Bangladesh: ভাষার দাবি থেকে শাহবাগ, বারবারই বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছে ছাত্র আন্দোলন
Bangladesh: তারুণ্যের এই স্পর্ধা এই আবেগের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, দেশের স্বাধীনতারও আগে থেকে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী তথা সরকার বিরোধী আন্দোলন - প্রতিটি ক্ষেত্রেই আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরাই। এক নজরে দেখে নিন সেই ইতিহাস।
ঢাকা: দেশ-কাল নির্বিশেষে বারবারই দেখা গিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে ছাত্রছাত্রীরা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যও ১৮-র স্পর্ধার কথা বলেছিলেন। আসলে ছাত্রছাত্রী তথা যুব সমাজই পথ দেখায়। কখনও কখনও তাদের ভুলও হয়। কিন্তু, তারপরও তারাই পরিবর্তন আনে। আর তারুণ্যের এই স্পর্ধা এই আবেগের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, দেশের স্বাধীনতারও আগে থেকে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী তথা সরকার বিরোধী আন্দোলন – প্রতিটি ক্ষেত্রেই আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরাই।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন
দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান বাঙালিদের মাতৃভাষার উপর নেমে এসেছিল আক্রমণ। উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পাক শাসকরা। আর তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যুব সমাজ। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল তারা। ভাষাশহিদ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন মাত্র পাঁচজন – আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। কিন্তু, এই পাঁচজনই নয়, পাক সরকারের পুলিশের নির্বিচার গুলিতে আরও বহু মানুষ শহিদ হয়েছিলেন বলে দাবি করেন বহু ভাষা আন্দোলন গবেষক। তবে, মাতৃভাষার স্বাধীনতার দাবিতে হওয়া সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন ছাত্ররাই। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক-অধ্যাপকরাও।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
বাহান্নর ভাষা আন্দোলনই ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার। শুরু হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক বাঙালি গণহত্যা। জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পুলিশকর্মীদের পাশাপাশি হত্যা করা হয় বহু ছাত্রছাত্রীকেও। ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলকে অস্বীকার করেছিল পাক সরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সেনার সহযোগিতায় এবং বহু মুক্তিযোদ্ধার আত্মবলিদানের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছিল, জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। এই অন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থানও ঘটেছিল ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়, তাঁর বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে এসেছিলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। তাঁদের কাছে বিদ্যালয়ের ছাদ সংস্কারের দাবি জানিয়েছিল ছাত্রদের একটি দল। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। মুসলিম ছাত্রলিগ, নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন, নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলিগের মতো একাধিক ছাত্র সংগঠনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল শেখ মুজিবের।
২০১৩: শাহবাগ আন্দোলন
একাত্তরের এক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ৬টি অপরাধের ৫টিই প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। বহু মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এটা মানতে পারেনি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্র সমাজ। ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন ঢাকার শাহবাগে। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে।
২০১৮: নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
এরপর ২০১৮-তেও ফের গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশের ছাত্র-যুবরা। দুই বাসের রেষারেষির জেরে বাস চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছিল দুই পড়ুয়ার। আর তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল এই আন্দোলন। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ অগস্ট পর্যন্ত চলেছিল এই আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও অবরোধ করতে চাইলেও দুর্ঘটনার পরদিন থেকেই পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করার মতো কঠোর রাস্তা নিয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলিগ ও আওয়ামি লিগ সমর্থকরাও, এমন অভিযোগ উঠেছিল। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও বাকি বিশ্বে ছাত্রছাত্রীদের উপর সরকারের এই দমনমূলক ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা হয়।
২০১৮: কোটা সংস্কার আন্দোলন
২০১৮-তেই বাংলাদেশে দানা বেঁধেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে কোটা ব্যবস্থা ছিল, তার সংস্কারের দাবি তোলে একাংশর ছাত্ররা। কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ২০১৮-র জানুয়ারি থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। লাগাতার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে সকল কোটা বাতিল করেছিল সরকার।
২০২৪: সরকার বিরোধী আন্দোলন
২০২৪ সালের জুন মাসে, ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দেয় বাংলাদেশ হাইকোর্ট। তাকে কেন্দ্র করেই প্রাথমিকভাবে শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। তবে, সরকার আরও একবার এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করে। যা থেকে এই আন্দোলন সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। আর এই আন্দোলনের জেরেই শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।