‘সন্ন্যাস’ ভেঙে জোড়াফুলে যশবন্ত, মমতার মোদী-বিরোধী ভাবমূর্তিতে বড় সিলমোহর?

২৬ মে, ২০১৪। শপথ নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi)। তারপর থেকেই চিড় ধরতে শুরু করল।

'সন্ন্যাস' ভেঙে জোড়াফুলে যশবন্ত, মমতার মোদী-বিরোধী ভাবমূর্তিতে বড় সিলমোহর?
দায়িত্ব বাড়ল যশবন্ত সিনহার।
Follow Us:
| Updated on: Mar 13, 2021 | 8:07 PM

‘আমি আজ রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিলাম।’ সে দিন কথাটা শুনে তেমন চমক লাগেনি। ঘটনাক্রম যেদিকে এগোচ্ছিল পদ্মের এই পাপড়ি খসে যাওয়া যেন প্রত্যাশিতই ছিল। ২০১৮-র ২১ এপ্রিল যিনি এ কথা বলেছিলেন, তিন বছর পর সেই তিনিই যোগ দিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে (TMC)। বাংলায় একুশের ভোটের প্রাক্কালে দলবদল যখন অভূতপূর্ব ট্রেন্ড হিসাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তখন শনিবারের কলকাতায় বাজপেয়ী (Atal Bihari Vajpayee) সরকারের অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার (Yashwant Sinha) তৃণমূলে যোগদান নিঃসন্দেহে ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে।

বিদ্রোহের ‘শুরুয়াত’ বছর সাতেক আগে। দিনটা ছিল ২৬ মে, ২০১৪। রাষ্ট্রপতি ভবনে দাঁড়িয়ে সে দিন শপথ নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। আসমুদ্র হিমাচল তখন মুখরিত নমো ধ্বনিতে। দিল্লির দরবারে যখন নায়োকোচিত এন্ট্রি নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী, কোথাও কী তখন জমছিল চাপা ক্ষোভ? মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় আসার ঠিক পরই গেরুয়া শিবিরের প্রবীণ ব্রিগেডের একাংশ যেন ক্রমশ বেসুরো হচ্ছিল। তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন নাকি তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, সে বিতর্ক এখনও জারি। তবে দূরত্ব যে বাড়ছিল তা প্রশ্নাতীত। এই তালিকার অন্যতম নাম লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলি মনোহর যোশি, যশবন্ত সিনহা। মোদী-শাহ যখন ভাবমূর্তি তৈরিতে মন দিয়েছেন, তখন প্রদীপের তলায় কালির মতো এই বিষয়টা জমাট বেঁধেছে।

বাজপেয়ী আমলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছিলেন বলে গুঞ্জন শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। এরপর ২০১৫-তে বিহারের ভোটে বিজেপির হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি পাটনার ছেলে তথা বিহারের প্রাক্তন সাংসদ যশবন্ত সিনহা। আদবানী, যোশিও তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ‘দিল্লিতে হেরে যাওয়ার পরও কিছুই শেখেনি বিজেপি।’ এই সময় রীতিমতো বৈঠক হয় যোশির বাড়িতে বসে। দল না ছাড়লেও দলের কাজে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁরা।

২০১৭-তে অমিত শাহের ছেলে জয় শাহের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়েও মুখ খোলেন বাজপেয়ী সরকারের অর্থ মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক সামলানো সিনহা। পীযূষ গোয়েলের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কেন জয় শাহকে সমর্থন করে কথা বলছেন, তা নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। তবে তখনও তিনি দলেরই সদস্য। বললেন ‘বিজেপি নীতিবোধ হারিয়েছে।’ এখানেই শেষ নয়। তাঁর গলায় বারবার শোনা গিয়েছে, ‘সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে’ কিংবা ‘দেশের গণতন্ত্র বিপদের মুখে’, এই ধরনের সুর।

তবে দলে থেকে এ সব কথা হয়ত বেমানান লাগছিল প্রাক্তন আমলা যশবন্ত সিনহার, তাই ২০১৮-তে তৈরি করলেন ‘রাষ্ট্র মঞ্চ’। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আহ্বান জানালেন। প্রত্যাশিতভাবে সেখানেই এক দিন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা করলেন তিনি। স্মৃতি হাতড়ে এক সময় বললেন, ‘বাজপেয়ী তো মোদীকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।’ এমন মন্তব্য কি নিছকই একটা অজানা তথ্য নাকি, তাঁর গলায় ছিল তাচ্ছিল্যের সুর, সেটা বিতর্ক হয়েই রয়ে গিয়েছে।

তারপর তাঁকে কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে আসতে দেখা গিয়েছে। তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’র সমাবেশেও যশবন্ত সিনহার মুখে বিজেপি তথা মোদীর সরাসরি বিরোধিতা কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এ জন্য তখনও অন্য রাজনৈতিক দলে যোগদান করার দরকার হয়নি যশবন্তের। বরং যেখানেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে গলাল তোলার সুযোগ পেতেন, সেখানেই তিনি মুখর হয়েছেন।

শুধু বিজেপি নয়, আরএসএসের প্রতিও তাঁর বিরূপ মন্তব্য সামনে এসেছে আগে। নিজের বইতে তিনি লিখেছিলেন, অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন নাকি বাজেট নিয়ে বিড়ম্বনা হয়। আরএসএস-এর চাপে মন্ত্রক ছাড়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। পরে এক সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, ‘আরএসএস শুধু প্যান্ট বদলেছে, মানসিকতা নয়।’

আরও পড়ুন: ‘মমতা সেদিন এয়ার হোস্টেজ় সেজে যেতে চেয়েছিলেন…’

তবে চমক যে বাকি ছিল, সেটাই বোধ হয় আজ বুঝিয়ে দিলেন তিনি। বাজপেয়ী আমলে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সামলানো সেই নেতা তিন বছর রাজনীতিতে ফিরলেন মমতার হাত ধরে। একদিকে মমতাকে সমর্থন করছেন দেশের প্রায় সব বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দল। তেজস্বী থেকে অখিলেশ যাদব প্রত্যেকেই সমর্থনের বার্তা দিয়েছেন মমতাকে। এর মধ্যে এত বড় মাপের একজন নেতা মমতার হাত ধরে বুঝিয়ে দিলেন বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে সত্যিই জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসছে মমতার নাম। ফলাফল কী হবে, তা সময়ই বলবে। তবে যশবন্ত সিনহার যোগ দান মমতাকে আরও বৃহত্তর নেত্রীর মর্যাদা দিল, এ কথা বলাই যায়।