করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কেন রোখা গেল না? কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?

করোনা ভাইরাসের শনাক্তের পর বছর খানেকের মধ্যে একাধিক ভ্যাকসিন বানানোও একটা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। এর পরেও রোখা গেল না করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ। কেন?

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কেন রোখা গেল না? কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?
গ্রাফিক্স: অভিক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Apr 30, 2021 | 11:26 PM

নিজস্ব প্রতিবেদন: ৪ মাসের মধ্যেই করোনা ভ্যাকসিনের ১০০ কোটি প্রথম ডোজ় দেওয়া সম্ভব হল গোটা বিশ্বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আপদকালীন ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণার পরপরই এত কম সময়ে এই কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ হওয়া নজিরবিহীন বলেই মনে করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের শনাক্তের পর বছর খানেকের মধ্যে একাধিক ভ্যাকসিন বানানোও একটা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। এর পরেও রোখা গেল না করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ। কেন? তার অনেকাংশে দায়ী অসম ভ্যাকসিন বন্টন বলে মনে করছেন গবেষকরা।

গত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে ৫৭ কোটি মানুষকে ১০৬ কোটি ডোজ় দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭.৩ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ় পেয়েছেন। বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের ৭৫ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দিলে তবেই করোনার এই ঢেউ রোখা সম্ভব। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, যা ভ্যাকসিন উৎপাদন হয়েছে, তার অর্ধেক ডোজ় গিয়েছে চিন ও আমেরিকায়। গোটা আফ্রিকা মহাদেশে মাত্র ২ শতাংশ ভ্যাকসিন পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এই বৈষম্যের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়েই নিজের রূপ পাল্টে ফেলছে করোনা। নতুন করে হানা দেওয়ার অনেক সময় করোনা পেয়ে যাচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। উত্তর ক্যারোলিনার ডিউক গ্লোবাল হেল্থ ইন্সটিটিউটের ইনভেশন ফর অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর কৃষ্ণ উদয়কুমার বলছেন, “এত কম সময়ে ভ্যাকসিন বানিয়ে প্রায় ১০০ কোটি ডোজ় দেওয়া নজিরবিহীন পদক্ষেপ। কিন্তু অসম ভ্যাকসিন বন্টন যেভাবে চোখে পড়ল, তা দুর্ভাগ্যজনক।”

আশঙ্কা ছিলই, ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগেই মজুত করে রাখবে ধনী দেশগুলি। তথ্য বলছে, ভোট ভ্যাকসিনের ৩ ভাগ মাত্র দশটি দেশ পেয়েছে। যার সিংহভাগ আমেরিকা ও চিনের ঝুলিতে। হাউসটনের বায়লর কলেজ অব মেডিসিনের বিজ্ঞানী পিটার হটেজ জানান, ধনী দেশগুলো এভাবে ভ্য়াকসিন কিনে নিলে এই মহামারী রোখা অসম্ভব। মায়ানমার, পাপুয়া নিউ গিনির মতো গরিব দেশগুলিকেও ভ্যাকসিন নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে প্রায় ১৪ কোটি ভ্যাকিসন দিতে সক্ষম হয়েছে ভারত। বিপুল জনসংখ্যার দেশে ভ্যাকসিনের চাহিদা আকাশছোঁয়া। বিভিন্ন হাসপাতালে ভ্যাকসিনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এমন অরাজকতার পরিস্থিতির পিছনে সঠিক ভাবে ভ্যাকসিন বন্টন না হওয়ার অভিযোগ উঠছে এ দেশেও। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরেও সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন বন্টন না হওয়ায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের।

দেশের ভ্যাকসিন সঙ্কট প্রসঙ্গে চিকিৎসক ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এক্সপার্ট শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক জানান, এটা ঠিক, অধিকাংশ ভাগ বসিয়ে নিয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি। নিজেদের ঘর গোছাতে ফাইজ়ার, মর্ডার্নার ভ্যাকসিন বাইরে পাঠাচ্ছে না আমেরিকা। যদিও তাদের অবস্থান নিয়ে খুব একটা আশ্চর্য নই আমরা। তাঁর মতে, ভারত কিন্তু ভুল পথে হেঁটেছে। যে সময় নিজের দেশের ভ্যাকসিন প্রয়োজন ছিল, সে সময় প্রায় ৬০ লক্ষ ভ্যাকসিন পাঠিয়ে অন্যান্য দেশগুলিকে সাহায্য করেছে ভারত। প্রশ্ন উঠছে, আমাদেরই ভ্যাকসিন যখন এত কম, তখন বাইরে পাঠানোর দরকার কি ছিল?

ভ্যাকসিন সঙ্কটের আরও একটি কারণ তুলে ধরেন শুভ্রজ্যোতিবাবু। তিনি বলেন, “যে সব রাজ্যের সংক্রমণের হার বেশি, সেখানে ভ্যাকসিন পৌঁছনো দরকার। সব রাজ্যই ভ্যাকসিন পাবে। তবে, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গের মতো সংক্রমণের হার যেখানে বেশি, আমার মনে হয় উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির থেকে এখানে ভ্যাকসিন আগে দরকার।” সেরাম ইন্সটিটিউট, ভারত বায়োটেকের মতো সংস্থাই শুধুমাত্র ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে কেন বলে প্রশ্নও তোলেন শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক। তিনি বলেন, “সরকারের উচিত ভ্যাকসিন ফরমুলা কম্পালসারি করে দেওয়া। যাদের ভ্যাকসিন তৈরির কারখানা আছে, তাদেরও তৈরির সুযোগ করে দিলে, এই ভ্যাকসিনের সঙ্কট মেটানো সম্ভব হবে।”

আরও পড়ুন- ১৮ উর্ধ্বদের টিকাকরণে প্রয়োজন কত ভ্যাকসিন? কবে টিকা দেবে সেরাম? রাজ্যবাসীর যাবতীয় সংশয় দূর করলেন স্বাস্থ্যকর্তা

শুধু সংখ্যার নিরিখে নয়, জাতপাত বা বর্ণের নিরিখেও ভ্যাকসিন বন্টন হচ্ছে বিশ্বে। ব্রিটেনের এক গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। গত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৮০ বছরের উর্ধ্বে প্রায় ১১ লক্ষ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন। দেখা গিয়েছে, ভ্যাকসিন মিলেছে ৪২.৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গদের। তুলনামূলক বিচারে কৃষ্ণাঙ্গরা ভ্যাকসিন পেয়েছেন ২০.৫ শতাংশ। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়েও অসম ভ্যাকসিন বন্টন হতে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন দেশে। গবেষক উদয়কুমার জানাচ্ছেন, একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দিলেই মহামারী রোখা সম্ভব হবে না। গোটা বিশ্বের প্রতি কোণায় ভ্যাকসিন পৌঁছে দিতে হবে। যদিও আশা রাখছেন বিশেষজ্ঞরা। গোটা বিশ্বে ভ্যাকসিনের চাহিদা মেটাতে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।