Premium on World War 3: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল বলে! ট্রাম্পের একটা চালে টুকরো টুকরো পৃথিবী, ভারত কার দিকে?
Tariff War: চিন আমেরিকার প্রতিযোগী ছিল বরাবরই। গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট হিসাবে যখন বিশ্বসেরা হয়ে উঠছে চিন, তখন ট্রাম্প তাদের ঘাড়ে শুল্কের কোপ বসিয়েছেন। তবে চিন তো ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়। তারা বলেছে,আমেরিকাকে এভাবে 'বুলি' করতে দেবে না। শেষ দেখে ছাড়বে।

“এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার”। ভালবাসার কথা জানা নেই, তবে যুদ্ধের মুডে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আবার সামরিক যুদ্ধে বিশ্বাসী নন, লড়াই করছেন স্নায়ুর। চাপ বাড়াচ্ছেন একের পর এক দেশের উপরে। সেই চাপ এমন যে হয় অন্য দেশকে আমেরিকার কাছে নতিস্বীকার করতে হবে, নাহলে সরাসরি যুদ্ধ করতে হবে। তবে এই যুদ্ধ হতে চলেছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবে, যুদ্ধের প্রভাব পড়বে মারাত্মক।
জানুয়ারি মাস থেকেই আকাশে-বাতাসে যুদ্ধ-যুদ্ধ গন্ধ। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের মতো এবার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি বা ট্যাঙ্কারের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধ হতে চলেছে অন্যরকম। এটা পেটের লড়াই। এক দেশ আরেক দেশকে ভাতে-পাতে মারতে চাইছে। শুরু হয়েছে শুল্ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বাঁধাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই যুদ্ধ এতটাই মারাত্মক হতে চলেছে যে অনেকেই বলছেন এটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে চলেছে। তবে এই যুদ্ধ বাধার আগেই বদলে যাচ্ছে বিশ্বের মানচিত্র। এই বদল মারাত্মক হতে পারে। এতদিন ধরে ইতিহাসের বইয়ে বা বাস্তবে বিভিন্ন দেশের যে সম্পর্কের সমীকরণ দেখেছে সকলে, সেই ধারণাটাই বদলে যাচ্ছে।
দুটো বিশ্বযুদ্ধ কি যথেষ্ট ছিল না?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালে। শেষ হয়েছিল ১৯১৮ সালে। ওই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইটালি ও জাপানের জোট। পরাজিত হয়েছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও ওটোম্যানরা। সেই প্রথম বিশ্ব দুই শিবিরে খণ্ডিত হয়েছিল। তবে ক্ষমতার লড়াই কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা দেখিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
১৯৩৯ সালে হিটলারের নেতৃত্বে যখন ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ডে সামরিক অভ্যুত্থান করে, সেখান থেক্ই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। একে একে প্রায় সব দেশই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ হয়। এই ৬ বছরের সংঘাতে আগের যেকোনও যুদ্ধের থেকে বেশি প্রাণহানি ঘটে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ইটের বদলে পাটকেল?
এই দুটো বিশ্বযুদ্ধ যে শিক্ষা দিয়েছিল, তাতে সকলেরই ধারণা তৈরি হয়েছিল যে আর হয়তো এমন বিশ্বযুদ্ধ হবে না। কিন্তু সেই ধারণাকেই ভেঙে দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গোটা বিশ্বকে তিনি নিজের আঙুলে নাচাতে চাইছেন। কী দিয়ে নাচাবেন? ট্যারিফ দিয়ে!
ট্রাম্পের সাফ যুক্তি, এত দিন বিভিন্ন দেশ আমেরিকার উপরে নিজেদের ইচ্ছা মতো শুল্ক বসিয়েছে। আমেরিকা তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক নিলেও, বিভিন্ন দেশ আমেরিকার থেকে অনেক বেশি শুল্ক নেয়। এবার ইটের বদলে পাটকেলে জবাব দেওয়ার সময় এসেছে। যে দেশ আমেরিকার পণ্যের উপরে যত হারে শুল্ক বসাবে, আমেরিকাও তাদের উপরে সমান হারে শুল্ক বসাবে। বন্ধু হোক বা শত্রু, সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য। বিশেষ করে তিনি নিশানা করেছেন ভারত, চিনের মতো ব্রিকসের সদস্য দেশগুলিকে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
শুল্কের চাপ মারাত্মক-
এই শুল্কের হুমকিতেই বদলে যাচ্ছে দুনিয়া। বদলাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের সমীকরণ। মেক্সিকোর সঙ্গে না হয় আমেরিকার বিবাদ আগেই ছিল। আগেরবারই ক্ষমতায় থাকাকালীন মেক্সিকোয় প্রাচীর তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন ট্রাম্প। তবে কানাডার সঙ্গে আমেরিকার ঝগড়া ছিল না। দুই দেশ একে অপরের উপরে বাণিজ্যে নির্ভরশীল। কিন্তু ট্রাম্প এসেই কানাডাকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। একটা আস্ত দেশকে আমেরিকার একটি রাজ্য বানাতে চান! কানাডা কেন এমন দাবি মানবে? বেঁকে বসতেই ট্রাম্প বসিয়ে দিয়েছেন শুল্কের বোঝা। গাড়ির যন্ত্রাংশ, ফার্টিলাইজার বা সার, ফার্মাসিউটিক্যাল, কাগজের মতো পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে আমেরিকা। ১০ শতাংশ শুল্ক শুধু এনার্জিি বা শক্তি পণ্য়ের উপরেই বসেছে।
চিনও এই শুল্কের খাঁড়া থেকে রেহাই পায়নি। বিশ্ববাজারে আমেরিকার অন্যতম প্রতিযোগী দেশ হল চিন। আগে চিনের পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক নিত আমেরিকা। এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে সেই শুল্ক দ্বিগুণ করে ২০ শতাংশ করেছে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার এত সুসম্পর্ক, সেই আমাদের দেশও ছাড় পায়নি। শীঘ্রই ভারতের উপরও শুল্ক বসতে চলেছে।
বদলে যাচ্ছে বিশ্ব শক্তি?
ট্রাম্পের একটা সিদ্ধান্ত। তাতেই বদলে যাচ্ছে বিশ্বশক্তির শিবির। ট্রাম্প ভেবেছিলেন, হয়তো ট্রারিফের হুঁশিয়ারিতে দেশগুলি তাদের পণ্যে শুল্ক কমিয়ে দেবে বা আমেরিকার কাছে মাথা নত করবে। কিন্তু ঘটছে উল্টোটাই। আমেরিকাকে পাল্টা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে চিন। কানাডা, মেক্সিকোও ট্রাম্পকে জবাব দিতে বিকল্প পথ ভাবছে বলেই জানিয়েছে।
আর শুধু তো আর আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন নয়। গ্লোবাল পাওয়ার হিসাবে পরিচিত দেশগুলিও নিজেদের মধ্যে শিবির বদলে ফেলছে। এই যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) দুই আলাদা শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, ট্রাম্প জমানায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বন্ধুত্ব তৈরি হচ্ছে। যে আমেরিকা এতদিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন করেছে এবং আর্থিক-সামরিক সাহায্য করেছে, সেখানেই ট্রাম্প এসে আর্থিক অনুদানই বন্ধ করে দিয়েছেন।
চিন আমেরিকার প্রতিযোগী ছিল বরাবরই। গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট হিসাবে যখন বিশ্বসেরা হয়ে উঠছে চিন, তখন ট্রাম্প তাদের ঘাড়ে শুল্কের কোপ বসিয়েছেন। তবে চিন তো ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়। তারা বলেছে,আমেরিকাকে এভাবে ‘বুলি’ করতে দেবে না। শেষ দেখে ছাড়বে।
সোজা আমেরিকাকে পাতে মারার ছক কষেছে জিনপিংয়ের দেশ। সয়াবিন, গম, মাংস ও তুলোয় চ়ড়া শুল্ক বসাল চিন। আমেরিকার উপরে মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি শুল্ক বসাতে চলেছে বেজিং। আমেরিকার তিনটি ফার্ম থেকে সয়াবিন আমদানির লাইসেন্সও বাতিল করে দিয়েছে। পাশাপাশি আমেরিকা থেকে কাঠ আমদানিও বন্ধ করে দিয়েছে শুল্ক বসানোর পরই।
আবার চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অম্ল-মধুর। সেই ১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধ থেকে সম্পর্কের অবনতি। যে ভারতের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চাইত চিন, সেই দেশেরই বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই এখন হাতি আর ড্রাগনের নাচ দেখতে চান। তিনি বলেছেন যে বিগত কয়েক বছরে ভারত-চিনের সম্পর্ক অনেক শুধরেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে নয়, একসঙ্গে পাওয়ার পলিটিক্সের বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিক দুই দেশ, এমনটাই চাইছে চিন।
চিনের সঙ্গে সম্পর্ক কেন জরুরি?
গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে চিনের একাধিপত্য নজর এড়ানো যায় না। উৎপাদনে সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছে চিন। বিশ্বের সবথেকে বড় বড় উৎপাদক ৯টি দেশ একসঙ্গে মিলে যে পণ্য উৎপাদন করে, চিন একাই তার থেকে বেশি উৎপাদন করে। সমস্ত বড় বড় কোম্পানির কারখানা রয়েছে। এমনকী ভারতও চায় চিনের বিদেশি বিনিয়োগ আসুক দেশে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ভারত-চিন সম্পর্কের যেভাবে অবনতি হয়েছে, তাতে দেশে বিভিন্ন চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ হয়েছে। যাদের ব্যবসা চিন থেকে আনা পণ্যের উপরে নির্ভর করত, তারাও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ভারতের যুবরা যেখানে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেখানেই চিন বিনিয়োগ করছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়ার মতো দেশে।
চলতি দশকের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার লক্ষ্য ভারতের। এর জন্য দেশের অর্থনীতি ঘোড়ার গতিতে ছুটছে। একসময় যেখানে আমেরিকার বিদেশি বিনিয়োগের দিকে মুখিয়ে থাকতে হত ভারতকে, সেখানেই আজ ভারত আত্মনির্ভর হচ্ছে। এটা আবার চিনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেই কারণেই চিনের দিকে ঝুঁকছে ভারতও।
আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব ভাঙবে?
আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক নিয়ে যখন বিশ্বজুড়ে ডামাডোল চলছে, তখন চুপ করে রয়েছে ভারত। ট্রাম্প দাবি করেছেন যে ভারত শুল্ক কমাতে রাজি হয়েছে, কিন্তু ভারত এর কোনও জবাব দেয়নি। অন্যদিকে চিনের বন্ধুত্বের বার্তা নিয়েও মুখে কুলুপ এঁটেছে দিল্লি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে বিরোধ এড়াচ্ছে ভারত। বর্তমানে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কও কিছুটা সহজ হচ্ছে। প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বড় অংশীদারী সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইস্যুতেও ভারত নতুন মার্কিন সরকারকে পাশে পেয়েছে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য আমেরিকাকে চটাবে না ভারত। অন্যদিকে, রাশিয়ার সঙ্গেও বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে ভারতের। তারা আবার আমেরিকার নতুন বন্ধু হওয়ায় সম্পর্কের ভারসাম্যটাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে।





