Dhupguri: ২ আষাঢ়! ছোট্ট রিয়ার ‘বার্থ ডেটে’ই আটকে তার স্কুলের দরজা
Dhupguri: মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে আসেন অনেকেই। তাঁদের অনেকের চোখ পড়ে রিয়ার ওপর। তাঁরা রিয়াকে ওইভাবে পড়তে দেখে খাতা, পেনসিল, বই কিনে দেন। অনেকে তাকে সময়ও দেন, পড়া শেখান।
ধূপগুড়ি: আষাঢ় মাসের ২ তারিখ! দুপুরবেলায় হয়েছিল। মেয়ের ‘বার্থ ডেট’ বলতে শুধু এটুকুই জানেন মা। সাল, ইংরাজি তারিখ? অক্ষর জ্ঞানহীন মহিলার গুলিয়ে যায় সব। আষাঢ় মাসের দু’তারিখ থেকে যায় তাঁর মনেই। তা আর নথিবদ্ধ হয় না শংসাপত্রে। সেই কাঁটাতেই বিঁধে রয়েছে ধূপগুড়ির ডাকবাংলো মোড়ের বছর ছয়েকের এক রত্তি ‘বড়’ হওয়ার স্বপ্ন। যখন হামা দিতেও শেখে নি, তখনই বাবা এ জগতের মায়া ত্যাগ করেছেন। আর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন নিজের তৃতীয় কন্যাসন্তানের ভবিষ্যতও! তিনি চেয়েছিলেন পুত্র সন্তান। পরপর দু’বার মেয়ের পর ঘর আলো করে এসেছিল এই ছোট্ট রিয়া। এবারও মেয়ে! নেশার ঘোরে সেই মেয়ের জন্মের প্রমাণপত্রই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃতীয় মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট। তারপর নিজে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। আর বাবার অপকর্মের ফল ভুগে চলেছে ছোট্ট রিয়া। পড়াশোনা করে বড় হতে চায় সে। কিন্তু জন্মের শংসাপত্র না থাকায় স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। তাই তিন বছরের বড় দিদি স্কুলে গেলেও, ফুটপাতে খাতা পেনসিল নিয়ে একাই বসে থাকে রিয়া। একাই পড়ার চেষ্টা করে। আর স্বপ্ন দেখে আর পাঁচ জনের মতো দিদির হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার।
ফেরিওয়ালা দুলাল দাসের সঙ্গে প্রায় দুই দশক আগে বিয়ে হয়েছিল শহরের বাস টার্মিনাস পাড়ার বাসিন্দা শোভার। আগাগোড়া নেশায় আসক্ত ছিলেন দুলাল। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই রোগ ভোগের পর মারা যান, তাও বছর সাতেক হল। তখন ছোট মেয়ের বয়স মাত্র মাস ছয়েক। তিন মেয়ের মধ্যে বড় জনকে নাবালিকা অবস্থাতেই বিয়ে দিয়ে দেন মা। মেজো মেয়ে রিমা শহরের ধূপগুড়ি বিএফপি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ভোর বেলা মায়ের সঙ্গে বেড়িয়ে স্কুলে যায় সে। সেখানে মিড ডে মিল খেয়ে ছুটির পর পথের পাশে দোকান সাজিয়ে বসে দু’পয়সা আয়ের আশায়। দিদির স্কুল থেকে না ফেরা পর্যন্ত ধূপগুড়ি শহরের ডাকবাংলো মোড়ে একাই বসে থাকে ছোট্ট রিয়া।
রিয়ার দুপুরের খাবার বলতে চায়ের দোকান থেকে দেওয়া বিস্কুট কিংবা রুটি। অপেক্ষা করে দিদির। দিদির মিড ডে মিলের ভাগ থেকে কিছু নিয়ে ফিরলে, সেটা দিয়েই এক বেলা চলে ছোট্ট মেয়েটার। মাঝে মা এসে কিছু খাইয়ে দিয়ে যান। দিদি ফেরে, তারপর রাস্তার ধারে বসে কাচা সুপারি ও পান বিক্রি করে। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে রাস্তার পাশে এভাবে বসে থাকতে দেখে পুরনো বই খাতার দোকানের কারবারিরা কয়েকটা বই দিয়ে যান। সে নিয়েই নাড়াচাড়া করে রিয়া। তারপর দিদি ফিরলে পান-সুপারি বেঁচে।
মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে আসেন অনেকেই। তাঁদের অনেকের চোখ পড়ে রিয়ার ওপর। তাঁরা রিয়াকে ওইভাবে পড়তে দেখে খাতা, পেনসিল, বই কিনে দেন। অনেকে তাকে সময়ও দেন, পড়া শেখান। তাঁদেরই একজন স্থানীয় সুকান্ত মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজল দে। তিনি বলেন, “প্রায়ই মোড়ে চা খেতে যাওয়ার সুবাদে দেখি বাচ্চা মেয়েটা বই নিয়ে পথে বা চায়ের দোকানের কোণায় বসে পড়ছে। খুব খারাপ লাগে দেখতে। একটা খাতা ও পেনসিল কিনে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে দেখিয়েও দিই। অভিভাবকদের অবশ্য সেভাবে কোনও দিনও দেখিনি।”
পান-সুপারির দোকান থেকে দিনে মেরেকেটে পঞ্চাশ টাকা আয় হয়ে যায়। সন্ধ্যায় দুই মেয়েকে নিয়ে এক কামরার ঘরে ফেরেন মা। ভাতের হাঁড়ি চড়ান। পরের দিনের সকালের অপেক্ষায় থাকে তিন জন। আবারও সেই গঁতে বাঁধা জীবন। দিদির স্কুল ড্রেস, স্কুলের পথের দিকে চেয়ে বসে থাকা রিয়া।
রিয়ার মা অবশ্য চেষ্টার কোনও খামতি রাখেননি। ছোটো মেয়েকেও স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে শংসাপত্র। সেই ফেঁসে সব! ক্লাসরুমে আর জায়গা হল না রিয়ার। জায়গা তার রাস্তার চায়ের দোকানের কোণাতেই। রিয়ার মা শোভা বলেন, “আষাঢ় মাসের দুই তারিখ ওর জন্ম, এটুকু মনে আছে। তবে ওর বাবা রাগের বশে সব কাগজ ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। বহু জায়গায় ঘুরেছি, তবে সমাধান কিছুই পাইনি। স্কুলের স্যররাও খাতায় নাম না থাকলে সমস্যার কথা বলেন কিন্তু আমাদের তো করার কিছুই নেই।”
ছটফটে ছোট্ট রিয়া এত কথার মারপ্যাঁচ বোঝে না। শুধু বোঝে স্কুলে যাওয়া বারণ আছে তার, কারণ স্যর তার নাম ডাকেন না। তাকে স্কুলের বই, পোশাক, খাবার দেওয়ারও নিয়ম নেই। তাই শৈশব ক্লাসরুমের বদলে কাটছে রাস্তার কোণাতেই।
রিয়ার দিদি রিমা, তারও বয়স মেরেকেটে দশ। আধো গলায় সেও বলল, “বোনু তো আমার সঙ্গেই স্কুলে যেতে চেয়েছিল, আমার সঙ্গে পড়বে বলে। কিন্তু স্কুলের মাস্টার মশাই তাড়িয়ে দিয়েছে। বলছে স্কুলে আসতে পারবে না।”
স্কুল সম্পাদক অথা ভার প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত মজুমদার বলেন, “বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। তবে ভর্তির সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। জন্ম সার্টিফিকেট নেই তার জন্য পড়াশোনা আটকে থাকবে, এটা হতে পারে না। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আগামীতে তার ভর্তির ব্যবস্থা করব। তবে এখন থেকে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারবে ভর্তি না হলেও তার ব্যবস্থা করা হবে।”
স্কুল পরিদর্শক তাপস দাস বলেন, “বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর নিচ্ছি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”