Nemat Sadat: আফগান সমকামী শিল্পী ও আন্দোলনকর্মী নেমত সাদাতের আলোচনা ফিরে দেখলেন কলকাতার সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য
২৪শে সেপ্টেম্বর, ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় ‘প্রান্তকথা’ এবং দঃ পূর্ব এশিয়ার এলজিবিটি তরুণ-তরুণীদের যৌথ একতা মঞ্চ ‘সায়ান’-এর আহ্বানে অধুনা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া শহরনিবাসী, বিখ্যাত সমকামী উপন্যাস ‘দ্য কার্পেট উইভার’-এর লেখক, প্রান্তন সাংবাদিক, একসময় আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেমত সাদাত ভারতের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী এবং দঃ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তরুণ এলজিবিটি অধিকারকর্মীদের মুখোমুখি বসেছিলেন একটি অনলাইন আলোচনায়।
বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়। লিঙ্গ ও এলজিবিটিকিউআই+ অধিকার নিয়ে সোশ্যাল কমিউনিকেটর হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। মিলেনিয়ালদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ স্থাপন করে চলেন নিজের সংস্থা ‘প্রান্তকথা’র বিবিধ কার্যকলাপের মাধ্যমে। TV9 বাংলার জন্য সময় বের করে ফিরে দেখলেন গত ২৪শে সেপ্টেম্বর আফগান সমকামী শিল্পী ও আন্দোলনকর্মী নেমত সাদাতের আলোচনা:
বাংলাদেশের বছর ২৭-এর ট্রান্স-কন্যা হোচিমিন ইসলাম, পাকিস্তানে মুলতানের ট্রান্স-কন্যা সমবয়সী সারো আলি, মুম্বইয়ের সমকামী তরুণ সুমিত পাওয়ার, দিল্লি থেকে এমবিবিএস করে আমেরিকায় এমডি করে এখন নিউ মেক্সিকোয় সহকারী অধ্যাপক সুমন পাল ও তাঁর জীবনসঙ্গী আয়ুশ, উত্তরবঙ্গ থেকে পরিবারচ্যুত, বর্তমানে দমদম নিবাসী সমকামী দম্পতি বিনন্দন ও রবি—সকলেই উৎকন্ঠিত মুখে তাকিয়ে থাকল আফগান সমকামী শিল্পী, আন্দোলনকর্মী বছর চল্লিশের নেমত সাদাতের দিকে?
উত্তরে নেমত বললেন, ‘‘আফগানিস্তান জুড়ে তালিবানের হাত ধরে ইসলামিক মৌলবাদীরা যে ভাবে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ পৃথিবীর গনতন্ত্রপ্রিয় মহল যদি এক্ষুনি না করেন, তাহলে জার্মানিতে নাৎসীদের কাজকর্মের কথা শুনেও ইউরোপের অন্য দেশগুলি চুপ করে যে ভুল করেছিল—ভেবেছিল ওটি জার্মানির অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমাদের অমন হবে না—ঠিক সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে।’’
তালিবানি আফগানিস্তান কট্টরপন্থী শরিয়া আইনের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। এই মতবাদ, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, রূপান্তরকামী, সমকামীদের অসুখ মনে করে খুন করায় বিশ্বাস করে, একই সঙ্গে এই কট্টরপন্থী ইসলামের শাখা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য়ে স্থির। অতএব আজ যদি আমরা আফগানিস্তানে আমাদের এলজিবিটি ভাই, বোন, বন্ধু, প্রেমিক, প্রেমিকার নিধনে চুপ থাকি, এই ক্যানসার কাল সকল পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে পড়বেই।
গত শুক্রবার ২৪শে সেপ্টেম্বর, ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় ‘প্রান্তকথা’ এবং দঃ পূর্ব এশিয়ার এলজিবিটি তরুণ-তরুণীদের যৌথ একতা মঞ্চ ‘সায়ান’-এর আহ্বানে অধুনা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া শহরনিবাসী, বিখ্যাত সমকামী উপন্যাস ‘দ্য কার্পেট উইভার’-এর লেখক, প্রান্তন সাংবাদিক, একসময় আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেমত সাদাত ভারতের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী এবং দঃ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তরুণ এলজিবিটি অধিকারকর্মীদের মুখোমুখি বসেছিলেন একটি অনলাইন আলোচনায়। ঘণ্টা দেড়েক-ধরে চলা এই প্রশ্ন-উত্তর পর্বের পরতে-পরতে এই মুহুর্তে আফগানিস্তানের এলজিবিটি নাগরিকরা কি অসম্ভব অত্যাচারের মুখে দিন কাটাচ্ছেন, তার বর্ণনা উঠে আসছিল।
নেমত জানালেন, যে দিন থেকে কাবুলের পতন হয়েছে ওঁর ফোন, মেসেজ, ইমেল-এর বক্স ভরে উপচে পড়ছে এলজিবিটি তরুণ-তরুণীদের কাতর আবেদনে। কোনও ক্রমে দেশ ছাড়তে না-পারলে খুঁজে-খুঁজে ওদের খুন করছে তালিবানরা। এমনকি নেমতের অভিযোগ, ‘‘পাকিস্তানের আইএসআই তালিবানদের সাহায্য করছে এলজিবিটিদের ফোনের জিও লোকেশন খুঁজে যে যেখানে লুকিয়ে আছে, সেখান থেকে বের করে খুন করতে।’’ নেমত তাই সকলকে পুরনো সিম ফেলে দিতে বা নিষ্ক্রিয় করে দিতে বলছেন। এই মুহুর্তে নেমতের কাছে প্রায় হাজারের উপর শরণার্থীর আবেদন রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় আড়াইশো এলজিবিটি শরণার্থীর আবেদন নিয়ে আমেরিকার বিদেশ দপ্তরে কাজ চলছে। অন্যান্য দেশ যেমন নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি ইত্যাদি ইউরোপিয়ান দেশেও কাতর আবেদন করছেন নেমত।
অনুষ্ঠানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক কৌস্তুভ বক্সি জিজ্ঞেস করলেন, ভারতের বিদেশ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না। নেমত জানালেন, যদিও তিনি এখনও সরাসরি যোগাযোগ করেননি, কিন্তু কাবুল পতনের পর থেকে ভারত প্রভূত পরিমাণে আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। এমনকি ই-ভিসার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল, তাতে এত আবেদন জমা পড়ে কয়েকদিনে যে আপাতত তা বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু নেমতের মতে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ ভারতকে তাঁদের কাছের বন্ধু বলেই ভাবেন। একই সঙ্গে নেমতের বক্তব্য, এই ভয়ঙ্কর সময়ে ভারত সরকারের উচিত শরণার্থীর ধর্ম মুসলমান না শিখ না হিন্দু না ক্রিশ্চিয়ান, এসব ভুলে আশ্রয় দেওয়া। ভারত তার ইতিহাস জুড়ে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে কখনও পিছপা হয়নি।
নেমত নিজে মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করেছেন যে দিন থেকে তিনি তাঁর সমকামী পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কারণ তাঁর মতে, মুসলমান ধর্মে সমকামীদের কোনও জায়গা নেই। তাই ধর্মের গোঁড়ামির কাছে নিজের আত্মাকে পরাধীন করে রাখতে রাজি ছিলেন না নেমত। একই সঙ্গে তিনি জানান যে, ধর্ম ত্যাগ করলেও আধ্যাত্মিকতার সাথে তাঁর যোগ নিবিড়। সেখান থেকেই তিনি এই লড়াইয়ের রসদ পান।
বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনকর্মী হোচিমিন যখন জানালেন, তাঁর উপরে অতীতে দু’বার প্রাণঘাতী আক্রমণ করেছে মৌলবাদীরা, নেমত তখন সরাসরি আঙ্গুল তুললেন দীর্ঘ দু’দশকের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ থেকে একটি ধারাবাহিক পরিকল্পনা ছাড়াই কীভাবে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী আফগানিস্তান ত্যাগ করল, সেই অদূরদর্শী পরিকল্পনার দিকে।
তাঁর মতে, war on terror-এ সামারিক বাহিনী যেমন লড়েছে সামনের সারিতে, তেমনই সামাজিক স্তরেও এই লড়াই চলেছে। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন মহিলারা, প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা, কারণ প্রতিদিন তাঁরাই মৌলবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন নিজেদের সামনে এনে, আত্মপরিচয় প্রকাশের মাধ্যমে। তাই সামরিক বাহিনীর মতো এঁদেরও দরকারে দেশ ছাড়ার একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা এই যুদ্ধের কাণ্ডারিদের রাখার দরকার ছিল, যা না করে ‘ব্যবহৃত বাসনের’ মতো ফেলে গিয়েছেন এঁদের। আর সেই কারণেই আজ আফগানিস্তানের মহিলারা, মানবাধিকারকর্মীরা, এলজিবিটির নাগরিকরা প্রাণভয়ে এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে, কারওর বাড়ির ছাদে, তো আক্ষরিক অর্থেই দিনের পর দিন ঘরের ভেতরে কোন বাক্সের ভিতরে দিন কাটাচ্ছেন এই আশায় যাতে তাঁদের অস্তিত্ব টের না পায় তালিবানরা।
শুনতে-শুনতে চোখের সামনে নাৎসি জার্মানিতে ষোড়শী আনা ফ্রান্ক-এর লেখা ডাইরিরর দিনপঞ্জিগুলি ভেসে উঠছিল। দু’টো আলমারি এক করে তার পিছনে কিছুটা জায়গা বের করে দু’টি পরিবার দিনের পর দিন এই আশায় দিন কাটাচ্ছিল যে এই বিপদ থেকে যদি নিস্তার পাওয়া যায়।
বাকিটা ইতিহাস!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর হাজারও গবেষণা আজ এক বাক্যে বলছে হিটলারের ইহুদী বিদ্বেষী তত্ত্ব বারবার প্রচার করে গণ-উন্মদনার যে আফিম তৈরি হয়েছিল, তাই-ই জাত্যাভিমানের বিশ্বযুদ্ধের শিকড়!
নেমত সাদাতের মতে নারী বিদ্বেষ, এলজিবিটি বিদ্বেষের যে বীজ সিরিয়া, ইরান হয়ে আজ আফগানিস্তানে সবথেকে হিংস্র তালিবানী রূপ নিয়েছে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে, আজ আফগানিস্তানে যে আগুন জ্বলছে, খুব শিগগিরই তা পৃথিবী জুড়ে আর একবার মৌলবাদের আর এক ঢেউ তুলবে। আরো কত ৯/১১ এই ঢেউ তৈরি করবে তখন, তা ইতিহাসই বলবে।
অলঙ্করণঃ অভীক দেবনাথ।