Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: দশম পর্ব, দু’দিন সময় নিয়ে বাইকে বোলপুর-শান্তিনিকেতন যেতে হলে, হল্ট নেবেন কোথায়-কোথায়?
Shantiniketan-Bolpur: আমরা সবাই জানি বসন্ত উৎসবের সময় শান্তিনিকেতন আসার অভিজ্ঞতা দুর্দান্ত। তার সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, বর্ষাকালে শান্তিনিকেতনের রূপ এবং প্রকৃতি সত্যিই অসাধারণ দেখায়। যেখানে অজয়, কোপাই নদ এই প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে।
গত দু’সপ্তাহের নবাবি মেজাজ সঙ্গে নিয়ে এই সপ্তাহে চলুন ঘুরে আসি মাটিতে পা ফেলে, রাঙ্গামাটির দেশে—যেখানে গাছপালার মধ্য দিয়ে পড়াশোনা শেখা, আরও সহজ করে নিজেকে জানা, অনেক কিছু জেনে আবার সেই রক্তকরবীর মধ্যেই সব বিসর্জন করা… এখানকার নির্মলতা এবং সরল সৌন্দর্যই আমাদের মতো পর্যটকদের বারবার সেখানে ফিরে যেতে আকৃষ্ট করে। আর এখানে বসন্ত উৎসবে সারা প্রকৃতি নিজের মধ্যে লাল পলাশ ফুলের মাধ্যমে আবির খেলে। যখন থেকে আমি ‘সহজপাঠ’ বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই এই জায়গার প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। বড়-বড় স্কুল কলেজ আর সেটা যে পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় গাছ (ছাতিম)-এর তলায় হতে পারে, সেটা এখানে না গেলে বোঝা যায় না। আর বোঝা যায় না কীভাবে ভালবেসে একটা জায়গাকে সুন্দর থেকে সুন্দরতরে পরিণত করা যায়। জানি সবাই বুঝতে পেরেছেন আজ বোলপুর- শান্তিনিকেতন নিয়েই কথা হবে। চলুন দু’দিন সময় বের করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে।
আমরা সবাই জানি বসন্ত উৎসবের সময় শান্তিনিকেতন আসার অভিজ্ঞতা দুর্দান্ত। তার সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, বর্ষাকালে শান্তিনিকেতনের রূপ এবং প্রকৃতি সত্যিই অসাধারণ দেখায়। যেখানে অজয়, কোপাই নদ এই প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে। তার সঙ্গে আপনি যদি শনিবার শান্তিনিকেতনে পৌঁছন, তাহলে সেই দিন আপনার একমাত্র কাজটি হল সোনাঝুরির খোয়াইয়ে শনিবারের হাট (স্থানীয় শনিবারের বাজার) ঘুরে আসা। এই শালের জঙ্গল দেখতে-দেখতে এক অবিশ্বাস্য রোম্যান্টিক অনুভূতি হয়। শুধু শালই নয়, গ্রামের ভিতরের দিকে সোনাঝুরি গাছ দেখে হয় এক অনন্য় অনুভূতি যায়। তাই রঙিন বাজারটি বনের মধ্যে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মাঝেমাঝে আবার প্রাণবন্ত বাউল গান শোনা যায় এবং আদিবাসীদের ঢোলের তালে নাচতে দেখা যায়। এখানে ভাল না লাগার কিছু নেই। তার সঙ্গে আছে রবি ঠাকুরের বাড়ি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বল্লভপুর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ডিয়ার পার্ক, এবং সৃজনী শিল্পগ্রাম… এছাড়াও অনেক কিছু। চলুন দেরি না করে অনেক কিছু দেখতে বেরিয়ে পড়ি কলকাতা থেকে বোলপুরের উদ্দেশ্যে। যা মোটামুটি বর্ধমান হয়ে গেলে ১৬০ কিলোমিটার রাস্তা।
বাড়ি থেকে সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়ুন। ব্রেকফাস্ট না করলেও ক্ষতি নেই। আমি যতবারই নর্থ বেঙ্গল কিংবা নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার দিকে যাই, ততবারই বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট না-করে বেরিয়ে শক্তিগড়ে গরম-গরম কচুরি আর ল্যাংচা খাই। আর তার সঙ্গে বাইকটাকেও একটু জিরিয়ে নিতে দিই। তারপর সোজা বাইক স্টার্ট দিয়ে জিটি রোড ধরে বর্ধমান সিটি পার হয়ে ঠিক নবাবহাটের কাছে জিটি রোডকে বিদায় দিয়ে ডান দিক ধরে পৌঁছে গেলাম ১০৮টা শিব মন্দির। শিব মন্দিরে সকাল-সকাল ভগবানের দর্শন করে বেরিয়ে পড়লাম তালিত রেল লেভেল ক্রসিং। এই ক্রসিংয়ে আমাকে আধ ঘণ্টার উপরে দাঁড়াতে হয়েছে। কারণটা হল তিনটে এক্সপ্রেস ট্রেন, দু’টো মালগাড়ি এবং একটি লোকাল ট্রেন ক্রস করে এখান দিয়ে। রাস্তায় দু’টো অ্যাম্বুল্যান্সও ছিল। সাধারণ মানুষের কষ্টের কোনও শেষ নেই। যাই হোক, একটু বিরক্ত হয়ে তারপর বেরিয়ে পড়লাম বোলপুরের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় আর কোথাও দাঁড়াতে হয়নি। শুধু বাগবাটির কাছে ফ্লাইওভারের কাজ হওয়ার জন্য রাস্তাটা একটু খারাপ, কোথাও বা হাঁটু অব্দি জল জমে আছে। এর পরের রাস্তায় আর না দাঁড়িয়ে সকাল-সকাল চলে এলাম বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখার জন্য বিখ্যাত। এই ক্যাম্পাসেই রয়েছে সেই বিশাল বড় ছাতিম গাছ আর বড়-বড় বটগাছ, যার নিচে তখনকার দিনে পড়াশোনা চলত। আরও আছে এখানকার নতুন করে সংস্কার করা ছোট-বড় ক্যাম্পাস, যা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এর সঙ্গে বর্ষাকালের প্রকৃতি এতটাই জীবন্ত যে, মনে হয় গাছগুলো আপনার সঙ্গে কথা বলছে।
এছাড়াও আপনি দেখে নিন একই রাস্তার উপরে অবস্থিত উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি যা এখন ‘রবীন্দ্র ভবন মিউজিয়াম’ নামে পরিচিত। এখানে রবি ঠাকুরের সেই চার চাকাও আছে, যাতে চেপে তিনি জমিদারির কাজকর্ম করতেন। চার চাকাটি কাচের মধ্যে থাকার ফলে ছবিতে ঠিকঠাক এল না। যাই হোক, এর পরে আপনি চলে আসুন তারই ঠিক পাশে উপাসনা ঘর, যেখানে রবি ঠাকুর পড়াশুনা এবং লেখালেখি করতেন। এখানে আপনি দেখতে পাবেন অনেক ছবি… দেশ-বিদেশের নামকরা মানুষের সঙ্গে তার ছবি।
হাতে অনেক সময় থাকার জন্য চলে গেলাম সুরুল নামক ছোট্ট গ্রামটিতে। সুরুলের প্রধান আকর্ষণ সরকারবাড়ি, যা সুরুল রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। সুরুল সরকার পরিবারের ইতিহাস ৩০০ বছরেরও আগে খুঁজে পাওয়া যায়। সরকার রাজবাড়িটি ১৭৫০ সালে শ্রীনিবাস সরকার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সরকার বাড়িটি তাদের ২৫০ বছরের পুরনো দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য পরিচিত। মন্দিরটিতে কিছু সূক্ষ্ম পোড়ামাটির কাজ রয়েছে, যদিও সেগুলি এখন জরাজীর্ণ। এই গ্রামের মধ্যেই আপনি অনেক থাকার জায়গা পেয়ে যাবেন। এখানে কোনও একটা রিসর্ট বা হোটেল বুক করে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেলুন। হোটেলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আজ (যেহেতু শনিবার) বিকেল পাঁচটার মধ্যে চলে আসুন সোনাঝুরির খোয়াই শনিবারের হাটে।
এখানে সোনাঝুরি গাছের বনের মধ্যে দেখতে পাবেন রংবেরঙের ছাতা নিয়ে গ্রামের মানুষ তাঁদের হাতে তৈরি করা জিনিস নিয়ে বসে আছেন, যা দূর থেকে দেখতে সত্যিই অসাধারণ লাগে। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য গ্রাম যেমন আহমদপুর, সাঁইথিয়া থেকে মানুষজন তাঁদের হাতে তৈরি নানা ধরনের জিনিস নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। এখানে আপনি পাবেন শাড়ি, কুর্তি, গয়না এবং হাতে তৈরি নানা ধরনের ব্যাগ। মাটির বিভিন্ন আকারের শো পিস, আর রবি ঠাকুরের জিনিস তো আছেই। আরও আছে ফটো ফ্রেম, ছোটদের জন্য নানা ধরনের খেলনা, বেলুন, আর দেখতে পাবেন সাইকেলে করে বিক্রি চলছে দই-রাবড়ি-ফলমূল এবং আরও অনেক কিছু। কেনাকাটার সঙ্গে সঙ্গে আপনি শুনতে পাবেন বাউলের গান। এছাড়া কোথাও ছোট-ছোট বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান এবং নাচ, যা এক কথায় এই বিশাল বড় জঙ্গলকে যেন রূপকথার হাটে পরিণত করেছে। আর একটা কথা বলা দরকার, এখানকার জিনিসপত্রের দাম বাজারের থেকে সত্যিই কম এবং জিনিসের গুণগত মানও সত্যিই খুব ভাল। এখানে বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজনের জন্য গিফট কিনে চলে আসুন আপনার হোটেলে।
হোটেলে জিনিসপত্র রেখে আপনি বাইক নিয়ে এই গ্রামের রাস্তাঘাট দিয়ে ঘুরতে পারেন। গ্রামটি সময় কাটানোর জন্য আদর্শ। রাতে ঝিঁঝিপোকার ডাক আর কখনও-কখনও গভীর কালো অন্ধকার, আপনার খুব ভাল লাগবে। এছাড়াও ভাল লাগবে এখানকার খাবার। মাটির থালা অথবা কোথাও কলাপাতার প্লেটে আপনাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেওয়া হবে। এখানে আপনি মাছ-মাংসের থালি, এছাড়াও চাইনিজ ফুড বা নানা ধরনের স্থানীয় খাবার পেয়ে যাবেন। তাই রাতের খাবার হোটেলে না খেয়ে আশপাশের মনপছন্দ কোনও রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিন।
রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার কারণে চারপাশটা বেশ ঠাণ্ডা। তাই সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল। সকাল ন’টার সময় বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। এমন সময় ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম কোপাই নদীর উদ্দেশ্যে। কোপাই নদীর গতিপথ খুব সুন্দর। আঁকাবাঁকা নদীপথ। একটা সিমেন্টের ব্রিজের নিচ থেকে বয়ে যাচ্ছে কোপাই নদী। নদীর একপাশে বড়-বড় গাছ এবং অন্য পাশে বড়-বড় ঘাসের জঙ্গল। এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে এবং অনেক ছবি তুলে বাইক নিয়ে চলে এলাম বুদ্ধ বিহারের উদ্দেশ্যে। ৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই গ্রামেই বুদ্ধের মূর্তি, যা এক সবুজ মাঠের পাশে অবস্থিত। এটি এমন কিছু যা আমি মোটেও আশা করিনি। ঘেরা এলাকায় বিশালাকার সাদা বুদ্ধ মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। জায়গাটা বেশি পুরনো নয়। এবং তারপর আমরা আশেপাশের এলাকার গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য একটি সমবায় সমিতি কুটির শিল্প পরিদর্শন করলাম।
এখানে দেখা যায় কীভাবে গ্রামবাসীরা তাঁদের নিখুঁত কাজের মাধ্যমে একটি জিনিস তৈরি করেন। যা আমরা সহজেই কিনে থাকি। কিন্তু যে কোনও জিনিস তৈরির পিছনে একটা মানুষের কতটা পরিশ্রম হয়ে থাকে, তা আমরা কখনওই ভাবি না। আমি দেখেছি কীভাবে তারা সেই বিখ্যাত শান্তিনিকেতনের হাতব্যাগ তৈরি করে। এই ধরনের ডিজাইনার চামড়ার কারুকাজ তৈরি করতে অনেকটা পরিশ্রম লাগে। তার সঙ্গে থাকতে হয় নিখুঁত। বাটিকের রঙ ও ছাপানোর প্রক্রিয়া দেখতে আমি বুটিক কারখানা পরিদর্শন করেছি। একটি সাদা কাপড় কীভাবে অবশেষে একটি রঙিন পোশাকে রূপান্তরিত হয়েছে, তা দেখতে দুর্দান্ত ছিল।
আমার পরবর্তী স্টপ ছিল সৃজনী শিল্প গ্রাম। এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় EZCC (পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র)-র মাধ্যমে। এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। আপনি কিছুটা সময় কাটাতে পারেন সৃজনী কমপ্লেক্সে। এখানে বাউলের গান শুনে আর প্রকৃতির মাঝখানে কখন যে আপনার অনেকটা সময় কেটে যাবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না। এটি ছবি তোলার জন্য আদর্শ জায়গা। একটি বুদ্ধমূর্তিকে ঘিরে সুন্দর একটা পার্কের মধ্যে আপনি পাবেন পদ্মফুল। চারপাশে নানা ধরনের ফুলের গাছ সেই জলে পড়ে আছে। জলে বুদ্ধের প্রতিচ্ছবি দেখতে খুবই ভাল লাগে। এই জায়গাটার সবটাই মানুষের তৈরি।
এরপরে আপনি চলে আসতে পারেন ঠিক পাশে বোলপুর ওয়াইল্ড লাইফ ফরেস্ট এবং ডিয়ার পার্কে। একটি বিস্তীর্ণ জায়গায় ফড়িংয়ের ঘোরাঘুরি এবং নানা ধরনের পাখির সমাবেশ এবং বিশাল একটা পুকুরের মধ্যে নানা প্রাণীর সমাবেশ দেখতে পাবেন। এটি শীতকালের জন্য আদর্শ জায়গা, শীতকালে এই অভয়ারণ্যের প্রকৃতি খুব সুন্দর। এর সঙ্গে আপনি দেখতে পাবেন একটা চারতলা বাড়ির মতো নিচু ওয়াচ টাওয়ার। যার উপর থেকে পুরো জঙ্গলটাই দেখা যায়।
এর পর দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিন। ১৬০ কিলোমিটার রাস্তা, যা আপনি সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারবেন। ফেরার সময় রইল একটা দোকানের ঠিকানা যেখানে আপনাকে একবার হলেও দাঁড়াতে হবে। এই দোকানের চা, সিঙ্গাড়া এবং মণ্ডা-মিঠাই খুবই সুস্বাদু। ঠিক আউসগ্রামের বড়া চৌমাথার কাছে অবস্থিত ‘অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। তারপর আবার নবাবহাট হয়ে জি টি রোড ধরে চলে আসুন কলকাতায়।