Buddhadeb Bhattacharjee: পুড়ে যায় জীবন নশ্বর…

Buddhadeb Bhattacharjee: তিনি প্রায় শেষ আট বছর গৃহবন্দী। খানিকটা অসুস্থতায়। আবার খানিকটা স্বেচ্ছায়! স্বেচ্চায় ক'জন পারে নিজেকে ক্যামেরার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে? লক্ষ লক্ষ মানুষ চেয়েছিলেন তিনি লাল পতাকাকে আবার তুলে ধরুন, আবার তিনি সবার সামনে ফিরে আসুন। তিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন, এসে ধরলেনও লাল পতাকা তবে হাতে নয়, বুকে মুড়ে রাখা অবস্থায়। পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...

Buddhadeb Bhattacharjee: পুড়ে যায় জীবন নশ্বর...
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Aug 09, 2024 | 8:54 PM

অভিষেক দত্ত

করোনা আবহে স্তব্ধ জীবন। মৃত্যু মিছিল। তার মাঝেই একবার করোনাতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলে ভর্তি হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পর পর মেডিক্যাল বুলেটিন। কেমন আছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী? সে সময় সুকান্ত ভট্টাচার্যের এক কবিতা নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হল। ফেসবুক খুললেই ভেসে উঠছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠ। যে কণ্ঠ আজও বলছে, “দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ, ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত, যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের। বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা, মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরধার, ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা; তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার।” না, চাওয়া পাওয়া গুলো দূরেই থাক। যেমনটা থেকে যায় কাঁচের জানলার সামনে কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়। কিংবা সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের আওয়াজে ঢাকা পড়ে যাওয়া নীল জলের গভীরতা। কিংবা পুজোর নবমীর সন্ধ্যায় ছাতিমের গন্ধে লুকিয়ে থাকা বিষণ্ণতা।

তিনি প্রায় শেষ আট বছর গৃহবন্দী। খানিকটা অসুস্থতায় আবার খানিকটা স্বেচ্ছায়! স্বেচ্চায় ক’জন পারে নিজেকে ক্যামেরার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে? লক্ষ লক্ষ মানুষ চেয়েছিলেন তিনি লাল পতাকাকে আবার তুলে ধরুন, আবার তিনি সবার সামনে ফিরে আসুন। তিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন, এসে ধরলেনও লাল পতাকা তবে হাতে নয়, বুকে মুড়ে রাখা অবস্থায়। হয়তো ‘একটি মোরগের কাহিনী’-র মতো ট্র্যাজিডিই তাঁর জীবনের অন্তে লুকিয়ে ছিল।

ট্রাজিডি। এই গল্পটা জুড়ে যেন আদ্যোপান্ত ট্র্যাজিডি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রিয় সাহিত্যিক গ্যাবরিয়াল গার্সিয়া মার্কেসের সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকের মত তিনি নিজেও কি সফল হতে পারলেন না? এই জীবন সফর সবার কি সফল হয়? ঝড় ঝঞ্ঝার মাঝে পড়ে পথভ্রষ্ট হন কত তীরমুখী যাত্রী। রাজনীতির ঝড় কি তাঁকে সেখানেই নিয়ে গেল?

না পুরোটা সেরকম নয়। বুদ্ধবাবু। বুদ্ধদা। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ওই মানুষটার গায়ে এক পয়সার কালির দাগ কেউ লাগাতে পারবে না! বলতে খুব লজ্জা করলেও, আজকাল কোটি কোটি কালো টাকার পাহাড়ের তলায় হারিয়ে যাওয়া রাজনীতিতে সত্যিই এ বড়োই বিরল। আর এই কথা আজ বহু সারদা-নারদ কান্ডে জেলখাটারাও মিডিয়ার সামনে বলছেন। এই অংশটায় তিনি অবশ্যই সফল। একজন বামপন্থীর যতটা সফল হওয়ার কথা তার থেকেও বেশি সফল। তাহলে ট্র্যাজিডি কোথায়?

আমার কাছে বুদ্ধবাবু ট্র্যাজিক হিরো। যে হিরো পর্দার আড়ালে থেকেও বারবার ফিরে ফিরে আসেন মঞ্চে। প্রায় দেড় দশক পার করেও তিনি আর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু নন। তাও আজ যখন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বাংলা থেকে হামসাফার, করমণ্ডল বা দুরন্ত এক্সপ্রেসে চেপে, মা-বাপকে ঘরে বসিয়ে রেখে পাড়ি দেন দূর দেশে, কাজের খোঁজে, একবার হলেও সিঙ্গুর, নয়াচর বা শালবনি, এই নামগুলো তাঁদের মনের ঈশান কোনে উঁকি মারে না! হয়তো মুড়ি খেতে খেতে ঠোঙায় লেখা হেডলাইনটা চোখে পড়ে, ‘সিঙ্গুরের জন্য দু’হাজার কোটি ফাইন দিতে হবে রাজ্য সরকারকে।’ আবার ফিরে আসে সিঙ্গুর। আবার ফিরে আসে স্বপ্ন। হাজার হাজার চাকরির খোঁজে দূর দেশে পাড়ি দেওয়া ছেলে মেয়ের স্বপ্ন। তার পর দরজায় কড়া নাড়ে স্বপ্নভঙ্গ।

অনেকে প্রশ্নও তোলেন, বামেদের জমি অধিগ্রহণ নীতি নিয়ে। ১৪ মার্চ ২০০৭ সালে, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানো নিয়ে। ২৩৫ আর ওরা ৩৫-এর দম্ভ নিয়ে। আজও সেই প্রশ্ন রোজ ওঠে। চায়ের দোকানে ওঠে, বিধানসভায় ওঠে। রাজ্য বছরের পর বছর ঢিমেতালে পিছনে হাঁটে। ভোট আসে, ভোট যায়। এখনও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হটস্পট হয়। পরিযায়ীদের বাড়ির বউটা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আশায় লাইনেও দাঁড়ায়। সংসারের অলক্ষ্মীকে দূরে রাখতে হয়তো ভোটও দেয় কোনও এক ফুলে। কিন্তু তার কি বুদ্ধবাবুর মুখটা বা কথাগুলো একবারও মনে পড়ে না? ‘শিল্প না হলে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কী করবে? কোথায় যাবে? আমাদের কারখানা দরকার। বড় বড় কলকারখানা দরকার’।

নতুন শতাব্দীর গোড়ায় মানুষ এক নতুন বামফ্রন্টকে দেখেছিল। এক উদারপন্থী মনোভাবাপন্ন বাম। ঢেলে সাজছিল নতুন করে সবকিছু। ঢেলে সাজছিল সিপিএমও। অনিল-বুদ্ধ জুটি তখন একের পর এক মাস্টার স্ট্রোক খেলছে। চুম্বক সত্যিই বিপরীত মেরুকে আকর্ষণ করে! দুই মেরুর দুজন মানুষ একজোট হয়ে যেন পাল্টে দিচ্ছিলেন সরকারের চলার পথ থেকে শুরু করে পার্টির খোলনলচে। কিন্তু ২০০৬ সালে ভোটের আগেই নক্ষত্রপতন। অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পরেই যেন একের পর এক কমেডি অফ এররস। শচীন যদি ভেঙ্কটেশ প্রসাদের সঙ্গে ব্যাট করে, যেমনটা হওয়ার কথা ঠিক তেমনই হচ্ছিল। এগারো সালে বাম বিদায়ে যেন শিল্পায়নের সেই স্বপ্নও চুরমার হয়েছে। আর হয়তো কেউ আশাও করে না! যে রাজ্যে মানুষ একশো দিনের কাজের টাকা পায় না, সেখানে তো শিল্পায়নটা একটু বাড়াবাড়ি, তাই না!

কিন্তু কখনও কোথাও ওই গলাটা শুনলে যেন মনে আবার উন্মাদনা জেগে উঠতো। হয়তো মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতো। লাল কোনও এক ভোরের স্বপ্ন। যতই লোকসভা, বিধানসভায় শূন্য হোক সিপিএম! বুদ্ধবাবু শুধু পলিটিকাল লিডার নন। এই বাংলায় জড়িয়ে থাকা এক আবেগ। জ্যোতি বাবুর হাত ধরে ভূমি সংস্কার থেকে বুদ্ধবাবুর শিল্পের পথে হাঁটার আবেগ। সেই আবেগেই ভেসে গেছেন কত মানুষ।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

আর এই আবেগের কথা বলতে মনে পড়ল, আমার এক বন্ধুর কথা। সে বার বার বলে, তার বাবা আর লালপার্টির ইমোশনের গল্প। সে আবেগ শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া রক্তের রঙের মতোই রঙিন। নদীয়া জেলায় তাদের বাড়ি। যে সময়টা জ্যোতিবাবু গ্যালারিতে ফিরছেন আর বুদ্ধবাবুর মাঠে নামার পালা। গল্পটা সেই সময়ের। এক স্মুথ ট্রান্সিশনের ব্রিগেড। নদীয়া থেকে সেই লাল পতাকায় ঢাকা সবুজ গালিচায় যাওয়ার আগে তার বাবা শোলা দিয়ে একটা কাস্তে-হাতুড়ি বানালেন। তার মধ্যে আঁকলেন বুদ্ধবাবুর আর জ্যোতিবাবুর মুখ। ব্রিগেডের মাঠে গিয়ে তুলে ধরেছিলেন সেই আর্ট ওয়ার্ক। তারপর তাকে ফিরিয়েও এনেছিলেন সযত্নে। এবার বছর পঁচিশ ফাস্ট ফরওয়ার্ড করি। আজও সেই শোলার মূর্তি রয়ে গেছে। ওর বাবা আর নেই, কিন্তু ওই কাস্তে হাতুড়িতে বুদ্ধবাবুর মুখটা আছে। কারণ একটাই, বুদ্ধবাবুর মত নেতারা একাধিক জেনেরেশনের ইমোশান। আর বুদ্ধবাবু নিজেও সেই ইমোশনকেই বয়ে নিয়ে চলেছিলেন বছরের পর বছর। না হলে আজকালকার দিনে ভোটে হেরে কেউ গৃহবন্দী হয়? ইমোশনাল না হলে রাইটার্স বিল্ডিঙে বসে কাফকা, কামু পড়া যায়? পড়া যায় পাবলো নেরুদার কবিতা? কবিতা আর পলিটিক্সকে একই ছন্দে বাঁধা যায়? একবার এক সাংবাদিক বুদ্ধবাবুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ”আপনি কমিউনিস্ট রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে, কবিতা পড়েন, কবিতা লেখেন আবার অনুবাদ করেন, কীভাবে?”

উত্তরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভ্লাদিমির মায়কোভস্কিকে কোট করে বলেছিলেন, ”Proletarians arrive at communism from below – by the low way of mines, sickles, and pitchforks – But I, from poetry’s skies, plunge into communism, because without it I feel no love.”

আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)