বিশ্লেষণ: আজও অথৈ জলে! ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ কী? কেন? রাজনৈতিক তাৎপর্য কোথায়?
Ghatal Master Plan: কী এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান? এই পরিকল্পনার শুরু কোথায়? কোথায় দাঁড়িয়ে প্রকল্প?
ফি বছর বর্ষা এলেই সংবাদ শিরোনামে ভেসে ওঠে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। ধসে যাওয়া একের পর এক বাড়ি, জলে তলিয়ে যাওয়া আপনজন, গবাদী পশুকে নিয়ে পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেওয়া ঘাটালবাসী শোনেন আবারও ভরসার বাণী। তার পর বর্ষা শেষ, আলোচনাও কোথাও যেন হারিয়ে যায়! গত ৩৯ বছর এভাবেই বর্ষায় ঘুরে ফিরে আসে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। কিন্তু কী এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান? এই পরিকল্পনার শুরু কোথায়? কোথায় দাঁড়িয়ে প্রকল্প?
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কী?
ফি বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকা। শিলাবতী, ঝুমি ও কংসাবতী নদীর জল বাড়লে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে থাকে। রূপনারায়ণ দিয়ে সেই জল বেরিয়ে গেলে সমস্যা কাটে। কিন্তু, তা না হওয়ায় এলাকাবাসী দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন। জলের তলায় চলে যায় রাস্তাঘাট। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ত্রাণ শিবির, প্রতিবেশীর পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন মানুষ। নৌকায় করে চলে যাতায়াত।
তার মধ্যে রাত-বিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তো আরেক সমস্যা। সেইসময় কার্যত অসহায় হয়ে পড়েন এলাকাবাসী। শুধু কি তাই ! জল নামলেও শুরু হয় অন্য আতঙ্কে। বিষধর সাপের আনাগোনা বাড়ে। এর পাশাপাশি এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার প্রভাব কেবল পশ্চিম মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও তার প্রভাব পড়ে। সেখান থেকেই ৩৯ বছর আগে তৈরি হয়েছিল ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের পরিকল্পনা। যার বাস্তবায়ন এখনও প্রত্যক্ষ করতে পারল না ঘাটালবাসী।
পাঁচের দশক, ঘাটালবাসী শুনলেন মাস্টার প্ল্যান আসছে…
সে বছরও ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা এমনই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যে সংসদেও ওঠে ঘাটালের কথা। তার পর থেকে সংসদে বার বার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় ঘাটাল। পাঁচের দশকে প্রথবার সংসদে ঘাটালের বন্যার সমস্যার কথা তোলেন বাম সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী। এর পরই ঘাটালের বন্যা সমস্যা খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব গৃহিতও হয়। ঘাটালবাসী মন্ত্রীর মুখে শুনলেন তাঁদের জন্য ‘মাস্টার প্ল্যানের কথা’। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মানসিংহ কমিটি বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে। তার পর নানা কারণে থমকে যায় প্রকল্প।
তার পর ১৯৮৩ সাল। প্রায় কুড়ি বছর পর ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ প্রকল্পের শিলন্যাস করেন রাজ্যের তৎকালীন সেচ মন্ত্রী প্রভাস রায়। তবে প্ল্যানের অগ্রগতি বলতে ওই শিলন্যাস। আচমকা থমকে গেল তার কাজ। এর পর ফি বছর বছর বন্যায় ভেসে ১৯৯৩ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন ঘাটালের বাসিন্দারা। তাতেও অবশ্য কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। সেই রাজ্য ও কেন্দ্রের টানাপোড়েন এখনও জারি।
২০০৯ সালে অবশ্য প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য। ডিটেলস প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি শুরু হয়। ২০১০ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনে প্রকল্পের ডিপিআর-ও জমা পড়ে। তার পরের বছরই মাস্টার প্ল্যান সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য চেয়ে ডিপিআর ফেরত পাঠায় কেন্দ্র। ২০১৫ সালে প্রকল্প রিপোর্টে সবুজ সংকেত দেয় কেন্দ্র। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
কী আছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে?
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান মূলত ঘাটালকে ঘিরে থাকা মূল নদী এবং শাখা নদীগুলির নিয়মিত ড্রেজিং করা। যাতে সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং বন্যার হাত থেকে ঘাটাল রক্ষা পায়। বলা হয়, পাম্প হাউস তৈরির অনুমোদন চন্দ্রকোনা-ঘাটাল-দাসপুর-সহ পাশ্ববর্তী এলাকায়। নদীপথ সংস্কার করা হবে কংসাবতী ও শিলাবতীতে। স্থানীয় খালগুলিতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, খাল সংস্কার। সেই সঙ্গে ঘাটালের নদী ও খাল গুলিতে লক গেট বাসানো প্রকল্পের লক্ষ্য।
প্ল্যান আটকে যে কারণে:
দেখতে দেখতে রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসন শেষ হয়েছে। ১০ বছরের তৃণমূল সরকার কাজ করছে রাজ্যে। কিন্তু ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত হয়নি। ‘১১ সালে অবশ্য সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হন মানস ভুইঞা। কেন্দ্রীয় সরকারের গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটিও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে ছাড়পত্র-ও দেয়। প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পের বাজেট ঠিক হয়েছিল ২,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটির হস্তক্ষেপের পর সেই বাজেট কমে দাঁড়ায় ১,২৪০ কোটি টাকা। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী এই প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের বহন করার কথা ছিল। বাকি অর্থ দিতে হত রাজ্যকে। কিন্তু পরবর্তী সময় সেই নিয়ম বদলে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের উপরই প্রকল্পের পঞ্চাশ শতাংশ করে খরচের দায়ভার চাপে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান ও রাজনীতি:
এবার ঘাটালের প্লাবিত এলাকা মঙ্গলবার পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে বিষয়টি নিয়ে তিনি ফেসবুক পেজে লেখেন, “ঘাটালের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য প্রতি বছর জল যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয় এই অঞ্চলের মানুষদের। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন জরুরি। সংসদে বারবার সরব হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকার ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত করতে কোনওরকম উদ্যোগ নেয়নি। রাজ্য সরকার দুর্গতদের জন্য প্রশাসনিক সহায়তা সুনিশ্চিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমি সবাইকে অনুরোধ করব একে অপরের পাশে দাঁড়াতে।” আর বানভাসী ঘাটালে গিয়ে সাংসদ দেব বলেন, মাস্টার প্ল্যান করতে হলে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করাতে হবে।
এদিকে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, তিনি সেচমন্ত্রী থাকার সময় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের ইচ্ছার অভাব রয়েছে। বিরোধী নেতার কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী ১,২০০ কোটি টাকা ইমাম ভাতায় খরচ করতে পারেন। ৭০০ কোটি টাকা ক্লাবকে অনুদান দিতে পারেন। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য তো ১,২০০-১,৩০০ কোটি টাকা দিতে পারতেন!”
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান এখন যেখানে দাঁড়িয়ে:
মঙ্গলবার তৃণমূল সরকারের ৯ প্রতিননিধি সাক্ষাৎ করেন কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং ও নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব কুমারের সঙ্গে। সেই বৈঠক শেষে তৃণমূল খুশি। মানস ভুইঞারা জানাচ্ছেন, এবার সবুজ সংকেত মিলেছে। অপেক্ষায় বানভাসী ঘাটালের মানুষ। আরও পড়ুন: দিলীপের ‘আকাঙ্খা পূরণ’ করলেন মমতা! খেলা-মেলা ছেড়ে ফিতে কাটলেন কারখানার