পরিচারিকার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তাঁকে একটু টাকা দিয়ে রাখতে হবে, সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ

এই সময় ওঁদের হাতে একটু বেশি টাকা দেওয়া বা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেওয়াটা ‘রিটেনার ফি’ হিসেবে ধরতে হবে। অর্থাৎ আমার কোম্পানি থেকে একজন কর্মী যাতে চলে না যান, সেজন্য এটুকু ব্যবস্থা।

পরিচারিকার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তাঁকে একটু টাকা দিয়ে রাখতে হবে, সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ
Follow Us:
| Updated on: Apr 21, 2021 | 2:07 PM

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবং লকডাউন হব-হব পরিস্থিতিতে (মঙ্গলবার দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে কেন্দ্রীয় সরকার এখনই লকডাউনের কথা ভাবছে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং সেই সিদ্ধান্তভার কার্যত রাজ্য সরকারগুলির উপর ছেড়ে দিয়ে লকডাউনকে একেবারে ‘শেষ বিকল্প’ হিসেবে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন) পরিচারিকার স্বাস্থ্যের কথা কতটা ভেবে দেখি আমরা শহুরে এলিট-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ? কর্পোরেট-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত অনেক শহুরে-অভিজাত পরিবারে, যেখানে দম্পতি এখনও ওর্য়াক ফ্রম হোম-যাপনে বন্দি এবং শিশুও স্কুল ফ্রম হোম-এর অনলাইন নিয়মে ক্লান্ত অথচ নাছোড়, সেখানে পরিচারিকার ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। একজন যোগ্য নিয়োগকর্তা বা কর্ত্রী হিসেবে কী-কী করতে পারি আমরা পরিচাকর-পরিচারিকাদের (বিশেষত পরিচারিকা, যেহেতু সংখ্য়াই তাঁরাই বেশি) জন্য এবং কেনই বা এই করাটা ভীষণ দরকার এ হেন পরিস্থিতিতে? এই করাটাকে অহেতুক মহানুভবতার দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখাটা কতটা এলিটিস্ট? এ সবের ব্যখ্যা দিলেন সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ (অর্থনীতির অধ্যাপক, সিটি কলেজের বিভাগীয় প্রধান তথা নারী আন্দোলনের কর্মী)

গরিব মানুষ একেবারেই পরিচ্ছন্ন থাকেন না। ফলে যাবতীয় রোগ তাঁদের থেকেই ছড়ায়—এই ধারণা বহু প্রাচীন। গত বছর করোনার প্রকোপ যখন প্রথমবারের জন্য় শুরু হল, তখনও এই ধারণা তথাকথিত মধ্যবিত্ত এবং বড়লোকদের দেখা গিয়েছিল। ফের সেই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আমার আশঙ্কা। যত গরিব মানুষ, ততই তাঁরা আক্রান্ত হবেন। অতএব তাঁরা পরিত্যাজ্য। এটা আমরা ধরে নিই। অথচ আমরাও যে সমানভাবে গড়িয়াহাটের সেলে ভিড় জমাই, সেটা ভাবি না। ফলে দোষারোপের জায়গা তৈরি হয় শ্রেণিগতভাবে। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজ ভাবে, আমরা নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারি। কিন্তু গরিব মানুষ পারে না।

Covid-2nd-phase-Txt-Card-1

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফের লকডাউন হতে পারে, এমন একটা পরিস্থিতিতে যদি হঠাৎ করেই পরিচারিকাদের আসতে বারণ করে দেওয়া হয়, তাহলে সমস্ত চাপটা পড়বে বাড়ির মহিলাদের উপর। এটা যেমন একটা দিক, এর আরও একটা দিক রয়েছে। আমার বাড়িতে যিনি ঘর মোছেন, তাঁর পরিবারের সকলের জ্বর। তাঁকে আসতে বারণ করেছি। তিনি আসছেন না। কেন আসছেন না? কারণ তিনি দেখেছেন, লকডাউনের সময় তাঁকে পুরো মাইনে দিয়েছি। ফলে সেই বিশ্বাস বা ভরসা আমার উপর রয়েছে। আবার আমারও ওঁর উপর বিশ্বাস রয়েছে, অসুস্থ অবস্থায় উনি এসে আমাদের বিপদে ফেলবেন না। আবার কাজ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও বাড়িতে বসে থাকবেন, এটা হবে না, সেই বিশ্বাস আমার রয়েছে।

পরিচারিকাদের বেশিরভাগটাই অসংগঠিত। যে সব সংগঠন রয়েছে, তাঁদের থেকে জানতে পেরেছিলাম আগেরবার লকডাউনে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মাইনে দেওয়া হয়নি। অথবা কাজে এলে আপাদমস্তক স্যানিটাইজ় করে তারপর তাঁদের হাতে পয়সা দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনা কিন্তু বহু ঘটেছে। আমার আশঙ্কা আবার লকডাউন হলেও একই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। পরিচারিকাদের সঙ্গে দুর্বব্যবহার করা, তাঁদের বঞ্চনা করা, এগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা করি। কারণ তাঁরা অসংগঠিত। তাঁদের হয়ে বলার কেউ নেই। তাঁদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমার বাড়িতে এসে কেউ ঝামেলা করবেন না, আমরা জানি। সে কারণেই এগুলো আমরা করি। যাঁরা ওঁদের অ্যাফোর্ড করতে পারেন না, তাঁদের কথা বলছি না। কিন্তু যাঁরা অ্যাফোর্ড করতে পারেন, যাঁরা সরকারি কর্মচারি, চাকরিতে না গিয়েও মাইনে পাচ্ছি, তাঁরা যখন এগুলো করি, সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, এই জায়গাটার পুনরাবৃত্তি হতে পারে, সেই আশঙ্কা করছি।

করোনা গরিবদের থেকে ছড়ায়, মধ্যবিত্ত এবং বড়লোকদের থেকে ছড়ায় না, এই মনোভাব আবার ফিরে আসতে পারে। ফলে প্রথমেই যেটা করা যেতে পারে, পরিচারিকাদের আইডি কার্ড। সেটা থাকলে সরকার থেকে টাকা পয়সার যদি কোনও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়, সেগুলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এঁরা বেশিরভাগই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। বর হয়তো মদ খেয়ে এসে পেটায়, বা ছেলে দেখে না। সে কারণেই এই কাজ করছেন। এই কাজটা চলে গেলে ওঁদের কিন্তু কোনও সেকেন্ড লাইন অব সারভাইভাল নেই, সেটা ভাবতে হবে।

Covid-2nd-phase-Txt-Card-2

এই সময় ওঁদের হাতে একটু বেশি টাকা দেওয়া বা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেওয়াটা ‘রিটেনার ফি’ হিসেবে ধরতে হবে। অর্থাৎ আমার কোম্পানি থেকে একজন কর্মী যাতে চলে না যান, সেজন্য এটুকু ব্যবস্থা। পরিচারিকার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তাঁকে একটু টাকা দিয়ে রাখতে হবে। এটা ওঁর প্রাপ্য। এতে অভিজাত পরিবারের বা তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের আত্মশ্লাঘার কোনও ব্যাপার নেই। আমার প্রয়োজনেই ওঁকে আমি রিটেন করছি।

শেষে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা লিখতে চাই। সরকারের এঁদের জন্য অবশ্যই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় তেল, সাবানের ব্যবস্থা করা উচিত। অনেক বাড়িতেই হয়তো পরিচারিকাদের কিছুটা করে দায়িত্ব নেওয়া হয়। কিন্তু সবটা নেওয়া তো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিচারিকাদের বিভিন্ন সংগঠন কিছুদিন আগে একটা বড় মিছিল করেছিল। আমি সেখানে ছিলাম। ওঁদের স্লোগান ছিল, ‘দিদির কাপড় আমরা কাচি, মোদীর বাসন আমরা মাজি’। অর্থাৎ সব সরকারেরই কিন্তু ওঁদের প্রয়োজন। তাই সব সরকারকেই ওঁদের কথা ভাবতে হবে।