Water Crisis In India: জনপ্রতি জলের জোগান কমছে টানা 75 বছর ধরে, কতটা ভয়াবহ ভারতের জলচিত্র?

Latest Science News: বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এখনই যদি জলের অপচয় বন্ধ না করা হয়, তাহলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। জলের অপচয় রোধ করার জন্য প্রতি বছর 22 মার্চ বিশ্ব জল দিবস পালিত হয়।

Water Crisis In India: জনপ্রতি জলের জোগান কমছে টানা 75 বছর ধরে, কতটা ভয়াবহ ভারতের জলচিত্র?
Follow Us:
| Updated on: Nov 26, 2023 | 11:00 AM

অন্বেষা বিশ্বাস

“নাঃ — একটু জল না পেলে আর চলছে না। সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখন‌ও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকি। তেষ্টায় মগজের ঘিলু শুকিয়ে উঠল। কিন্তু জল চাই কার কাছে?” সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’-এর শুরতে এভাবেই ‘ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ’, যার ‘পিঠে লাঠির আগায় লোট-বাঁধা পুঁটলি, উস্কোখুস্কো চুল্, শ্রান্ত চেহারা’। আর এরপরই ‘ঝুড়ি মাথায় এক ব্যক্তির প্রবেশ’-এর পর তাঁর উদ্দেশে পথিকের সেই অমোঘ প্রশ্ন: ‘একটু জল পাই কোথায়?’

এই জলই অনেকদিন ধরে দুশ্চিন্তার কারণ, কারণ তথ্য বলছে, 1947 সাল থেকে মাথাপিছু একজন মানুষের যত পরিমাণ জল লাগে, তার পরিমাণ প্রায় 75 শতাংশ কমে গিয়েছে। অর্থাৎ সহজ কথায় বলতে গেলে মানুষের ব্যবহার্য জলের পরিমাণ ক্রমেই কমছে। অনেকেই হয়তো জানেন না, এই পৃথিবীর মোট জলের 97 শতাংশ লবণাক্ত এবং পানের যোগ্য নয়। আর 2 শতাংশ তুষার হয়ে জমাট বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। মাত্র 1 শতাংশ জল সারা পৃথিবীর মানুষ নানাভাবে ব্যবহার করে। এবার কী মনে হচ্ছে? জল শেষ হতে পারে না? ভয়াবহ দিন আসছে সামনে। ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’-এর রিপোর্ট বলছে, 1986 সালে কলকাতা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত এলাকায় গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল 232টি এবং হাতপাম্প-যুক্ত অগভীর নলকূপ ছিল 5,000টি। গভীর আর পাম্প-যুক্ত অগভীর নলকূপ—দু’ ধরনের নলকূপের মাধ্যমে মাটির নীচ থেকে তোলা জলের পরিমাণ তখন ছিল 121.5 মিলিয়ন লিটার (দৈনিক)। 2006 সালে সেই সংখ্যা কমলেও শহর থেকে এখনও পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি নলকূপ।

‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর তরফে প্রকাশিত ‘স্টেট অব ইন্ডিয়াজ এনভায়রনমেন্ট 2019’ রিপোর্টে জলের অভাবের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। ওই রিপোর্টে 2018 সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’-এর (ডব্লুডব্লুএফ) একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে যা বলা হয়েছে, তা রীতিমতো আশঙ্কার। কী সেই কথা? ভারতের যে ক’টি শহরে পানীয় জল নিয়ে ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি হতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হল ‘সিটি অফ জয়’ কলকাতা। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন, দেখে নেওয়া যাক:

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এখনই যদি জলের অপচয় বন্ধ না করা হয়, তাহলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। জলের অপচয় রোধ করার জন্য প্রতি বছর 22 মার্চ বিশ্ব জল দিবস পালিত হয়। জলের অপচয় রোধ এবং মানুষকে এর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এই দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু শুধু সচেতন করলেই হবে না। বাস্তবায়ন খুব প্রয়োজন।

2019 সালের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী 2024 সালের মধ্যে প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারে কলের জল পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। তারপর থেকে দেশ এ ব্যাপারে অগ্রগতির হার যথেষ্ট। ভারতের 19 কোটি 40 লক্ষ গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে 114 মিলিয়নেরও বেশি (59%) পরিবারে ইতিমধ্যেই জলের কল স্থাপন দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি 2024-এ পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে একটি বড় প্রশ্ন থেকেই যায়, সব বাড়িতে নিয়মিত যতটা পরিমাণ জলের প্রয়োজন, সেই জল আদৌ পৌঁছচ্ছে কি না? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আগামী 40 বছরের মধ্যে ভারতে পানীয় জলের ভয়াবহ অভাব লক্ষ্য করা যাবে।

water crisis

ভারতের নদী ও হ্রদগুলি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে?

ভারতে নদী এবং হ্রদগুলির অবস্থা খুব শোচনীয়। ভারতে ভূগর্ভস্থ জলের মোট পরিমাণের 87% সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। আর এত বেশি পরিমাণে জলের উত্তোলন, ভূগর্ভস্থ জল হ্রাসের অন্যতম কারণ হতে পারে। প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ার ফলে সঞ্চিত জলের পরিমাণ যে হারে কমছে, তা সম-পরিমাণে পূরণ হচ্ছে না। কারণ মাটির উপরের জল নানাভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে। যেসব জলাশয়, হ্রদ বা প্রস্রবণ ভূগর্ভস্থ জল পায়, সেগুলিও ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। ভারতে সেচের কাজে 62% ভূগর্ভস্থ জলের প্রয়োজন হয়। আর তার পরিবর্তে 87% উত্তোলন করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর জল অপচয় হচ্ছে। এছাড়াও গ্রামীণ এলাকায় 85% জল সরবরাহ করা হয়। শহর এলাকায় সরবরাহ করা হয় 50% জল। আর মাটির তলার জল ভাবনাচিন্তা না করেই বেলাগাম খরচ করা হচ্ছে। আর এর প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ। এবং সেই দিন আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। কৃষিকাজে যেখানে জলের অত্যধিক প্রয়োজন নেই, যেমন ইক্ষু চাষ কিংবা কলা চাষ, সেই সব স্থানে জল ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বৃষ্টির ধরন বদলানোর ফলে এমনিতেই ভূগর্ভস্থ জলে টান পড়ছে। সেই অবস্থায় জলের এই ধরনের অপচয় ভবিষ্যতে জলসঙ্কট ডেকে আনতে পারে। যার মাসুল গুনতে হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এমনকী যেখানে গোটা দেশের মানুষ ভূগর্ভস্থ জলের উপরই নির্ভরশীল, সেখানে এই জলকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, 2024 সালের মধ্যে সরকারের ‘জল জীবন মিশন’ (Jal Jeevan Mission বা JJM)-এর অধীনে যদি ভারতের সব বাড়িতে জলের কল স্থাপন করা যায়, তবেই একমাত্র ভূগর্ভস্থ জলের দূষণ কমানো সম্ভব হবে। তবে এই মিশন সফল হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ভূগর্ভস্থ জলের দূষণ।

water 4

এ দিকে প্রতি বছরই দিল্লিতে বাড়ছে জলের চাহিদা। কেন?

দেশের রাজধানীতে প্রতিবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলসঙ্কটের সমস্যাও। বিশেষত গ্রীষ্মকালে এই সঙ্কট আরও বেড়ে যায়। দিল্লি যমুনা নদীর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নদীটি ধীরে-ধীরে খুবই খারাপ অবস্থায় চলে যাচ্ছে। দিল্লি ওয়াটার বোর্ডের মতে, দেশের রাজধানী মোট জলের চাহিদার 90 শতাংশেরও বেশি জলের জন্য প্রতিবেশী রাজ্যগুলির উপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ জল ছাড়াও গঙ্গা, যমুনা ও সিন্ধু অববাহিকা থেকে জল পাওয়া যায়। বর্তমানে রাজধানীর 93 শতাংশ বাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে জল যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য শহরের মানুষ দিল্লিতে আসায় এখানে দ্রুত জলের চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে দিল্লিবাসী ব্যাপক জলসঙ্কটের সম্মুখীন হবে।

এশিয়ায় কত শতাংশ মানুষ জলসঙ্কটের সম্মুখীন?

রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রকাশিত তথ্য বলছে, 2016 সালে পৃথিবীর 9.33 কোটি জনসংখ্যা জলসঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। এরপর অনেক দেশেই এই জলসঙ্কট দ্রুত বেড়ে যায়। এশিয়ার প্রায় 80% মানুষ জলসঙ্কটের সম্মুখীন। এই সমস্যা উত্তর-পূর্ব চিন, ভারত ও পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের জন্য পানযোগ্য বিশুদ্ধ জলটুকুও নেই। শুধু যে এসব দেশ তা-ই হয়, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশেই পানীয় জলের সমস্যা ভয়াবহ।

water 4

বিশ্বের জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই?

রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের 26 শতাংশ মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই। তবু জলের অপচয় কমছে না বিন্দুমাত্রও। উল্টে প্রতি বছর জলের ব্যবহার বাড়ছে 1 শতাংশ। এই রিপোর্ট বলছে, 2000 সালের পরবর্তী সময় থেকে বিশ্বজুড়ে বন্যার হার বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। সেই সঙ্গে একইভাবে বেড়েছে খরাও। যার বেশিরভাগটাই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে। এছাড়াও অপরিশ্রুত জলের কারণে ব্যাপকভাবে জলদূষণ ঘটছে।

আর অবহেলা নয়। সহজ কথায়, আগামী দিনে জলসঙ্কটের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধভাবে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। জল সংরক্ষণই যে আমাদের হাতিয়ার সেটা বুঝতে হবে, আর সেটা বুঝতে পারলে তবেই এই সমস্যাকে রোধ করা হবে। দাঁত থাকতে মানুষ যেমন দাঁতের মর্যাদা বোঝে না, তেমনই জল থাকতেও জলের মর্ম বুঝতে পারছে না। জীবনের সঙ্কট মেটায় যে জল, সে জলই এখন সঙ্কটাপন্ন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি কখনও বাধে, তা জমি বা দেশ দখল নিয়ে নয়, জল সম্পদের অধিকার নিয়ে বাধবে। তাই কোমর বেঁধে জল অপচয় রোধ করতে নেমে পড়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় নেই।

2019 সালের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতা পুরসভা এলাকায় দৈনিক 446 মিলিয়ন গ্যালন অর্থাৎ 202 কোটি লিটার পরিস্রুত পানীয় জল উৎপাদন হয়। উৎপাদিত জলের পরিমাণ ধরলে প্রত্যেক বাসিন্দার 450 লিটার জল পাওয়ার কথা। অথচ অপচয়ের জেরে কলকাতা পুর এলাকায় ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভ মিলিয়ে দৈনিক প্রায় 50 কোটি লিটার জল নষ্ট হয়। শতাংশের হিসেবে যা দৈনিক উৎপাদিত জলের 28-30 ভাগ। এক হাজার লিটার পরিস্রুত পানীয় জল উৎপাদন করতে চার টাকা খরচ হলে অপচয় হওয়া 50 কোটি লিটার জল তৈরি করতে তার মানে 2019 সালে খরচ হত প্রায় 20 লক্ষ টাকা। অর্থাৎ 2019 সালের বিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় 20 লক্ষ টাকার জল নষ্ট হয়েছে এ শহরে।

‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, 1986 সালে কলকাতা পুরসভার গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল 232 এবং হাতপাম্প-যুক্ত অগভীর নলকূপ ছিল 5,000। উভয় নলকূপের মাধ্যমে মাটির নীচ থেকে তোলা জলের পরিমাণ ছিল দৈনিক 121.5 মিলিয়ন লিটার। 2006 সালে সেই সংখ্যা কমলেও শহর থেকে এখনও পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি নলকূপ।