেন ইমনের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ইমনের বাবা কাজ করতেন ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টে। রোজকার ব্যস্ততার মধ্যেও, ইমনের সমস্ত দিকে খেয়াল রাখতেন তিনি। তাঁর পড়াশুনা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, খেয়াল রাখা, আবদার মেটানো — ইমনের জীবনের সমস্ত দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে ইমনের পাশে ছিলেন তাঁর নৃত্য প্রশিক্ষকেরা। তাঁদের হাত ধরেই জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পেয়েছেন ইমন, আর এখন আছে তাঁর মেয়ে প্রেরণা গুপ্ত।
ধীরে ধীরে ইমন বুঝতে পেরেছিলেন জীবনে চলার পথে নিজেকে খুঁজে পাওয়া কতটা জরুরি! সেই ভাবনা থেকেই ২০২০ সালে থেকে তৈরি করেন ‘মুদ্রা’।
‘মুদ্রা’ আসলে একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে নাচ, যোগা ইত্যাদি শেখানো হয়। যদিও এই দুই কলায় নিজের প্রতিষ্ঠানকে আবদ্ধ রাখতে চাননি ইমন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সম্পূর্ণ অন্য। প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে গিয়ে ইমন বলেন, “আমরা শুধু মাত্র নাচ বা যোগাই শেখাই না। বরং কোনও শিক্ষার্থীকে আমরা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে শেখাই। কারণ এক জন পরিপূর্ণ মানুষই পরবর্তী সময়ে পরিবারের সমস্ত দিকে ভারসাম্য রেখে চলতে পারে। ইমন আরও বলেন, “সব মেয়েরাই কি মা হতে পারে? জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায়? তা হলে আমরা যশোদা মা ও দেবকী মায়ের মধ্যে কোনও ফারাক দেখতাম না। এক জন জন্ম দিয়েছেন। আর এক জন লালন করেছেন। আমার কাছে ‘মুদ্রা’য় যে শিক্ষার্থীরা আসেন, তাঁদের আমি মাতৃস্নেহে জীবনের পথ দেখাই। জীবনটাকে উপভোগ করতে শেখাই।”
ইমনের কাছে ‘মা’ মানে সন্তানকে বেড়ে ওঠার সময় সব রকম সাহায্য করা, সমস্ত মূল্যবোধ নিয়ে তাকে বড় করা, যাতে সে আগামীদিনে সুস্থ সমাজ গড়তে ভূমিকা নিতে পারে। ‘মুদ্রা’ তৈরির সময় এমনটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ইমনের। বর্তমানে ‘মুদ্রা’র সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন বহু মানুষ। এখানে যেমন প্লাস সাইজের মহিলারা নাচ শিখতে আসেন, তেমনই আসেন ক্যান্সারজয়ীরাও। আসেন অবসাদে জড়িয়ে পড়া মানুষরাও। এমন বহু মা ও সন্তানও আছেন, যাঁরা ‘মুদ্রা’তে নাচ শেখেন ও প্রতিনিয়ত পারফর্ম করেন। এমনকি যাঁরা মা হতে পারছেন না, তাঁরাও এখানে এসে যোগা, আসন, প্রাণায়মের মাধ্যমে মা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন।
‘মুদ্রা’য় যেমন নাচ ও যোগা শেখানো হয়, ঠিক তেমনই প্রাণায়ম, ধ্যান ইত্যাদির দিকেও নজর দেওয়া হয়। ইমন জানালেন, “এখানে যা যা শেখানো হয়, তার প্রত্যেকটির নেপথ্যে বিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে। এর প্রত্যেকটি কোনও মানুষকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। যাতে সেই ব্যক্তি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলতে পারে।”
ঠিক নিজের সন্তানের মতো করেই ‘মুদ্রাকে’ সাজিয়ে তুলেছেন ইমন। ইমন বলেন, “একট বাচ্চা যে ভাবে হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে, ধীরে ধীরে চোখের সামনে বড় হয়ে ওঠে, ‘মুদ্রা’ও আমার ঠিক তেমনই। এখানে শিখতে আসার জন্য বয়সের কোনও বাঁধা নেই। চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে ৮৫ বছরের পুরুষ, মহিলা, সব বয়সের মানুষই শিখতে আসেন ‘মুদ্রা’য়। তাঁদের দিয়ে আমি শো-ও করাই।”
পায়ে পায়ে তিন বসন্ত পেরিয়েছে ‘মুদ্রা’। এসেছে অনেক খ্যাতি। বিদেশে শো করা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করা, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, শুরুর সময় থেকে এই সব কাজই করে আসছে ‘মুদ্রা’। ইমনের মতে, “যে মায়েরা বা কর্মরত মহিলারা ভেবে ছিলেন যে সংসার আর কাজ সামলেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে, তাঁদেরকে আমরা শখ পূরণে সাহায্য করেছি। তাঁদের পথ দেখাতে পেরেছি। নাচ ও যোগার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদেরকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পেরেছি।” শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে অন্যদেরও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
আসলে জীবন অনেক বড়। জীবনকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবার আছে। রোজের রুটিন থেকে বেরিয়ে জীবনকে অন্য ভাবে উপভোগ করার জন্য খোলা রয়েছে অনেক পথ। যে পথ অনুসরণ করে আমরা অনেক দূর এগোতে পারি। ‘মুদ্রা’ পথপ্রদর্শকের মতো সেই আলোর রাস্তাই দেখিয়ে চলেছেন সাধারণ মানুষকে। আর ইমন ঠিক নিজের মেয়ের মতো করে সামলে রেখেছেন ‘মুদ্রা’কে। এই বিষয়ে ইমন বলেন, “মায়েদের দায়িত্ব অনেক। কারণ এক জন মায়ের প্রতিচ্ছবি সব সময় সন্তানের উপরে পড়ে। আমি চাই ‘মুদ্রা’ যেন আমার মতো করে প্রত্যেককে জীবনের মানে খুঁজে দিতে পারে।”
আবার অন্য দিকে শিক্ষার্থীরাও নিজ যত্নে আগলে রেখেছেন ‘মুদ্রা’কে। মুদ্রা আসলে তাঁদের কাছে মায়ের মতো। সম্প্রতি,মুদ্রা তাদের প্লাস সাইজের নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘ফাটাফাটি’- এর প্রচারমূলক কার্যকলাপে হাত মিলিয়েছে।
এই মাতৃদিবসে সকল মায়েদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ইমন। সেই সঙ্গে মুদ্রার তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি দিলেন সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রাণোচ্ছ্বল জীবনের।