মাওবাদীরা যদি ধর্ষণ-বিরোধী মিছিলে হাঁটে সমস্যা কোথায়? সমাজের ‘আত্মপরিচয়’ লিখে গেলেন সৌমিত্র
প্রত্যেক পাতাই দলিল। 'অপরাজিত'র জীবন দলিল। যে দলিলের গুরুত্ব অপরিসীম। সবটাই যেন অথৈ সমুদ্রের অবিরত ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভিজতে কার না ভাল লাগবে।
‘অপুর সংসারের’ সেই চিরন্তন দৃশ্য, যার বর্ণনা দিচ্ছে স্বয়ং ‘অপু’র কলম। ‘দাদু’ খেলনা ট্রেন হাতে দাঁড়িয়ে দেখছে, আর ‘কাজল’ চলেছে ‘অপু’র কাঁধে চড়ে। বাউলপনা ‘অপু’র মুখে যেন সব প্রাপ্তির হাসি। এই ফ্রেম আজও আবেগে মোড়া রয়েছে যে কোনও বাঙালির মনে। কিন্তু আজ ‘অপু’ থাকলেও নেই তাঁর ছায়া। নেই সৌমিত্র! এই মুহূর্ত তিনি বিলক্ষণ জানতেন। আর জানতেন বলেই তিনি আপামর পাঠকের কাছে রেখে গেলেন তাঁর ‘আত্মপরিচয়’।
তবে, আত্মজীবনী লেখেননি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়(Soumitra Chatterjee)! আত্মজীবনীর আধারে লিখে গিয়েছেন টুকরো টুকরো ভাবনা, স্মৃতি আর নিজের মতাদর্শ। প্রারম্ভ কথা থেকে প্রুফ রিডিং সবটা করেও হলুদ মলাটে মোড়া বইটা দেখে গেলেন না। যে আক্ষেপ প্রকাশক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের মুখের অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। তবে বিষাদের মাঝেও যেন আলতো আনন্দ, সৌমিত্রদার নিজের হাতে তৈরি শেষ বই বলে কথা।
১৮ নভেম্বর, ২০১৯ সৌমিত্রবাবু পাণ্ডুলিপি দিলেন ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে। ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রারম্ভকথা-সহ সম্পূর্ণ কাঠামো প্রস্তুত। কিন্তু ২৩ মার্চ থেকে লকডাউন। স্বভাবতই গতিতে রাশ। তবে তাড়াহুড়ো করতে নিজেই চাননি সৌমিত্র। বলেছিলেন, “বইমেলায় দরকার নেই। বইটা টার্গেট করো পয়লা বৈশাখ। কী, তার মধ্যে হবে না?” কিন্তু কে জানত কার্তিকের ভরা আলোর মাঝেই চলে যাবেন ‘ময়ূরবাহন।’
বইটিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন তাঁর স্বপ্নসুন্দরীর কথা। বর্ণনা দিচ্ছেন তাঁর মতাদর্শের। তবে ফিরে ফিরেই মানিকদা। যদি প্রশ্ন করা হয় ‘অপু ত্রয়ী’তে মোট কতবার রেলগাড়ি দেখা গিয়েছে। ভাবতে হবে বইকি। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই রেলগাড়ি রূপক। প্রথম যেদিন কাশ বন পেরিয়ে ‘অপু’ রেল দেখে তা যেমন বাস্তবের সঙ্গে ‘অপু’র পরিচয়, তেমনই ‘হরিহর’-এর মৃত্যুর পরেও রেল। ‘অপু’র পটুয়াতোলা আসাতেও রেল। এরপরেও বারবার ফিরে এসেছে আধুনিকতার এই প্রতীক। সেই রেলগাড়ির কথাও বলেছেন সৌমিত্র।
তবে শুধু অপু কিংবা সেলুলয়েড নয়। বইটিতে পাতায় পাতায় সৌমিত্রর জীবনের ছাপ। প্রকাশকের কথায়, “এই বইটা একটা অদ্ভূত বই। এখানে শুধু ওঁনার স্মৃতিকথা নেই। ওঁনার ভাবনা আছে। ওঁনার অবলোপন আছে সমাজের প্রতি। উনি এখানে বামপন্থা নিয়ে বলছেন। ওঁনার নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে বলছেন। আবার নিজের ছেলেবেলা নিয়েও বলছেন।”
সত্যিই কটা বাংলা সিনেমায় মিছিলের দৃশ্য দেখানো হয়! শিল্প-সাহিত্যে আদৌ কি ‘সর্বস্তরের’ মিছিল উঠে আসে? ‘আত্মপরিচয়ে’ এই নিয়েও লিখেছেন সৌমিত্র। তবে তাঁর কাছে সর্বস্তরের মিছিল হল কামদুনির প্রতিবাদ মিছিল। তবে আলগা করে ‘সর্বস্তর’ কথাটা ব্যবহারের পক্ষপাতীও নন তিনি। কিন্তু তাঁর সাফ কথা, যদি ধর্ষণ বিরোধী একটা মিছিলে মাওবাদী আসে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেউ নন্দীগ্রামে ছিল না বলে কামদুনিতে কেন থাকবে? এই প্রশ্ন তাঁর কাছে বিভাজনে উস্কানি ছাড়া অন্য কিছু না।
৯ অগস্ট, ১৯৫৮ ‘অপু’ তখন চাকরি খুঁজছে। এই দিনটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন সৌমিত্র। বাকি আর দশটা দিন মনে না থাকলেও তাঁর কাছে এই দিনের স্মৃতি ছবির মতো পরিষ্কার। ফিল্ম ক্যামেরার সামনে প্রথম তিনি। সে কথাও ‘আত্মপরিচয়ে’ গুছিয়ে বলেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিংবা ‘ঝিন্দের বন্দী’র শুটিংয়ের ফাঁকে উত্তমদার সঙ্গে লম্বা আড্ডা, তারও টুকরো কথা দিয়ে মালা গেঁথেছেন এই বইয়ে। ব্যাংককের রাস্তায় রিভলভার দেগে গুলি চালানো হয় কিন্তু বাড়ির পাশে বাঁশ পেটা খেয়ে মরে যাওয়া লোকটাকে নিয়ে কথা বলা হয় না, অধুনা বাংলা সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়েও আক্ষেপ উগড়ে দিয়েছেন সৌমিত্র।
প্রত্যেক পাতাই দলিল। ‘অপরাজিত’র জীবন দলিল। যে দলিলের গুরুত্ব অপরিসীম। সবটাই যেন অথৈ সমুদ্রের অবিরত ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভিজতে কার না ভাল লাগবে। তবে আপাদমস্তক সাংস্কৃতিক মানুষের চলে যাওয়া যে বাংলার অপূরণীয় ক্ষতি তা বলার বাকি থাকে না। সামনের বই মেলায় তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বিশেষ অনেক কিছুই ভাবা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিই একমাত্র বাধা। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে গিল্ড সভাপতি তথা প্রকাশক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সৌমিত্রবাবু একজন প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি প্রতিভা। উনি তো শুধুমাত্র অভিনেতা নন। কিংবা শুধুমাত্র নায়ক বা নাটকের মানুষ নন। উনি একজন পুরোপুরি সাহিত্য ও সংস্কৃতির মানুষ। সুতরাং বইমেলার সঙ্গে ওনার সম্পর্কটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বইমেলাতে ওঁকে নিয়ে আমাদের অনেক কিছু ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কতটা করতে পারব সেটা জানি না”
আরও পড়ুন: কিষেণজী হত্যা তৃণমূল সরকারের ভুল ছিল: ছত্রধর
আরও পড়ুন: মমতা লড়ুক, আমরাও লড়ব, বিজেপি বিরোধিতার প্রতিযোগিতা হোক: দীপঙ্কর ভট্টাচার্য