মোদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, গুজরাটে বেড়ে ওঠা- বিজেপি যোগের আতসকাচে ‘বেসুরো’ দীনেশ

অত্যন্ত নাটকীয়ভাবেই রাজ্যসভার সদস্যপদ ছাড়লেন দীনেশ আর বললেন, 'সবাইকেই কখনও না কখনও মনের কথা শুনতে হয়।'

মোদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, গুজরাটে বেড়ে ওঠা- বিজেপি যোগের আতসকাচে 'বেসুরো' দীনেশ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Feb 12, 2021 | 6:28 PM

কলকাতা: নাটকীয়ভাবেই শুরুটা হয়েছিল। দলের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আচমকাই রাজ্যসভায় বলতে শুরু করেছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী তাঁর কথায় পরতে পরতে প্রকাশ পেয়েছে অচেনা সুর। যা ইতিমধ্যেই দলত্যাগীদের গলায় শোনা গিয়েছিল। তিনিও বললেন ‘দমবন্ধ হয়ে আসছে। দলে থেকে কাজ করতে পারছি না। রাজ্যে প্রচুর হিংসার ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কিছু করতে পারছি না।’ অত্যন্ত নাটকীয়ভাবেই রাজ্যসভার সদস্যপদ ছাড়লেন দীনেশ, আর বললেন, ‘সবাইকেই কখনও না কখনও মনের কথা শুনতে হয়।’ সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাঁর এই ইস্তফা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তবে কি বিজেপিতে যাচ্ছেন দীনেশ ত্রিবেদী?

রাজনীতিতে দীনেশ ত্রিবেদী বরবারই স্বল্পভাষী। তাঁর একদা সতীর্থ বারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংয়ের মতো উচ্চকিত না হলেও, পরিশীলিত সুবক্তা দীনেশ ত্রিবেদী। তাই তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু তিনিও  ‘বেসুরো’ হয়ে উঠেছেন এ ক’দিনে, প্রকাশ্যে আসেনি। রাজ্যসভায় এ দিন তাঁর ভূমিকা ছিল একেবারেই আকস্মিক। অনেকের মতে, তৃণমূলও তা অনুমান করতে পারেনি।

এ দিন রাজ্যসভায় তৃণমূলের সদস্য হিসাবে সাংসদ আবির বিশ্বাস ও সুখেন্দুশেখর রায়ের বলা নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়ে যায়। তারপর দুপুরে খাওয়ার সময়ে বেরিয়ে যান তাঁরা। ঠিক সেইসময়ই ভবনে ঢোকেন দীনেশ ত্রিবেদী। ডেপুটি চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে বলতে শুরু করেন তিনি। বরাদ্দ সময়ের শেষে দীনেশের বক্তৃতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

প্রথমত: কীভাবে তৃণমূলের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বলতে শুরু করলেন দীনেশ ত্রিবেদী?

দ্বিতীয়ত, আবির, সুখেন্দুশেখর যখন ভবনে উপস্থিত ছিলেন না, তখনই ক্ষোভ উগরে দেন দীনেশ ত্রিবেদী। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে সামগ্রিক পটভূমিটা কি আগেই তৈরি করা ছিল?

তবে এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, হয়তো এমনটা নাও হতে পারে। দলের নির্ধারিত সময়ের বাইরেই দীনেশ ত্রিবেদী বলেছেন ঠিকই। সে ক্ষেত্রে ডেপুটি চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়েছেন। ডেপুটি চেয়ারম্যান যদি মনে করেন, কেউ কোনও বিষয় উত্থাপন করতে চাইছেন, তাহলে তাঁকে বলতে দেন তিনি। এটি পূর্ব নির্ধারিত নাও হতে পারে।

নাটকীয় এই ঘটনার পরই সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, “তৃণমূল মানে গ্রাসরুট। আমাদের গ্রাসরুট থেকে আরেক জনকে রাজ্যসভায় পাঠানোর সুযোগ হয়ে গেল।”

সাম্প্রতিক রাজনীতির ‘ভার্টিক্যাল ট্রেন্ডিং’ জার্সিবদল। প্রশ্ন উঠছে তবে কি বিজেপিতে যাচ্ছেন দীনেশ ত্রিবেদী? রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তাতে অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই। তাঁর গোটা দু’মিনিটের বক্তৃতায় চারটি পয়েন্ট মূলত উঠে এসেছে। সেখানে বিজেপি-যোগের ইঙ্গিত রয়েছে।

এক. বিবেকানন্দের বাণী উদ্ধৃত করে দীনেশ বলেন, ‘জাগো ওঠো, চলতে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত না গোলে পৌঁছচ্ছো।’ প্রশ্নটা হচ্ছে দীনেশ ত্রিবেদীর গোলটা কি তবে বিজেপি?

দুই. ‘আমার রাজ্যের সর্বত্র হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। অথচ আমরা কিছু বলতে পারছি না।’ দলের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ উগরে দিলেন তিনি।

তিন. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব নিয়ে একাধিক প্রশংসা ধরা পড়ল তাঁর গলায়।

চার. অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে তিনি ২০১২ সালের সেই রেল বাজেটে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। সে সময় রেলমন্ত্রী ছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী। উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রেল বাজেটের প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, সময়ের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাজেট। কিন্তু চরম বিরোধিতা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে রেলমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পদত্যাগ করতে চাননি ত্রিবেদী। কিন্তু বাধ্য হয়েছিলেন।

পরে অবশ্য লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০২০ সালে দীনেশ ত্রিবেদীকে রাজ্যসভার সাংসদ করে পাঠাল তৃণমূল। কিন্তু এরই মাঝে পাটিগণিতের অঙ্ক হয়তো বদলে গিয়েছে। দীনেশকে দলে স্বাগত জানিয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব।

বারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং লেন, “দীনেশ দা বিজেপিতে এলে সব থেকে বেশি খুশি আমিই হব। আমি ওঁকে আগেই অভিনন্দন জানিয়ে দিয়েছি। ওঁ আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করব। বাংলায় মানুষকেই গলা টিপে রাখা হয়েছে। এখানে বাক স্বাধীনতা নেই।” দীনেশকে স্বাগত জানিয়েছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়ও। তবে কটাক্ষের সুরে বাম পরিষদীয় নেতা তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, “আমার করুণা হচ্ছে। দীনেশ ত্রিবেদী ওপর করুণা হচ্ছে। ওঁ যাঁদের ভরসা করে চলেছেন তাঁদের ওপরেও করুণা হচ্ছে। দম বন্ধ হওয়ার মতো মনোভাব নিয়ে চললে এ দলেও হবে ও দলেও হবে।”

আরও পড়ুন: পদ্ম-প্রাপ্তির জল্পনা বাড়িয়ে শাহ-নাড্ডা সাক্ষাতে দীনেশ! দিল্লি যাচ্ছেন দিব্যেন্দুও

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শাসক-বিরোধীর মধ্যেও জল্পনা তৈরি হয়েছে, দীনেশ বোধহয় বিজেপিতেই যাচ্ছেন। তাতে আরও ধোঁয়া দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীনেশ ত্রিবেদীর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও গুজরাট যোগ। দীনেশের পরিবার পাকিস্তান থেকে আসার পর প্রথমে গুজরাটে কচ্ছ এলাকাতেই থাকতেন। জন্মসূত্রে কচ্ছের বাসিন্দা দীনেশ ত্রিবেদী। কচ্ছের বিদ্রা গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পরে কলকাতায় আসেন তিনি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই কচ্ছে যান। ফলে, দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে গুজরাটের সঙ্গে দীনেশের আত্মার টান সূত্রও ফেলতে নারাজ রাজনীতির কুশীলবরা।

এসবের উর্ধ্বে এক ঝলকে দীনেশের রাজনৈতিক কেরিয়ার

আশির দশকে কংগ্রেসে যোগ দেন দীনেশ। এরপর কংগ্রেস ছেড়ে জনতা দলে যোগ দেন দীনেশ। ১৯৯০-৯৬ জনতা দলের সাংসদ ছিলেন। ১৯৯৮-এ তৃণমূলে নাম লেখান দীনেশ। দীনেশ তৃণমূলের প্রথম মহাসচিব। ২০০২-২০০৮ তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ দীনেশ। ২০০৯ সালে বারাকপুর থেকে লোকসভায় জেতেন। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হন দীনেশ। ২০১১ সালে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ওই বছরই রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়তে হয়। ২০২০ সালে তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায়। আজ নাটকীয়ভাবে ইস্তফা দীনেশের।