বিশ্লেষণ: কেবলই কি শহিদ স্মৃতি? নাকি ২১ জুলাইয়ে লুকিয়েছিল তৃণমূল তৈরির বীজও

21 July: ১৯৯৩ সালে ২১ জুলাই তাঁর নেতৃত্বে রাইটার্স অভিযানে তরতাজা ১৩টি প্রাণ ঝরে যায়। আর সেই দিনটিকেই পাথেয় করে বঙ্গ রাজনীতিতে স্বতন্ত্র জায়গা করে নেন মমতা।

বিশ্লেষণ: কেবলই কি শহিদ স্মৃতি? নাকি ২১ জুলাইয়ে লুকিয়েছিল তৃণমূল তৈরির বীজও
অলঙ্করণ: সোমনাথ মিত্র
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 22, 2022 | 1:16 PM

 কলকাতা: ২১ জুলাই। বঙ্গ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে ক্যালেন্ডারের এই দিনটি। নিছকই কোনও রাজনৈতিক দুর্ঘটনা হিসাবে নয়। গঙ্গা দিয়ে যত জল বয়েছে, এই দিনটির তাৎপর্যও আরও নিগূঢ় হয়েছে। সৌজন্যে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। ১৯৯৩ সালে ২১ জুলাই তাঁর নেতৃত্বে রাইটার্স অভিযানে তরতাজা ১৩টি প্রাণ ঝরে যায়। আর সেই দিনটিকেই পাথেয় করে বঙ্গ রাজনীতিতে স্বতন্ত্র জায়গা করে নেন মমতা। প্রতি বছর নিয়ম করে ২১ জুলাই শহিদ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে তৃণমূল (TMC)। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম ২১ জুলাই। সর্বভারতীয় দল হিসাবে তৃণমূলকে আরও আনাচ-কানাচে পৌঁছে দিতে হাতিয়ার করা হয়েছে এই দিনটিকে। কিন্তু আড়াই দশক আগে কী ঘটেছিল সে দিন? আর কীভাবেই সেই দিনটি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল?

ফিরে দেখা ২১ জুলাই সাল ১৯৯৩। বাংলার মসনদে তখন জ্যোতি বসুর সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুব প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। তৃণমূল কংগ্রেসের তখনও জন্ম হয়নি। কংগ্রেসনেত্রী হিসেবেই সর্বজনবিদিত মমতা। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনবার জন্য সচিত্র ভোটার কার্ডের দাবি তোলেন মমতা। সেই দাবি নিয়ে তত্‍কালীন রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিবালয় মহাকরণ অভিযানের ডাক দেওয়া হয় কংগ্রেসের তরফে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন জননেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। মহাকরণ অভিযানের জন্য রাস্তায় নামেন কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকেরা। ব্যারিকেড গড়ে মহাকরণ অভিযান রুখতে তত্‍পর হয় পুলিশও। অভিযোগ, সেই মিছিলেই আচমকা গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। গুলিতে নিহত হন ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী। আহত হন মমতাও। গুলিকাণ্ডের ঘটনায় কার্যত তত্‍কালীন বাম সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বিরোধীরা। ১৩ জনের সেই মৃতদের তালিকায় ছিলেন শ্রীকান্ত বর্মা, বন্দনা দাস, দিলীপ দাস, মুরারি চক্রবর্তী, রতন মণ্ডল, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী,রঞ্জিত্‍ দাস, প্রদীপ রায়,আব্দুল খালেক এবং ইনু মিঞা।

21 JULY 1993

মহাকরণ অভিযান, ছবিসূ্ত্র: অল ইণ্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস

মমতার উত্থান মহাকরণ অভিযানে এই গুলিকাণ্ডের পরেই কার্যত কেবল সাংসদ হিসেবে নন, এক বিরোধী মুখ হিসেবে পরিচিত হন মমতা। আর ঠিক সেই বছরেই অর্থাত্‍ ১৯৯৩-তেই প্রথম নিজের দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুর তোলেন মমতা। অভিযোগ, তত্‍কালীব বাম সরকারকে সহায়তা করছে দল কংগ্রেস। দলের একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে এক ‘পরিচ্ছন্ন কংগ্রেসের’ দাবি জানান তিনি। আশিস চক্রবর্তীর ‘থেরাটিক্স অব বেঙ্গল টাইগ্রেস’ বলছে, কলকাতর আলিপুরে একটি জনসভায় গলায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্য়ার হুমকিও দিয়েছিলেন মমতা।

বিশ্লষেকরা বলছেন, অধুনা তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনৈতিক ইনিংসে নজর দিলেই দেখা যাবে, যে ধরনের প্রতিবাদ বারবার মমতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তার মূল ভিত্তিই ছিল জন আবেগ। কংগ্রসের হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে সরকারি ঔদাসীন্যের অভিযোগ তুলে ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন নেত্রী। ১৯৯৩-তে যে ভিন্ন জনমত পরিপুষ্টির লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়েছিলেন মমতা, ১৯৯৭ সালে সেই লক্ষ্যে উন্নীত হন তিনি। কংগ্রেসের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস স্থাপন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লক্ষ্যণীয় সেই বছরেও ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভায় রেল বাজেট পেশের দিন তদানীন্তন রেলমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দিকে শাল নিক্ষেপ করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন মমতা। তারপরেই সাংসদ পদে ইস্তফা দেন তিনি।

MAMATA BANERJEE 1993

তত্‍কালীন কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবিসূত্র: অল ইণ্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস

২১ জুলাই ঘটনার তদন্ত: মহাকরণ অভিযানে কার নির্দেশে গুলি চালানো হয়েছিল, কেন চালানো হয়েছিল তা জানা যায়নি। তত্‍কালীন জ্যোতি বসুর সরকার তদন্ত করলেও কোনও পুলিশ কর্মীর শাস্তি হয়নি। ক্ষমতায় এলে ২১ জুলাইয়ের ঘটনার তদন্ত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর, ২০১২ সালের গোড়ায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন মমতা। প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়কে কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাক্ষ্য দেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচারপতিকে তিনি জানিয়ে দেন, অনেক খোঁজ করেও ২১ জুলাইয়ের ঘটনা নিয়ে তার আগে বা পরের কোনও ফাইলের হদিশ পাওয়া যায়নি। কেন ফাইল পাওয়া গেল না তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য় সরকার। পাল্টা, তৃণমূলের তরফে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় অভিযোগ করেন বাম সরকার পরিকল্পিতভাবে তাঁদের বহু দুর্নীতির ফাইল লোপাট করেছেন।

আন্দোলনের ‘মুখ’ মমতা কাট টু ২০০৭। আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে কলকাতা থেকে প্রায় ১৩২ কিলোমিটার দূরে পূর্ব মেদিনীপুরের এই ছোট্ট একটি অখ্যাত গ্রাম রাতারাতি খবরের শিরোনামে চলে আসে। ১৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীর উপরে নির্বিচারে চলেছিল গুলি। বেঘোরে প্রাণ গিয়েছিল তাদের। তা দেখে শিহরিত হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। ২০০৭। সালেম গোষ্ঠীর ক্যামিক্যাল হাব তৈরির জন্য নন্দীগ্রামে ১০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সরকার। ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকরা অবশ্য রুখে দাঁড়াতে পারেননি। আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর ফলে আটকে গিয়েছিল সালেম গোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম, খেজুরি-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক এলাকা। বাম সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়াতে সেই সময় নন্দীগ্রামেও ছুটে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

MAMATA BANERJEE 1993, 21 JULY

আহত মমতা, ছবি: অল ইণ্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস

নন্দীগ্রাম কাণ্ডের ঠিক এক বছর আগে ২০০৬ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের একটি সিদ্ধান্তে আগুন জ্বলেছিল শান্ত সিঙ্গুরে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য টাটা সংস্থার ন্যানো গাড়ি প্রকল্পের জন্য (অনুসারী শিল্প) হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেন। সংখ্যায় কম হলেও জমি না দিতে চেয়ে প্রতিবাদ মুখর হন ‘অনিচচ্ছুক কৃষকরা’। সে বারেও কৃষকদের পাশে ছিলেন অধুনা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২১ জুলাইয়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য:

তিনটি পৃথক আন্দোলন। পৃথক স্থান-কাল। কংগ্রেস নেত্রী থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো তারপর মুখ্যমন্ত্রী; মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতার শৃঙ্গারোহণের নেপথ্যে বারবার এসেছে বিতর্ক, এসেছে আন্দোলন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৯৩ সালে মহাকরণ অভিযানের অগ্নিগর্ভ পরিণতির পরেই কার্যত পৃথক আন্দোলনের সুর তুলতে শুরু করেন মমতা। কিন্তু কেন? ‘পরিচ্ছন্ন কংগ্রেসের’ যে ডাক তিনি দিয়েছিলেন তা কি পরিকল্পিত নয়? ২১ জুলাইয়ের মধ্যেই কি তৃণমূল তৈরির বীজ লুকিয়ে ছিল?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, ২১ জুলাইয়ের মহাকরণ অভিযানের একক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মমতা। আসলে সেই দিনেই পৃথক তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মের বীজ পোঁতা হয়েছিল। ওই আন্দোলন তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনৈতিক ইনিংসের প্রথম একক নেতৃত্বাধীন আন্দোলন। পরবর্তীতে যখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন হয়, ততদিনে তৃণমূল পৃথক পরিচিতি লাভ তো করেছেই এমনকী খেটে খাওয়া ‘তৃণমূলী’ মানুষদের মনে জায়গা করতে পেরেছে। একুশের নির্বাচনেও ‘ঘরের লড়াইয়ে’ বেশি জোর দিয়েছে তৃণমূল। মহিলাদের অগ্রাধিকার, বিনামূল্যে রেশন, ‘দুয়ারে সরকার’-এর মতো কর্মসূচি জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রতিবার এই আস্থা অর্জনই আসলে একধাপ করে এগিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আরও পড়ুন: ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামের ‘কুরুক্ষেত্রে’ কেন এলেন মমতা?