Protest: ৫০০ দিনের ধর্না! হকের চাকরি পেতে কি ইতিহাসেও জায়গা করে নিলেন ওঁরা?

দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একটানা ৫০০ দিন ধর্নায় বসে রয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এ রকম দৃশ্যে কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না।

Protest: ৫০০ দিনের ধর্না! হকের চাকরি পেতে কি ইতিহাসেও জায়গা করে নিলেন ওঁরা?
মমতার অনশন (বাঁদিকে উপরে), আন্দোলনরত কৃষকরা (উপরের ডানদিকে), শাহবাগ আন্দোলন (নীচের বাঁদিকে), গান্ধীমূর্তির পাদদেশে অনশনরত চাকরিপ্রার্থীরা
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jul 27, 2022 | 8:44 PM

কলকাতা: আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের থেকে কখনও দাবি আদায়। কখনও আন্দোলনের জেরে সরকারকে গদিচ্যূত করা বা দুর্নীতির প্রতিবাদ। এ বিশ্ব বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে। এ দেশের আন্দোলনের ইতিহাসটাও কম নয়। খোদ কলকাতা শহরই থেকেছে বহু আন্দোলনের সাক্ষী। কিন্তু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একটানা ৫০০ দিন ধর্নায় বসে রয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এ রকম দৃশ্যে কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। সেই দৃশ্যই দেখা গেল মহানগরের বুকে ধর্মতলার গান্ধীমূর্তি পাদদেশে। সৌজন্যে রাজ্যের শিক্ষকতার চাকরিপ্রার্থীরা। যে তিন কৃষি আইন নিয়ে করোনাকালে উত্তাল হয়েছিল দেশ। লক্ষ লক্ষ কৃষক পথে নেমেছিলেন আইন প্রত্যাহারের দাবিতে। আন্দোলনকারী কৃষকদের অনড় মনোভাব দেখে কেন্দ্রের সরকারও তিনটি আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সেই কৃষকদেরও পুরোপরি এক বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। এক বছর পূর্ণ হওয়ায় দিন কয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রীর আইন বাতিলের ঘোষণা জিতিয়ে দেয় কৃষক আন্দোলনকে। কিন্তু ৫০০ দিন ধরনার পরও, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরিতে নিয়োগ মেলেনি হবু শিক্ষকদের।

তথ্য বলছে, ৫০০ দিন ধরে আন্দোলনের নজির খুব কমই রয়েছে দেশে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক অনুন্নত দেশে অবশ্য দুর্নীতি, একনায়ক তন্ত্র কায়েম করে রাখা শাসককে উৎখাত করতে বছরের পর বছর লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু প্রেক্ষাপটের নিরিখে ধরলে তা অনেকটাই বৃহৎ। সেখানে দেশের জনগণ সরাসরি যুক্ত থাকেন আন্দোলনে। কিন্তু গান্ধীমূর্তির পাদদেশে ধরনা সঙ্গে সে সবের সরাসরি তুলনায়ও চলে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ধর্না এই আন্দোলনকে অন্য উচ্চতায় বসিয়েছে।

দেশে কৃষি আন্দোলন

মোদী সরকারের আনা নয়া কৃষি বিল সামনে আসতেই পঞ্জাবে শুরু হয় এই আন্দোলন। সংসদে তা পাশ হতেই আগুন ঘি পড়ে। লক্ষাধিক কৃষক এসে জড়ো হন রাজধানীর দিল্লির বিভিন্ন সীমানায়। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর থেকেই কৃষকরা দিল্লির বিভিন্ন সীমানয় জড়ো হওয়া শুরু করেন। তার পর যত দিন গড়িয়েছিল, তত ঝাঁঝ বেড়েছিল এই আন্দোলনের। শতাধিক কৃষক প্রাণও হারিয়েছিলেন আন্দোলনে যোগ দিয়ে। দিল্লির বুকে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত অশান্তির সাক্ষীও থেকেছে দেশবাসী। কৃষকদের অনড় মনোভাবনের সামনে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর নয়া তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই ঘোষণা পর আন্দোলনের জয় ঘোষণা করে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন।

বিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলন

শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখুন। সেখানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভেঙে পড়তেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভ গিয়ে পরে ক্ষমতাসীন সরকারের উপর। ২০২২ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রীকে গদি ছাড়তে হয়। আন্দোলনের তীব্রতায় দেশ ছাড়তে হয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে। তাঁর বাসভবনের দখল চলে গিয়েছিল আন্দোলনকারীদের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদে কয়েক সপ্তাহ বসার পরই রণিল বিক্রমসিঙ্ঘেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করতে হয়।

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন ঘিরে উত্তাল হয়েছিল বাংলাদেশ। ঢাকার রাজপথ সাক্ষী থেকেছিল বিশাল সংখ্যক জনতার জমায়েতের। সেই আন্দোলনের দাবি মিটতেও এক বছর অপেক্ষা করতে হয়নি আন্দোলনকারীদের। দেশের স্বাধীনতার ভাবাবেগ জড়িয়ে ছিল সেই আন্দোলনে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের দাবি পূরণ হয়েছিল ডিসেম্বরেই। কিন্তু ৫০০ দিন ধরে ধরনা দিয়েও হকের চাকরিটুকু জোটেনি আন্দোলনকারীদের। কেন? রাজ্য সরকারে উদাসীনতাই এর মূলে? উঠছে প্রশ্ন।

কয়েক বছর ধরে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে লেবানন ও ইরাক। লেবাননে ২০১৯ সাল থেকে জ্বালানি, তামাকজাত দ্রব্য এবং হোয়াটসঅ্যাপ কলে কর বসানোর পর থেকেই আন্দোলেনে নামে সাধারণ মানুষ। ২০২০ সালে তাইল্যান্ডে শুর হওয়া সরকার বিরোধী আন্দোলন এখনও চলছে। ইরাকে ২০১৯ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। সে দেশের যুবরা এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। এক প্রধানমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হয়েছে আন্দোলনের জেরে। কিন্তু দাবি পুরোপুরি না মেটায় আন্দোলন এখনও সক্রিয়।

সিএএ-এনআরসি

গত কয়েক বছরে কলকাতাকেও বিক্ষোভ কম হয়নি। এনআরসি, সিএএ ইস্যুতে করোনাকালের আগে বার বার উত্তাল হয়েছে মহানগরীর রাজপথ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আসাকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন বিক্ষোভের সাক্ষী থেকে ধর্মতলা চত্বর-সহ গোটা কলকাতা তাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ জুড়ে চলতে থাকা এই সব আন্দোলনের জেরে সিএএ, এনআরসি কার্যকরের বিষয়টি হিমঘরে ঢুকে রয়েছে। বিজেপি নেতারা কোথাও কেউ এনআরসি- সিএএ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দেন। কিন্তু শাহ-মোদীরা এটি লাগু করার ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করেন না।

মমতার আন্দোলন

সেখানে গান্ধীমূর্তি পাদদেশে ধর্নায় বসা চাকরিপ্রার্থীদের দাবিটা কী? এসএসসি-তে পাশ করেছেন তাঁরা। মেরিট লিস্টেও নাম রয়েছে। তবুও চাকরিতে নিয়োগ মেলেনি। তাই তাঁদের চাকরিতে নিয়োগ করতে হবে। এই দাবি টুকু নিয়ে ৫০০ দিন ধরে ধরনা দিচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তাঁদের প্রতি উদাসীন। এই সরকারেরই মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী থাকার সময় দিনের পর দিন বিভিন্ন ইস্যুতে বাম সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন, তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পিছনে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের মতো আন্দোলনের বড় ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা স্বয়ং ৩৫ দিন ধর্নায় দিয়েছিলেন এই ধর্মতলাতেই। এখনও ক্ষমতায় বলেই কী আর আন্দোলনের ব্যাপারে এই উদাসীনতা?

৫০০ দিন ধরে চলা এই ধর্নার  প্রভাব রাজ্য রাজনীতিতে একেবারেই পড়েনি। এ কথাও বলা যাবে না। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলা হাইকোর্টে পৌঁছেছে। বিচারপতিদের নির্দেশে সেই মামলার তদন্তভার গিয়েছে ইডি, সিবিআই-এর হাতে। ইতিমধ্য়ে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতির অভিযোগ গ্রেফতার হয়েছে ইডি-র হাতে। তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। কিন্তু এই টুকুতেই থামতে চাননা নিয়োগের দাবিতে খোলা আকাশের নীচে ধরনা দেওয়া আন্দোলনকারীরা। দাবি যত দিন আদায় না হচ্ছে, তত দিন আন্দোলন চালিয়ে যেতে বন্ধ পরিকর তাঁরা। তাঁদের এই মনোভাবই শহরের বুকে তৈরি করছে আন্দোলনের নতুন ইতিহাস।