Sitaram Yechury: কারও সীতা, কারও রাম – একক পরিচয়ে বাঁধা যাবে না ইয়েচুরিকে

Sitaram Yechury: সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক অবশ্য তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর প্রথম পরিচয় অবশ্যই তিনি মার্কসবাদী। তবে, সেই সঙ্গে আরও বিভিন্ন পরিচয় ছিল তাঁর। ভারি ভারি তত্ত্ব সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। ইংরেজি, হিন্দি, তেলেগু, বাংলা এবং তামিল - একাধিক ভাষায় দখল থাকার পাশাপাশি, রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণেও ছিল তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলিকে সঙ্গে নিয়েও চলতে পারতেন। তিনি। আসলে কে ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি?

Sitaram Yechury: কারও সীতা, কারও রাম - একক পরিচয়ে বাঁধা যাবে না ইয়েচুরিকে
কোনও একক পরিচয়ে বাঁধা যায় না ইয়েচুরিকেImage Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Sep 12, 2024 | 7:34 PM

নয়া দিল্লি: দীর্ঘ অসুস্থতার পর, বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর), সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে চূড়ান্ত ‘লাল সেলাম’ জানিয়েছে জীবন। তার আগে পাঁচ দশক তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ‘ইনকিলাব’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারত’-এর জন্য। সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক অবশ্য তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর প্রথম পরিচয় অবশ্যই তিনি মার্কসবাদী। তবে, সেই সঙ্গে আরও বিভিন্ন পরিচয় ছিল তাঁর। শিক্ষা জগতের যেমন স্বাচ্ছন্দ্য ছিল তাঁর, আবার ভারি ভারি তত্ত্ব সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। ইংরেজি, হিন্দি, তেলেগু, বাংলা এবং তামিল – একাধিক ভাষায় দখল থাকার পাশাপাশি, রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণেও ছিল তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলিকে সঙ্গে নিয়েও চলতে পারতেন। তিনি। আসলে কে ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি?

১৯৫২ সালের ১২ অগস্ট চেন্নাইয়ে এক তেলেগু ভাষাভাষী পরিবারে জন্মেছিলেন সীতারাম। বাবা ছিলেন অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্য সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের একজন ইঞ্জিনিয়ার, আর মা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। হায়দরাবাদেই ছোটবেলাটা কেটেছিল সীতারামের। ১৯৬৯ সালের তেলঙ্গানা আন্দোলনের সময় দিল্লিতে চলে এসেছিলেন তিনি। সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্বর্ণপদক-সহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন তিনি। তারপর মাস্টার্স করেন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর জেনেইউ-এর দিনগুলিই জীবন পাল্টে দিয়েছিল সীতারামের। বন্ধু তথা পরবর্তীকালের কমরেড প্রকাশ কারাতকে সঙ্গে নিয়ে জেএনইউ-কে বাম ছাত্র রাজনীতির ঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন সীতারাম। জরুরী অবস্থার সময় তিনি আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার ফলে মাঝপথে তাঁকে পিএইচডি ছাড়তে হয়েছিল। পরে ১৯৭৮ সালে তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। তার আগে, ইয়েচুরির নেতৃত্বে এক বিক্ষোভের জেরে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরার সামনে দাঁড়িয়ে ইন্দিরার বিরুদ্ধে ইয়েচুরির অভিযোগপত্র পড়ার একটি ছবি ভারতীয় রাজনীতিতে অমর হয়ে রয়েছে।

ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থা জারির বিরুদ্ধে লড়াই দিয়ে যে জীবনের শুরু হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। ১৯৭৪ সালে তিনি সিপিআইএম-এর ছাত্র সংগঠন, এসএফআই-তে যোগ দিয়েছিলেন। জেএনইউ-তে তিনি পরপর তিনবার ছাত্র সংসদের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে ৩২ বছরের সীতারামকে সিপিআইএম কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। এই গুরু দায়িত্ব গ্রহণের মতো পরিপক্কতা তৈরি হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সীতার মনেই সন্দেহ ছিল। তবে, কোনও দ্বিধা ছিল না পার্টির সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদক ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের মনে। আট বছর পর, অন্ধ্র প্রদেশের কাকিনাড়া থেকে একজন পলিটব্যুরো সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। সবশেষে ছিলেন দলের শীর্ষপদেও।

সীতারাম ইয়েচুরির আরেকটি পরিচয় হল তিনি গোঁড়ামীহীন কমিউনিস্ট নেতা। অনেক সময় অনেকে এর জন্য তাঁকে সুবিধাবাদী মনে করেছেন। বলেছেন তিনি ‘বুর্জোয়া’দের সঙ্গে ‘আপস’ করেন। তবে, ইয়েচুরি জানতেন তাঁর মতবাদ নিতান্তই মার্কসবাদ। বিশ্বাসের এই দৃঢ়তার জোরে তিনি বন্ধু ও কমরেড প্রকাশ কারাতের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেননি। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল দুই কমিউনিস্ট নেতার। কারাত শিবির মনে করত মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসকে দূরে রাখাই উচিত। অন্যদিকে ইয়েচুরি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, মোদীকে পরাস্ত করতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে এত জায়গায় আনতে হবে।

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে গিয়ে পার্টি কংগ্রেসে এই বিষয়ে তাঁর যুক্তিগুলি পেশ করেছিলেন ইয়েচুরি। তৃণমূল স্তরের কর্মীরা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম এবং কংগ্রেসের জোট হয়। যদিও সেই জোট এখনও পর্যন্ত নির্বাচনী সাফল্য পায়নি। তবে, বিজেপিকে হারাতে কংগ্রেস-সহ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে সিপিআইএম-এর নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে সীতারামের মত ন্যায্যতা পেয়েছে। আর সেই কারণেই প্রথমে ২০১৫ এবং তারপর ২০১৮ ও ২০২২-এ তিনি সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সিপিআইএম-এর পতনকে তিনি আটকাতে পারেননি। দলকে নতুন করে গঠন করতে পারেননি। দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে পারেননি। তবে, তাঁর ব্যক্তিগত উপস্থিতিই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নকশায় বামেদের গুরুত্ব ধরে রাখার জন্য সহায়ক হয়েছিল।

জোট রাজনীতির এই শিক্ষা সম্ভবত সীতারাম পেয়েছিলেন তাঁর মেন্টর হিসেবে পরিচিত, সিপিআইএম-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিতের কাছ থেকে। ইউপিএ সরকার গঠনের সময় সুরজিতের বড় ভূমিকা ছিল। তার আগে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ইউনাইটেড ফ্রন্টও গঠনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। দুই ইউপিএ সরকারেরই সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন সীতারাম। ২০১৯ সালেও মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা করেছিলেন ইয়েচুরি। তবে, পুলওয়ামা হামলা এবং বালাকোট সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ভোটের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিল। তবে, তাতে দমে যাননি হরকিশেন সুরজিতের প্রিয় ছাত্র। ইন্ডিয়া জোট গঠনের পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে জোট বড় ধাক্কা দিয়েছে মোদী সরকারকে।

রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও বিজেপিকে তিনি কখনও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে দেননি। অ-বাম সাংসদদেরও অনেক সময়ই সীতারামের সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। ২০১৫ সালে রাজ্যসভায় সীতারামের রাজনৈতিক কৌশলের ঝলক দেখা গিয়েছিল। বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় একটি সংশোধনী পাস করার জন্য জোট বেঁধেছিল বিরোধীরা। রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে তাঁর সাফল্য, তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে সাংসদ হতে সাহায্য করেছিল। তার আগে, সিপিআইএম-এ কোনও নেতাকে একাধিক মেয়াদের জন্য রাজ্যসভার সাংসদ করা হত না। কিন্তু সীতারামের জন্যই সিপিআইএম-কে সেই নীতি বদলানোর অনুরোধ করেছিলেন অন্যান্য বিরোধী দলের নেতারাও। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, দেশের সংবিধান সংশোধন করা হলে সিপিআইএম সংবিধান বদলাবে না কেন? সাংসদ ইয়েচুরির জন্য তাঁর বিদায়ী বক্তৃতার সময় রাজ্যসভায় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সমাজবাদী পার্টির রামগোপাল যাদব। শেষ পর্যন্ত তৃতীয়বারের জন্য সীতারামকে রাজ্যসভায় পাঠায়নি সিপিআইএম। দলের একটা অংশ এখনও মনে করে, এই সিদ্ধান্তের ফলেই সংসদে বামদের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হারিয়ে গিয়েছে।

কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএম-এর জোটের সবথেকে বড় সমর্থক হলেও, কংগ্রেসের প্রতি তিনি নরম মনোভাবাপন্ন ছিলেন, এটা ভাবা ভুল। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালীন, ভারত-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে প্রকাশ কারাতের পাশাপাশি সোচ্চার হয়েছিলেন সীতারামও। টুজি স্পেকট্রাম বরাদ্দের অনিয়ম নিয়ে তিনিই প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। মজার বিষয়, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে শুধু একাংশের সিপিআইএম নেতারাই ইয়েচুরির উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন না, অনেক কংগ্রেস নেতারও চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। আসলে, কংগ্রেসেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। রাহুল গান্ধী তাঁকে ‘চিফ’ বা ‘প্রধান’ বলতেন। একাংশের কংগ্রেস কর্মীদের অভিযোগ ছিল, রাহুল এই বাম নেতার কথাতেই উঠছেন-বসছেন। অথচ, রাহুল গান্ধীর মধ্যে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে ইয়েচুরির মেন্টরশিপের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। ২০২৪ সালে ‘সংবিধান রক্ষা’র প্রচারকে সামনে রেখেই বড় সাফল্য পেয়েছে বিরোধীরা। মজার বিষয়, ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পরই এই প্রচার শুরু করেছিলেন সীতারাম। ১০ বছর পর তাঁর সেই রাজনৈতিক কৌশল কাজে দিয়েছে। ভোটারদের অনেকে সেই আখ্যান বিশ্বাস করেছে।

আসলে সীতারাম ইয়েচুরিকে কোনও একটি পরিচয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়।