AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

১০০ বছর ধরে বেসুরো পিয়ানোকে সুরেলা করার মহাকাব্য

পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে শ্রীকান্ত ভাবেন, হয়ত ভাল পিয়ানিস্ট হতেই পারতেন তিনি। কিন্তু সেই যে ছেলেবেলায় নেশা লেগে গেল সুর সারাইয়ের!

১০০ বছর ধরে বেসুরো পিয়ানোকে সুরেলা করার মহাকাব্য
| Edited By: | Updated on: Jun 27, 2021 | 6:37 AM
Share

নন্দন পাল

আর পাঁচটা কিশোরের মতো লকডাউনে ওর স্কুলও বন্ধ। ও পথিকৃৎ পাল। ১৪ বছর বয়স। তবে এই আটকে থাকাটা ওকে মন খারাপের শিকল পরাতে পারেনি। পড়াশোনার ফাঁকেফাঁকে পিয়ানোর আশিটা রিডে আঙুল বুলিয়ে বাজনা বাজায় পথিকৃৎ। কখনও বার্লিনের সি বেখস্টেইন, কখনও নিয়েনডোর, কখনও রনিসখ। ওদের বাড়িতে যে দিকেই তাকানো যায়, সে দিকেই পিয়ানো! কোনওটা গ্র্যাণ্ড পিয়ানো, কোনওটা আপরাইট পিয়ানো, কোনওটা জার্মান কটেজ। আবার কোনওটা আমেরিকান আপ রাইট পিয়ানো।

পথিকৃতের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিলেন হেমন্ত পাল। কলকাতায় প্রথম দেশীয় পিয়ানো সারানোর কারিগর। তিনি ১৯০৫-এ ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে প্রতিষ্ঠা করেন এইচ পাল অ্যান্ড কোম্পানি। সেই শুরু হারমোনিয়াম, সরোদ, সেতার, তানপুরা, তবলা পিয়ানো নিয়ে ঘরকন্না। শতাব্দী পার করেও এখনও চলেছে এইচ পাল অ্যান্ড কোম্পানি। বর্তমান কর্ণধার শ্রীকান্ত পাল। প্রথম লকডাউনের পর যখন করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের জেরে আবার লকডাউন শুরু হল, তখন শ্রীকান্তবাবু দেখলেন তাঁর দোকান বন্ধ থাকায় কর্মীদের সংসার চালাতে অসুবিধে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলেন তেঘরিয়ার রঘুনাথপুরের বাড়ি থেকেই সারানো হবে পিয়ানো, আর মধ্যমগ্রাম থেকে কাজ হবে হারমোনিয়ামের। সেই সুত্রেই প্রায় ২৬টি পিয়ানোর অস্থায়ী ঠিকানা এখন রঘুনাথপুর রোড, তেঘরিয়া, কেয়ার অফ শ্রীকান্ত পাল। বড় ছেলে হীরকের দায়িত্বে হারমোনিয়াম আর ছোট ছেলে প্রবাল বাবার সঙ্গে দেখেন পিয়ানোর দিকটা।

বাবা তপন পালকে দেখে ছাত্রাবস্থায় পিয়ানোর নেশায় পড়েন শ্রীকান্ত। পাশাপাশি পড়াশোনা আর পিয়ানো সারানোর খুঁটিনাটি শেখা দু’টোই চলল। প্রৌঢ় শ্রীকান্ত বলছেন এ কাজে দরকার প্রকৌশলী বিদ্যার জ্ঞান আর নিখুঁত কান। একটা গ্র্যাণ্ড পিয়ানো বেসুরো হয়ে যখন সারাইয়ের জন্য আসে তাঁর কাছে, তখন কখনও-কখনও চার-পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় লাগে তাকে সঠিক সুরে ফেরাতে। এভাবেই তিনি আজীবন সুরেলা রেখেছেন ভি বালসারার ভালবাসার পিয়ানোটিকে। আজও তাঁর কাছে রয়েছে নিউইয়র্কের প্র্যাট রিড এণ্ড কোম্পানির হাতির মাথাওয়ালা ২১০৩৭৯ নম্বর পিয়ানোটি। এই পিয়ানো দীর্ঘদিন ব্যবহার করেছেন ভি বালসারা।

শ্রীকান্তবাবু তাঁর ওয়ার্কশপ ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। বলছিলেন, প্রায় প্রতিটি ভাল পিয়ানোতেই থাকে এই সিরিয়াল নম্বর। নম্বর দিয়ে সার্চ করলেই সেই পিয়ানোর মালিকের সম্বন্ধে জানা যায়। ভি বালসারার শতবর্ষে এসে এই পিয়ানোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তাই যথেষ্ট। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এসপি বালাসুভ্রহ্মনিয়ম থেকে অরিজিৎ সিং পর্যন্ত তাঁদের পিয়ানোর ‘শরীর খারাপে’ শরণাপন্ন হয়েছেন এইচ পাল অ্যাণ্ড কোম্পানির। দেরাদুনের দুন স্কুল, মুসৌরির সেন্ট থমাস স্কুল, অ্যাসেম্বলি অব গডেস চার্চ কলকাতা কিংবা সেন্ট পলস চার্চ দার্জিলিং-এর পিয়ানো খারাপ হলেই ডাক পড়ে শ্রীকান্তবাবুর। ডাক পড়ে কলকাতা আর দিল্লির অল ইণ্ডিয়া রেডিওতেও। প্রায় গোটা উত্তর ভারত জুড়ে পিয়ানো আর আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় হারমোনিয়াম যায় তাঁদের সংস্থা থেকেই।

শ্রীকান্ত পালের কাছে প্রতিটি পিয়ানোই স্বতন্ত্র। প্রতিটির থেকেই আজও প্রথম দিনের মতই শিখে চলেছেন। প্রতিটির কিবোর্ডে, হ্যামারে, ড্যাম্পারে, ব্রিজে, সাউন্ড বোর্ডে আর তারে-তারে লেখা হয় যে সুরের মহাকাব্য, তার থেকে অনেক যোজন দূরে কোথাও কি উপেক্ষিতই রেয়ে গেলেন এই সুরের শুশ্রুষাকারী? পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে শ্রীকান্ত ভাবেন, হয়ত ভাল পিয়ানিস্ট হতেই পারতেন তিনি। কিন্তু সেই যে ছেলেবেলায় নেশা লেগে গেল সুর সারাইয়ের! বেসুরো যন্ত্রগুলো সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করে আছে কখন আসবেন তাঁদের ডাক্তার। বেসুর সারিয়ে সুরের দাওয়াই দিয়ে এভাবেই চলছে শতাব্দী পার করে আমাদের শহরের এক সুর-সারাইয়ের মহাকাব্য।