‘সে দিন আমায় জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল’, নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়েই স্মৃতির পাতা উল্টোলেন মমতা

এই নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর নিয়ে পরে একাধিকবার কলম ধরেন কবীর সুমন, 'নন্দীগ্রামের কোনখানে, সভ্যতা শেষ একটানে, তবু প্রতিরোধে একটি নাম, নন্দীগ্রাম নন্দীগ্রাম।'

'সে দিন আমায় জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল', নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়েই স্মৃতির পাতা উল্টোলেন মমতা
তখনও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হননি। এভাবেই মানুষের ভিড়ে মিশে যেতেন আন্দোলনের হাত ধরে।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 18, 2021 | 7:16 PM

পূর্ব মেদিনীপুর: মাস দেড়েক মেরেকেটে। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ছাড়েননি। এক মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, নন্দীগ্রাম (Nandigram) কারও একার আন্দোলন নয়, কোনও একটি দলের আন্দোলন নয়। নাম না করলেও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিল সেদিন শুভেন্দুর নিশানা। সোমবার সেই নন্দীগ্রামে পা রেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে গেলেন, এখানকার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সঙ্গে তিনি কতটা একাত্ম। উস্কে দিলেন ২০০৭ সালের সেই রক্তাক্ত নন্দীগ্রাম আন্দোলনের স্মৃতি। একেবারে গল্পের মতো করে বলে গেলেন তেখালি ব্রিজ কিংবা নন্দীগ্রাম হাসপাতালের সামনে নির্বিচারে সেদিনের গুলি চালানোর ঘটনাক্রম। দর্শকাসনে উপস্থিত মানুষগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন সেই বিবরণী।

মমতার এদিনের সভা ছিল তেখালিতে। সেই তেখালি, যেখানে ‘টার্গেট’ হয়েছিল মমতার গাড়ি। মমতা বলেন, “আপনারা জানেন এই তেখালিতে কত ঘটনা ঘটেছে। তেখালি ব্রিজের সামনে গুলি চলল। আমার গাড়িতে দু’-তিনটে বুলেট এসে লাগল। বলছে, তোমরা ফিরে যাও। আমরা বললাম, ফিরে যাব না।”

আরও পড়ুন: আমি টাকা দিতাম, কিন্তু দুই মেদিনীপুর আমাকে দেখতে দেওয়া হতো না: মমতা

নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পটটা যে সিঙ্গুরে রচিত হয়েছিল, এদিন সে কথাই তুলে ধরে মমতার সংযোজন, “আমি একটু স্মরণ করিয়ে দিই, অনেকে বড় বড় কথা বলে। কিন্তু সেদিন ১৪ মার্চ গুলি চলার আগে আন্দোলনটা তৈরি হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে। সিঙ্গুরের কৃষি জমি আন্দোলন হল। আমি তখন রাস্তায় বসে অনশন করছি। তাপসী মালিক, তফশিলি কন্যাকে পুড়িয়ে লক্ষ্মীপুজোর পরেরদিন অত্যাচার করে হত্যা করা হল। তারপর এখানে আন্দোলন শুরু হল, ৭ জানুয়ারি। আপনাদের নয়াচরে জমি নেওয়া যাবে না, কেমিক্যাল হাব করা যাবে না। ১৪ মার্চ গুলি চলল। আমার মনে আছে আমি ২৬ দিন অনশন করেছিলাম। কৃষি জমি দখল করা যাবে না। আমার ওই আন্দোলনের ফল স্বরূপ ভারত সরকার বাধ্য হয়েছিল বলতে কৃষি জমি জোর করে দখল করা যাবে না। আইনটাকে আমি বদলে দিয়েছিলাম।”

সে আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন নন্দীগ্রামের কৃষক থেকে ঘরের মেয়ে-বউরাও। তাই তা সফল হয় বলেও এদিন উল্লেখ করেন মমতা। সে সময় তাঁর দু’টো অপারেশন হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি কোলাঘাট এসে পৌঁছন। সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে মমতার, “ওই কোলাঘাটের সামনে এলাম, আমার গাড়ি ঘিরে ধরেছে, পেট্রোল বোমা সঙ্গে, গায়ে থুতু দিচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই গালাগালি দিচ্ছে। পেট্রোল বোমা দিয়ে আমায় জ্বালিয়ে দেবে। এইরকম একটা অবস্থায় তদানীন্তন রাজ্যপাল, আমার হয়তো বলা উচিৎ কি না আমি জানি না, কিন্তু সেদিন উনি আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, মমতাজী আপ ওয়াপস আইয়ে, আপকো মারনে কে লিয়ে সব তৈয়ার হো রহা হ্যয়। আমি বললাম, আমি তো ওয়াপাস আসার জন্য আসিনি, আমি নন্দীগ্রাম যাবই।”

আরও পড়ুন: ‘ত্যাগীরা কখনও মায়ের আঁচল ছাড়বে না’, নাম না করে শুভেন্দুকে নিশানা মমতার

তবে রাত গভীর হওয়ায় কোলাঘাটে একটি রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানেও ঢোকার মুখে বাঁশ দিয়ে তাঁদের পথ আটকানো হয়েছিল। মমতার মনে পড়ছিল, “যখন কোলাঘাটে সেই বাড়িটায় ঢুকব দেখি বড় বড় বাঁশ দিয়ে পুরো দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। যাতে ওই গেট দিয়ে আমরা ঢুকতে না পারি। বুঝুন একটা মানুষ যে লাফিয়ে ঢুকবে তার তো একটা লাগেজ আছে কীভাবে ঢুকবে। চার-পাঁচটা বাঁশ দিয়ে পুরো বন্ধ। এরপর আমরা বাঁশে উঠলাম। দোলা ছিল সঙ্গে, আরও দু’-তিনজন। বাঁশ টপকে তারপর কোলাঘাটের গেস্ট হাউসে পৌঁছলাম।”

পরদিন ফের বের হন ‘ডাকাবুকো’ সেদিনের সেই তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু বারবার রাস্তায় অবরোধের মুখে তাঁদের পড়তে হয়। সেই সময় তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন আনিসুর। সেদিনের কথা এখনও স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে ওঠে, “সারা রাস্তা অবরোধ করে বসে আছে। চালাকি, যাতে কোনও গাড়ি যেতে না পারে। আমি শেষে আমার এক সহকর্মী, তাঁকে আজও জেলে রেখে দিয়েছে অত্যাচার করে, তাঁর নাম আনিসুর, পাশকুঁড়ার ছেলে। বললাম, তুই একটা কাজ করবি, তোর স্কুটার বা বাইক আছে, বলল আছে। আমি তখন তাঁকে চিনিও না ভাল করে, বললাম বাইকটা নিয়ে চলে আয়। কী করব না করব বললাম না। এবার বাইক নিয়ে আমি আর ও বেরিয়ে পড়লাম।”

খুব বুদ্ধি করে সেদিন বিরোধীদের চোখে ধুলো দিয়ে তমলুক হাসপাতাল অবধি পৌঁছন মমতা। নিজেই সোমবার সে কথা বলছিলেন। তারপরও চণ্ডীতলায় তাঁদের আটকানো হয়। মমতার কথায়, “আবুরা জানে। রাত ১০টা, ১২টা, ২টো অবধি আটকেছে। তারপরও সব পেরিয়ে আমি কিন্তু নন্দীগ্রামে ঢুকেছিলাম। তখন কিন্তু আর কাউকে আমরা দেখতে পাইনি। আমার মনে আছে ১০-১২ দিন আবু সুপিয়ান তাহের, স্বদেশবাবুরা এই সমস্ত সামাদ, এখানকার মা-বোনেরা আন্দোলনটা করেছেন।”

যখন সূর্যোদয় হল, কালীপুজোর সময়, বাড়ির পুজোয় না গিয়ে ঠায় তৃণমূল ভবনে বসেছিলেন মমতা। বলেন, “বারবার আবু সুপিয়ান তাহেররা ফোন করছে, দিদি শুনতে পাচ্ছেন গুলির আওয়াজ, বোমার আওয়াজ। এখানে গুলি চলছে আর আমার বুকটা ধরাস ধরাস করে উঠছে।” সেসব এখন ইতিহাস হলেও দিনগুলি একইরকম টাটকা মমতার স্মৃতির পাতায়। তাই নন্দীগ্রাম আন্দোলন কে করেছে বা কারা করেছে, কোনওভাবেই তিনি কারও কাছে ‘জ্ঞান’ শুনতে নারাজ। আবারও খোঁচা সেই শুভেন্দুকেই।

“নন্দীগ্রাম হাসপাতালের সামনে গুলি চলল, টিয়ার গ্যাস ছুড়ে দিল। আরেকদিন এলাম, ওসি দেখছি ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে। সিপিএম গুলি চালাচ্ছে। কী সব অবস্থা। সেসব দিন আমরা দেখেছি। সূর্যোদয়ের পর প্রায় সাত-আটদিন প্রেসকে ঢুকতে দেয়নি। ওরে তোরা সাবধানে থাক, কী হচ্ছে জানা বারবার বলেছি। কত দুঃখের কাহিনী। আজও আমি কবীর সুমনকে বললাম, বন্ধু আজ নন্দীগ্রাম যাচ্ছি। বলল, তুমি আমার হয়ে ওদের শুভেচ্ছা জানিও। সেসময় ও একটা গান গেয়েছিল।” এই নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর নিয়ে পরে একাধিকবার কলম ধরেছিলেন কবীর সুমন, ‘নন্দীগ্রামের কোনখানে, সভ্যতা শেষ একটানে, তবু প্রতিরোধে একটি নাম, নন্দীগ্রাম নন্দীগ্রাম।’