মা-বাবার ছিল না খোঁজ, তবুও ভারতের একনম্বর অভিনেত্রী তিনি, তাঁকে চিনলেও জীবন কাহিনি চোখে জল আনবে আপনার
লেখক সন্ধ্য়া সেনের লেখা কানন দেবীর বায়োগ্রাফি 'সবারে আমি নমি'তে উঠে আসে, তাঁর জীবনের সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা। কানন দেবী নিজেই লেখিকাকে তা বলে গিয়েছিলেন। যা পড়লে শিউড়ে উঠতে হয়।

বাংলা সিনেমা সুচিত্রাময় হওয়ার অনেক আগেই মোহময়ী রূপে, দারুণ অভিনয়,অসামান্য কণ্ঠে বাংলা সিনেমার নতুন ইতিহাস লিখেছিলেন কানন দেবী। সিনেমার জগতে তাঁর উজ্জ্বল ইতিহাসকে সম্মান দিয়ে, সেই সময়ের ফিল্ম বোদ্ধারা অনেকেই সুচিত্রাকে ‘নয়া কানন দেবী’ নামেও সম্বোধন করতেন। রবীন্দ্রনাথ কাননকে দেখে বলেছিলেন, ‘বাহ তুমি খুব সুন্দরী তো! গান গাইতে পারো?’ কানন দেবীর কাছ থেকে হ্যাঁ উত্তর শুনে, তাঁকে শান্তিনিকেতনে গান শোনানোর জন্যও ডেকেছিলেন কবিগুরু। কানন দেবী ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটা উজ্জ্বল যুগ। যে সময় সমাজ মহিলাদের অন্দর-বাহিরের উপস্থিতি নিয়ে তটস্থ, সেই সময় সমস্ত ট্যাবুকে একপাশে রেখে অভিনয় জগতে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন কানন দেবী। রেকর্ড করেছিলেন একের পর এক হিট গান। তবে কানন দেবীর শুরুটা ছিল রবিঠাকুরের গান দিয়েই। তবে অভিনয়, গানের কেরিয়ার তাঁর উজ্জ্বল হলেও, ব্যক্তিগত জীবন ছিল লড়াইয়ের। এমনকী, কোথা থেকে এই বঙ্গে এসেছিলেন তিনি, তাঁর মা-বাবা কে ছিলেন, তা এখনও অজানাই রয়ে গিয়েছে।
লেখক সন্ধ্য়া সেনের লেখা কানন দেবীর বায়োগ্রাফি ‘সবারে আমি নমি’তে উঠে আসে, তাঁর জীবনের সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা। কানন দেবী নিজেই লেখিকাকে তা বলে গিয়েছিলেন। যা পড়লে শিউড়ে উঠতে হয়। কেননা, কানন দেবীর ছোটবেলা মোটেই সুখের ছিল না সুখের। মা নেই, বাবা নেই, ঠিকঠাক খাওয়া-পড়া নেই, কখনও বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে কেটেছে তাঁর কিশোরীবেলা। তাঁর জীবন যেকোনও সিনেমার চিত্রনাট্যের রূপ নিতে পারে।
কানন দেবীর বেড়ে ওঠা নিয়ে নানা মুণির নানা মত। কানন দেবীর জীবন নিয়ে নানা বইয়েও সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর বেড়ে ওঠার নানান গল্প। এই যেমন, লেখক মেখলা সেনগুপ্ত তাঁর ‘কানন দেবী, দ্য ফার্স্ট সুপারস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’ বইয়ে লিখেছিলেন, বালিকা কাননকে প্রথম পাওয়া যায় হাওড়ার এক গরিব পাড়ায়। হাওড়ার এক নামী স্কুলেও তাঁর নাম লেখান হয়েছিল। তবে মাইনে না দিতে পারায়, নাম কাটা যায়। আবার অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশু কানন দেবীকে ভাগলপুরে গঙ্গা তীরবর্তী রাজবাটী আদমপুরের পোস্তা বাগানবাড়িতে আনা হয়। সেটা ছিল শীলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি। তিনি ছিলেন পেশায় উকিল। জানা যায়, হারকাটা গলির পতিতাপল্লী থেকেই তাঁকে আনা হয়েছিল। আবার শোনা যায়, কানন দেবীর বাবা ছিলেন দর্জি এবং মা ছিলেন বাঈজি। মায়ের থেকেই নাকি তাঁর গান গাওয়া ও অভিনয় শেখা। অনেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক পরিচারিকার কাছেই নাকি তাঁর বড় হওয়া এবং সংসার টানতেই অল্প বয়সে সিনেমায় আসা তাঁর।
সালটা ১৯২৬। পরিচালক জয়তিশ বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের জয়দেবের ছবি থেকেই মূলত তাঁর অভিনয়ের শুরু। ইন্ডাস্ট্রি তখন তিনি খুবই নতুন। সেই সময়ই ১৯৩১ সালে সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন কানন। ক্য়ামেরার সামনেই নায়ক তাঁর ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলেন। খুব বড় আঘাত পেয়েছিলেন কাননদেবী। কিন্তু তাঁর এই অপমানের কথা কেউ পাত্তা দেয়নি। শোনা যায়, তাঁর সরলতার সুযোগ নিয়েছে অনেকেই। ঠকিয়েছেও তাঁকে। এরপর ১৯৩৭ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার মুক্তি ছবিই কানন দেবীকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। তবে কানন দেবীর সারা জীবনের একটা খেদ ছিল, প্রমথেশ বড়ুয়ার দেবদাস ছবিতে পার্বতীর চরিত্র করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। সেই দুঃখ ছিল চিরকাল। শোনা যায়, দেবদাস ছবিতে যমুনা বড়ুয়াকে পাবর্তী চরিত্রে দেখে বড্ড হিংসা হয়েছিল নাকি কানন দেবীর। তবুও এত লড়াইয়ের মাঝে তাঁর প্রাপ্তি, তিনিই ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার নায়িকা।





