মা-ঠাকুমার হাতের হারিয়ে যাওয়া রান্নাই ফিরিয়ে দিচ্ছে সুতপার তৈরি ‘হিমুর হেঁশেল’

সুতপার জীবনে আক্ষেপ ছিল একটাই — ‘জীবনে কিছুই করা হল না।’ বয়স যখন ৪০, সেই সময়েই এই দেশের নাগরিকত্ব পান তিনি। সময়ের সঙ্গে বয়স হয়ত বেড়েছিল, তবে জীবনে কিছু করে দেখাবার জেদ কোনও অংশে কমেনি সুতপার। তাই নাগরিকত্ব পাওয়ার পরে আর অপেক্ষা করেননি তিনি। শুরু করে দেন কাজের সন্ধান

মা-ঠাকুমার হাতের হারিয়ে যাওয়া রান্নাই ফিরিয়ে দিচ্ছে সুতপার তৈরি ‘হিমুর হেঁশেল’
Sutapa BaruaImage Credit source: We Make Us
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: May 13, 2023 | 7:53 PM

মায়ের হাতের রান্না মানেই অন্য রকম স্বাদ। এই পৃথিবীর অমূল্য যা কিছু তার হয়ত একটি, মায়ের হাতে তৈরি খাবার। পরম মমতায় সন্তানদের জন্য রাঁধেন তিনি। যে খাবারের তুলনা চলে অমৃতের সঙ্গে। তাঁর হাতের জাদুতেই লুকিয়ে রয়েছে কত-শত পদের বাহার। যা শুধু পেট ভরায় না, মনকেও ভরিয়ে তোলে। অথচ বর্তমান সময়ে কাজের চাপে আর ডায়েটের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সে সব পদ। বিগত ৬ বছর ধরে মায়ের হাতে তৈরি, হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ে যেতে বসা বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যশালী পদকে নব আঙ্গিকে তুলে ধরেছে ‘হিমুর হেঁশেল’। যে রেস্তরাঁ তৈরির নেপথ্য কারিগর সুতপা বড়ুয়া। 

কিন্তু কী ভাবে তৈরি হল হিমুর হেঁশেল? কী ভেবেছিলেন সুতপা? চলুন জেনে নি।

সময়টা ১৯৯৩ সাল। বাংলাদেশ থেকে এই দেশে চলে আসেন সুতপা বড়ুয়া। মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই  বিয়ে। তবে বিয়ে হওয়ার পর নাগরিকত্ব পেতেই সুতপার লেগে গিয়েছিল ১৩ বছর। নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নাগরিত্বের অধিকার না পাচ্ছেন, তত দিন তিনি অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। অগত্যা বিয়ের পর সেই ১৩টা বছর ধরে বাড়িতে সংসার সামলেই কাটিয়ে দিতে হয় সুতপাকে

Himur-Heshel-Sutapa-Barua-min

Sutapa Barua

ছোট থেকেই রান্নার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল সুতপার। মা যখন রান্না করতেন, সুতপা উঁকি মেরে দেখতেন রান্না ঘরে। আর পাঁচজনের মতোই মায়ের হাতের রান্না টানত সুতপাকে। পরবর্তী সময়ে যখন ভারতে আসেন, সেই সময়েও রান্না যেন তাঁর পিছু ছাড়েনি। বিশেষ করে ওপার বাংলার রান্না। বিয়ের পরে অবসর সময়ে বসে মা-ঠাকুমার হাতে তৈরি নানান পদ রেঁধে খাওয়াতেন বাড়ির লোককে।  

সুতপার জীবনে আক্ষেপ ছিল একটাই — ‘জীবনে কিছুই করা হল না।’ বয়স যখন ৪০, সেই সময়েই এই দেশের নাগরিকত্ব পান তিনি। সময়ের সঙ্গে বয়স হয়ত বেড়েছিল, তবে জীবনে কিছু করে দেখাবার জেদ কোনও অংশে কমেনি সুতপার। তাই নাগরিকত্ব পাওয়ার পরে আর অপেক্ষা করেননি তিনি। শুরু করে দেন কাজের সন্ধান। প্রাথমিকভাবে এক জন অ্যাকাডেমিক কো-অর্ডিনেটর হিসাবে মেডিকাতে কাজ করা শুরু করেন সুতপা। ৩ বছর এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এর পরে একে একে সিএমআরআই, লিভা ফাউন্ডেশন সোনারপুর এবং সব শেষে ইউনিসেফ। ইউনিসেফ-এ কাজ করার সময় তাঁকে বদলি করা হয় মুর্শিদাবাদে। কিন্তু এক জন মায়ের কাছে তাঁর সন্তানের গুরুত্ব বরাবরই সবকিছুর আগে। তাই সেই সময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন কাজ থেকে বিরতি নিয়ে নিজের সন্তানকে সময় দেওয়ার। তবে এতে সুতপার কোনও আক্ষেপ ছিল না কোনও দিনই।

আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই জায়গা থেকে সরে আসা এতটা সহজ হয়নি তার পক্ষে। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই পাশে পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। সন্তানও ভীষণভাবে সাপোর্ট করেছিলেন তাঁকে। স্বামী ও সন্তানকে প্রাধান্য দিতে কাজের জগত থেকে বিরতি নিলেও থেমে থাকেননি সুতপা। তৈরি করেন হিমুর হেঁশেল।

২০১৭ সালে হিমুর হেঁশেলের জন্ম। সপ্তাহান্তে হিমুর হেঁশেল থেকে খাবার পৌঁছে যেত বিভিন্ন জায়গায়। প্রাথমিক স্তরে হিমুর হেঁশেলে সুতপার যাত্রা ছিল মাত্র ৪ মাসের। এর পর ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ফের শুরু করেন হিমুর হেঁশেল। এ বারে হিমুর হেঁশেলের যাত্রা ছিল ক্লাউড কিচেন রূপে। এই প্রসঙ্গে সুতপা বলেন, “আমার কাছে রান্না করাটা একটা শখ। রান্না করলে আমার মন ভাল হয়ে যায়। রান্না আমার মননে। ভাবিনি এই শখই এক দিন আমার পেশা হয়ে উঠবে।”

Sutapa Barua

Sutapa Barua

অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতোই যাত্রা শুরু করে স্বপ্নের হিমুর হেঁশেল। তবে যাত্রার শুরুটা খুব একটা সহজ ছিল না তাঁর কাছে। তবে মনের মধ্যে অদম্য জেদ নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন তিনি। যখন সব কিছু ধীরে ধীরে ঠিক হতে শুরু করেছিল, তখন বাঁধ সাধল করোনা। সন্তানকে নিয়ে একা হাতে বাজার করা থেকে রান্না, ছোট্ট একটি ঘরে থেকেও লড়ে গিয়েছেন সুতপা। তবু হাল ছাড়েন নি। ছোটবেলার মা-ঠাকুমার হাতে তৈরি রান্নাগুলোকে একের পর এক হাজির করেছেন তিনি। গ্রাহকদের উপহার দিয়েছেন নস্টালজিয়ার স্বাদ।

কেন হিমুর হেঁশেল? উত্তরে সুতপা বলেন, “বাংলাদেশ থেকে আসার ফলে বাংলাদেশের রান্নাগুলো খুব মিস করতাম। সেই রান্নাগুলো এখানে এসে পেতাম না। কারোর বাড়িতে গেলে যে ভাবে আপ্যায়ন করা হত, দেখে মনে হত, আমাদের দেশে যে ভাবে আপ্যায়ন করা হয়, সেই ভাবে যদি করতে পারতাম। নিজের সংসারে সেই ভাবেই চেষ্টা করেছিলাম। এক হিতাকাঙ্খী আমায় বলেছিলেন যে, তুই ব্যবসা কর। আমি বলেছিলাম, ভাল রান্না করতে পারি বলেই কি ব্যবসা করতে পারব? উনি বললেন, হ্যাঁ তুই পারবি। ব্যাস, সেই শুরু। হিমুর হেঁশেল নামটি তাঁরই দেওয়া।” 

এর পরেই বাংলাদেশের রান্না দিয়ে পথ চলা শুরু হয় হিমুর হেঁশেলের। রেস্তরাঁর মেনুতেও ছিল চমক। ২০১৯ সালে ফের যখন হিমুর হেঁশেল শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের রান্নাই ছিল মেনুতে। তবে এই দেশের রান্নার কথাও ভোলেননি সুতপা। এই বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি সেই সময় এই দেশের রান্নায় অতটা পারদর্শী ছিলাম না। অনেকে আমায় অনেক কথা বলেছিল। আমি যখন জি বাংলার রান্নাঘরে অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম, তখন সেই ধারণা বদলে গিয়েছিল তাদের। হিমুর হেঁশেলে আমি পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে এক করে দিতে পেরেছি।”

Himur-Heshel-Special-Dishes-min

Himur Heshel Special Dishes

কথায় আছে ভাল খাবার না পরিবেশন করতে পারলে, বাঙালির মন জয় করা খুব মুশকিল। তাই প্রথম থেকেই সুতপা বুঝতে পেরেছিলেন, কলকাতার মানুষের কাছে কী ভাবে বাংলাদেশের রান্নাগুলোকে পরিবেশন করা যায়। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের রান্না ও হারিয়ে যাওয়া পদ সকলের কাছে তুলে ধরার ইচ্ছেটা তাঁর বরাবরই ছিল। সুতপা বলেন, “কলকাতায় বসবাসকারী ওপার বাংলার অনেকেরই ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে বা অন্য কোনও কারণে বাংলাদেশী পদগুলি খাওয়া হয়ে ওঠে না। আমার লক্ষ্য ছিল সেই সমস্ত রান্না তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই ভাবেই আমি শুরু করি আমার যাত্রা।”

বাংলাদেশের বিশেষ জনপ্রিয় রান্না কালাভুনা, মেজয়ানি ভুনা, মোরগ পোলাও। এই খাবারগুলিতে পরিবারের প্রশংসা পাওয়ার পরে সেগুলি প্লেটিং করা, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, শুটকি মাছ, ইত্যাদি পদ দিয়েই ধীরে ধীরে শুরু হয় হেঁশেলের যাত্রা। প্রাথমিক স্তরে মানুষকে বোঝানো সত্যিই খুব কঠিন ছিল। করোনার সময় যখন ক্লাউড কিচেনও মুখ থুবড়ে পড়ল, তখনই সুপারভাইজারের কথা মতো রেস্তরাঁ খোলেন সুতপা। মাত্র ৩টি টেবিল-চেয়ার কিনে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় রেস্তরাঁর যাত্রা।

Himur-Heshel-Dishes-min

Himur Heshel Dishes

পদগুলি এতটাই সুস্বাদু এবং অনন্য ছিল যে খুব কম সময়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করে হিমুর হেঁশেল। ধীরে ধীরে লোক বাড়তে থাকে। সুতপা সাধ্য মতো বাড়িয়ে নেন টেবিলের সংখ্যাও। বিভিন্ন ফুড ভ্লগারও ভিড় জমাতে শুরু করে রেস্তরাঁয়। একটা সময় মানুষের ভিড় এতটাই বাড়তে থাকে যে ওই ছোট রেস্তরাঁয় সমস্যা হতে থাকে। সুতপা সিদ্ধান্ত নেন বড় করে রেস্তরাঁ খোলার। ২০২২ সালের পয়লা বৈশাখ অন্য বাড়িতে আরও বড় জায়গা নিয়ে ফের শুরু হয় রেস্তরাঁর যাত্রা। ৩টে টেবিল চেয়ার থেকে বেড়ে বর্তমানে তা ১৭টি টেবিল-চেয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। সুতপা বলেন, “লোকে আসছে। ভাল বলছে। আমি চাইছিলাম কলকাতার মানুষের কাছে বাংলাদেশের পুরনো রান্নার স্বাদটুকু পৌঁছে দেব। সেটা করতে আমি কিছুটা সক্ষম হয়েছি।”

হিমুর হেঁশেলের প্রতিটি পদেই রয়েছে বাংলা ও বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। বর্তমানে এখানকার সিগনেচার ডিশগুলি হল— চিজ পকোড়া, ঢাকাই চিকেন পকোড়া, ডাবের শাসের গন্ধরাজ চিংড়ি, চিলি ভেটকি পাতুরি ইত্যাদি। এই রান্নাগুলি একান্তই হিমুর হেঁশেলের নিজের। এই রেসিপিগুলি নিজেই বানিয়েছেন সুতপা। 

বর্তমানে খাদ্যরসিকদের কাছে বিশেষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে হিমুর হেঁশেলের নাম। পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কারও। তবে সুতপা মনে করেন এই তো সবে শুরু। পথ চলা এখনও আরও বাকি। তাঁর গল্প সত্যিই এ যুগের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা।