Subhash Bhowmick: প্লেয়ারদের মতো, ডার্বির আগে সমর্থকদেরও তাতিয়ে দিতেন বাবা
যাঁকে বাদ দিয়ে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ম্যাচ কল্পনাই করা যায় না। কোচ না হলে বিশেষজ্ঞর ভূমিকায় ঠিক দেখা গিয়েছে তাঁকে। এই প্রথম কোনও ডার্বি ম্যাচে থাকবেন না সুভাষ ভৌমিক। কোচ সুভাষের ডার্বি-সাফল্যও কম নয়। ডার্বির আগে কীভাবে টিমকে তৈরি করতেন সুভাষ? টিভি নাইনের জন্য কলম ধরলেন তাঁর ছেলে।
অর্জুন ভৌমিক
খুব কষ্টের একটা সন্ধে অপেক্ষা করে রয়েছে আমার জন্য। সেই সোফাটা থাকবে। সেই টিভি সেটটাও। রিমোট হাতে পাশে বসে থাকা লোকটাকে পাব না। সুভাষ ভৌমিক (Subhash Bhowmick), মানে বাবাকে ছাড়া এই প্রথম কোনও ডার্বি (Derby) ম্যাচ একা দেখব আমি। যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, বুঝতে শিখেছি, কিছু বুঝি না বুঝি ডার্বির মহিমা বুঝতে শুরু করে দিয়েছিলাম। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল বাবার জন্য়ই। ইস্টবেঙ্গল না হলে মোহনবাগান, কোনও একটা টিমের কোচ যদি কারও বাবা হয়, তা হলে তাঁর ছেলে এগুলোতে অভ্যস্ত হবেই! ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে যখন-তখন প্লেয়ারদের আসতে দেখতাম। কেউ কেউ থেকেও যেত। তাদের কেউ কেউ আবার আমারই মতো বাবা বলেও ডাকে! এ এক আশ্চর্যের ব্যাপার। ভালো লাগারও। সেই ভালো লাগার টানেই আমি মাঠে ছুটতাম। ডার্বির প্রতি সেই আবেগটা কোনও অংশে কমেনি।
বাবাকে নিয়ে লিখতে বসলে শেষ হবে না। ডার্বি ঘিরে বাবাকে আমি দু’রকম ভাবে পেয়েছি। কোচ সুভাষ ভৌমিক। অ্যানালিস্ট সুভাষ ভৌমিক। কোচিং থেকে দূরে থাকলে কোনও না কোনও কাগজে লিখতেন। তখন আমরা দু’জন মিলে ম্যাচ নিয়ে অ্যানালিসিস করেছি। কোন টিমের কতটা গভীরতা, কতটা সম্ভাবনা, কে জিততে পারে— এ সব নিয়েও বাজি ধরেছি। অনেক সময় বাবা জিতেছে। অনেক সময় আমি। কোন কোচ, কোথায় এগিয়ে, প্লাস পয়েন্ট কী তাঁর, এ সব নিয়েও আলোচনা করতাম আমরা। এ সব কিন্তু ওই ম্যাচ পর্যন্ত। ম্যাচের পর সব ঠান্ডা। আসলে প্রাক্তন ফুটবলার কিংবা প্রাক্তন কোচ সুভাষ ভৌমিক বরাবরই এমন মানুষ। পেশাদারি মনোভাব থেকেই সামলাতেন মাঠের যে কোনও গল্প।
কোচ সুভাষ ভৌমিক কেমন? এই প্রশ্নের মুখোমুখি সেই ছেলেবেলা থেকে হচ্ছি। আমার বন্ধুরা বারবার জিজ্ঞেস করত। পরে মাঠের লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশি, সাংবাদিকরা— সবাই এটা জিজ্ঞেস করেছেন। কোনও দিনই খুব বেশি খুলে বলতে পারিনি। প্রচারমাধ্যমের কাছে তো নয়ই। কোচ হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদে কিছু জিনিস এখনও চোখে ভাসছে। ঠিক আগের ম্যাচ খেলার পর মুহূর্ত থেকে বাবা ডার্বির ভাবনায় ঢুকে পড়ত। উল্টো দিকের টিম কী ভাবছে, কী ভাবতে পারে, কী ভাবে খেলবে, কোন প্লেয়ারকে আটকাতে হবে? মোহনবাগান হলে ব্যারেটো জন্য গেমপ্ল্যান কী থাকবে, নিজের টিম কী ভাবে গোছাবেন— এ সব শুরু হয়ে যেত। একটা জিনিস বাবা সব সময় করতেন, প্লেয়াররা যাতে ডার্বিকে একটা রেগুলার ম্যাচ ভেবেই খেলতে নামে। যাতে চাপটা কোনও ভাবেই না ওদের উপর গিয়ে না পড়ে। বলতেনও, তোরা রেজাল্টের চাপ নিস না। হার হলে আমার দায়। টিমকে জিতলে তোদের কৃতিত্ব। এতেই শেষ হত না। টিমে যদি কোনও বাচ্চা প্লেয়ার থাকত, যদি কেউ প্রথম বড় ম্যাচ খেলতে নামত, ভিন রাজ্যের কিংবা কোনও বিদেশি যদি প্রথম ডার্বি খেলতে নামত, তাকে বোঝাতেন, ডার্বিটা কী মাহাত্ম।
বাবার কোচিংয়ের সময় থেকেই ময়দান পাল্টাতে শুরু করেছিল। তখন আর কোচেরা গরম গরম কথা বলত না। অমল দত্ত, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই করত না। আসলে ডার্বির সঙ্গে সঙ্গে ট্রফির ভাবনাতেও আচ্ছন্ন থাকতেন বাবা কিংবা বাবার প্রজন্মের কোচেরা। একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ছে। সে বার বাবার উল্টো দিকে করিম বেঞ্চারিফা। মাঝ মরসুমে ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিলেন বাবা। তার আগে মোহনবাগানের কাছে পর পর তিনটে ম্যাচ হেরেছে বাবা। সব উল্টে দিয়ে ম্যাচটা ৩-০ জেতে ইস্টবেঙ্গল। নবি হেডে দুটো গোল করেছিল। সুনীল একটা। প্লেয়ার থেকে শুরু করে সমর্থকদের কী ভাবে তাতাতে হয়, বাবা ঠিক জানতেন। ডার্বি শুরুর আগে বাবা একটা দারুণ কাজ করেছিলেন। ঝিমিয়ে পড়া সমর্থকদের তাতিয়ে দিয়েছিলেন। বাকিটা তো গল্পকথা হয়ে রয়ে গিয়েছে।
একটা জিনিস বলতে পারি, বাইরে থেকে যতটা কুল দেখাত বাবাকে, ভিতরে ভিতরে কিন্তু মোটেও তা থাকতেন না। ওই রকম একটা ম্যাচ ঘিরে কেউ থাকতেও পারে না। নিজে প্লেয়ার ছিলেন। অসংখ্য বড় ম্যাচ খেলেছেন। ফলে বাবাও তেতে থাকতেন। বাবার হাতে সব সময় কিছু তারকা প্লেয়ার থাকত। কখনও বাইচুং, আলভিটো, কখনও ডগলাস, মাইক ওকোরো। ওরা বড় ম্যাচটা ভালো খেলত। ডার্বির চাপটাকে মোটিভেশনে বদলে ফেলতে পারত। এই রকম তারকা প্লেয়ারদেরকে আবার বাবা আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিয়ে দিতেন। কাউকে দায়িত্ব দিতেন প্লেয়ারদের তাতানোর জন্য। কোনও প্লেয়ারকে হয়তো একটা বিশেষ ভূমিকায় খেলাতে চাইছেন, সিনিয়র প্লেয়াররা তাকে বুঝিয়ে দিত, কী করতে হবে। আর একটা জিনিস বাবা ভীষণ করতেন। ম্যাচটাকে কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। বড় জিততে হবে বলে তিনটে পয়েন্ট খোয়ানোর কথা কখনওই ভাবতেন না।
২০০৪ সালের কলকাতা লিগে বাবা পর পর দুটো ডার্বি ম্যাচ হারলেন অমল দত্তের কাছে। কোচিং কেরিয়ারে টানা দুটো ডার্বি বাবা কখনও হারেননি। ২০০৫ সালে আইএফএ শিল্ডে অমলবাবুর মোহনবাগানকেই ৪-১ গোলে হারিয়েছিলেন বাবা। টিম হায়াতে ছিল। যুবভারতী থেকে হায়াত মেরেকেটে ১৫ মিনিটের রাস্তা। ওই রাস্তাটা পেরিয়ে যুবভারতী থেকে হায়াতে পৌঁছতে তিন ঘণ্টা সময় লেগে গিয়েছিল।