Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: সপ্তম পর্ব, কলকাতা থেকে ৬৭০ কিলোমিটারের পথ পেরিয়ে চলুন বিদ্যাং ভ্য়ালি

Offbeat North Bengal Destination: ৯০ কিলোমিটার দূরে আমাদের গন্তব্য স্থান বিদ্যাং ভ্যালি। বাগডোগরা থেকে ডান দিক নিয়ে শিলিগুড়ি হয় সেবক রোড ধরে চলে আসুন কালিম্পং এবং কালিম্পং থেকে ডান দিক ধরে ইচ্ছেয় রোড ধরে অপরূপ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে চলে আসুন রেল্লি নদী পার করে বিদ্যাং ভ্যালিতে।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: সপ্তম পর্ব, কলকাতা থেকে ৬৭০ কিলোমিটারের পথ পেরিয়ে চলুন বিদ্যাং ভ্য়ালি
বিদ্যাং ভ্যালি, ছবি: সঞ্জীব নস্কর
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 25, 2023 | 10:07 AM

অনেকে বলে পৃথিবীর এই জায়গাটা কী সুন্দর, পৃথিবীর অমুক জলপ্রপাতটা কী অসাধারণ, তমুক পাহাড়টা খুব সুন্দর। আবার কেউ বলেন গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইউরোপ, আফ্রিকার গভীর অভয়ারণ্যের কথা… অস্ট্রেলিয়া, আন্টার্কটিকা কতই না সুন্দর। সুন্দর এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য… কোথাও সমুদ্রে মিশছে লাভা, আবার কোথাও কঠিন ঠাণ্ডায় বেরিয়ে আসছে উষ্ণ প্রস্রবণ। কোথাও বা সমুদ্রের জল রাতে নীলাভ আভায় ছেয়ে যায়, আবার কোথাও জলের রং লাল। এই পৃথিবীতে যতই বৈচিত্র্য থাক না কেন, আমি মনে করি এ পৃথিবী সহজভাবে কিছু দেখায় না। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় রূপ দেখার জন্য আপনাকে একটি নির্জন জায়গায় যেতেই হবে। আপনি জানতেও পারবেন না কোন বড় রাস্তার পাশে এই সুন্দর জায়গা। আর এই প্রকৃতি কখনও সহজভাবে তার রূপ দেখায় না। তাকে দেখতে গেলে তার গভীরে ঢুকতেই হবে। তাই চলুন, আজকের এই পর্বে সারা পৃথিবী না-ঘুরে বরং আমাদের দেশে যেখানে রয়েছে সারা পৃথিবীর বৈচিত্রগুলো নিয়ে একটি ছোট্ট রূপান্তর, সেই দেশেরই একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ছোট্ট একটা অফবিট জায়গায় ঘুরে আসি। যেখানে আপনি পাবেন প্রকৃতির গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে চালা নদী, আর দু’পাশে বড়-বড় পাহাড়ের মাঝে একটি ছোট্ট উপত্যকা। যেখানে পৌঁছতে গেলে আপনাকে নদী পার হতে হবে। আর পাবেন এই গভীর জঙ্গলে নানা পাখির আওয়াজ, রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আর দিনের বেলা নানা রঙ বেরঙের প্রজাপতি এবং রাতে জোনাকির আলো। আর তার সঙ্গে অবিরাম বয়ে চলা রেলি নদীর জলের আওয়াজ।

এই জায়গাটির নাম বিদ্যাং ভ্যালি। এখানে পাবেন জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্পিং করার সুযোগ। আর পাবেন চারিপাশের শান্ত পরিবেশ আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর শান্ত শীতল আওয়াজ। আমি এখানে শীতকালে যাওয়ায় এখানকার পরিবেশ ছিল আরও বেশি শান্ত। তবে একবার বর্ষাকালে আসার খুব ইচ্ছে। তার কারণ বর্ষায় ফুটে উঠবে এখানকার জীবন্ত পরিবেশ। ঝকঝকে নদীটি আমার সামনে প্রবাহিত হয়েছিল এমনভাবে যে, আমার অন্তরের শান্তি ও নীরবতার প্রশংসা করতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। তখন শীতকাল, তাই নদীতে তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না। নদীটা এখন একটু শান্ত ছিল, ঠিক আমার চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো। এটি উত্তরবঙ্গের কালিম্পংয়ের ছোট্ট গ্রাম বিদ্যাং ভ্যালি। আমরা সাধারণত উত্তরবঙ্গকে তুষার-ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য এবং ঘূর্ণায়মান চা-বাগানের সঙ্গে যুক্ত করি। যদিও এগুলি একটি পরম আনন্দ, তবে আপনি বিদ্যাংয়ে যা পাবেন, তা আলাদা। রেলি নদীর তীরে প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, বিদ্যাংয়ের সৌন্দর্য এর সরলতায় নিহিত। যে দিকে তাকাই, সেখানেই সবুজ। চলুন তবে আর দেরি না করে হাতে মাত্র চারটে দিন সময় নিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি এই ভ্যালির উদ্দেশ্যে।

সঙ্গে একটি ছোট ব্যাকপ্যাক নিয়ে নিন। দু’সেট জামাপ্যান্ট। একটি গরম জামাপ্যান্টের সেট, যা রাতে লাগতে পারে। কিছু শুকনো খাবার, কিছু এনার্জি বার, কিছু সাধারণ ওষুধ, আপনার অতিপ্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী। আর এক লিটারের জলের বোতল আর ক্যামেরা। যেহেতু আনুমানিক ৬৭০ কিলোমিটারের রাস্তা (এক দিকের), তাই আরেকটি ছোট ব্যাগে ক্লাচ ও এক্সিলেটর কেবল, স্পার প্লাগ (এক সেট), পাংচার কিট আর একটি ছোট ডিজিটাল এয়ার পাম্প এবং এডজাস্টেবল রেঞ্জ ও স্প্যানার। রাতেই বাইকের সঙ্গে বাঞ্জিকড দিয়ে বেঁধে রাখুন এই সামগ্রী। এগুলো সাধারণত দরকার হয় না, কিন্তু ইমার্জেন্সির জন্য় নিজের কাছে থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, আমি আমার গাড়ি প্রায় এক লাখ কিলোমিটার চালিয়েছি। কিন্তু কখনও সেরকম বিপদের মুখে পড়তে হয়নি, তার কারণ যখনই বাইকের ছোটখাটো আওয়াজ বা সমস্যা শুরু হয়, তখনই আমি সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে বাইকের কাজ করিয়ে নিই। যাতে সেই ছোটখাটো অসুবিধা থেকে বড় অসুবিধা সৃষ্টি হয় না।

বিদ্যাং ভ্যালি, ছবি: সঞ্জীব নস্কর

ভোরবেলা শান্ত শীতল কলকাতাকে ‘গুডবাই’ বলে এনএইচ ১২ ধরে সোজা চলে আসুন কৃষ্ণনগর। যার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। রাস্তার ধারে কোনও একটা মিষ্টির দোকান দেখে গরম-গরম কচুরি আর মিষ্টি খেয়ে প্রাতরাশ শেষ করে নিন। এরই মধ্যে আপনার বাইকও অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বাইকের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ কিলোমিটারের পর অন্তত ৩০ মিনিট রেস্ট দেওয়া দরকার। তারপর আবার মোটামুটি ১০০ কিলোমিটার, মানে বেথুয়াডহরি পলাশী হয়ে বহরমপুর। কলকাতা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার রাস্তা গ্রাম, বাজারঘাট, লোকালয় বেশি থাকার জন্য একটু বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তা-ও সকালে যাত্রা শুরু করার জন্য মোটামুটি ছ’ঘণ্টা লাগবে। এখন দুপুর বারোটা। সূর্যের প্রচণ্ড তাপের ফলে বাইকে একটু বেশি সময়ের জন্য ঠাণ্ডা জল আর নিজেকে এক লিটার ওআরএস অবশ্যই দিতে হবে। আর একটা কথা বলা দরকার, রাস্তায় কোনও রকমের অসুবিধা হলে হেল্পলাইন ছাড়া যে কোনও পেট্রোল পাম্পে সাহায্যের জন্য আসতে পারেন। জল, বাথরুম, রেস্টুরুম এবং গাড়ি সংক্রান্ত কোনও অসুবিধা হলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সাহায্য করতে তাঁরা বাধ্য।

এরপরে চলে আসুন সাগরদিঘি, রঘুনাথগঞ্জ, ধুলিয়ান হয়ে ফারাক্কা। এখানে আপনি দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন রায়গঞ্জের উদ্দেশে। বহরমপুর থেকে রায়গঞ্জের রাস্তা খুব ভাল, কিন্তু গরমের কারণে ৫ ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ রায়গঞ্জ থেকে ডালখোলা। কিষাণঞ্জে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন। সঙ্গে সন্ধের টিফিন সেরে ইসলামপুরে রাতে থাকার মতো হোটেল খুঁজে নিন। ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে ভাল মানের ঘর পেয়ে যাবেন। কারণ ইসলামপুরের পরে সেরকম ভাল থাকার জায়গা বলতে বাঘডোগরা। বাঘডোগরা ইসলামপুরের থেকে একটু বেশি খরচসাপেক্ষ জায়গা। আমি যতবারই নর্থ বেঙ্গল বা নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া যাই, ততবারই বাগডোগরা এয়ারফোর্স স্টেশনে থাকি।আর লং রাইডের জন্য একটা কথা মাথায় রাখা দরকার: বাইক দেড়শো সিসির নিচে হলে ৭০ কিমি/ঘণ্টা এবং ২০০ সিসির উপরে হলে ৮০-৯০ কিমি/ঘণ্টার বেশি স্পিড তুললে ইঞ্জিনের উপর প্রেশার পড়ে, এতে আপনার বাইকের ক্ষতি হয়।

পরের দিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বাঘডোগরা থেকে চলে আসুন। ৯০ কিলোমিটার দূরে আমাদের গন্তব্য স্থান বিদ্যাং ভ্যালি। বাগডোগরা থেকে ডান দিক নিয়ে শিলিগুড়ি হয় সেবক রোড ধরে চলে আসুন কালিম্পং এবং কালিম্পং থেকে ডান দিক ধরে ইচ্ছেয় রোড ধরে অপরূপ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে চলে আসুন রেলি নদী পার করে বিদ্যাং ভ্যালিতে। এই ৯০ কিলোমিটার আসতে মোটামুটি তিন থেকে চার ঘণ্টা লেগে যাবে, কারণ এই ভ্যালিতে পৌঁছনোর আগের ৮ কিলোমিটার রাস্তা একটু খারাপ। শীতকালে নদীর জল কম থাকায় আপনি বাইক নিয়ে নদী পার করতে পারবেন, আর বর্ষাকালে এই ভ্যালিতে আসার জন্য ওভার ব্রিজও আছে। এখানে এসে আপনার পছন্দ মতো হোমস্টে খুঁজে নিন, এছাড়াও এখানে ক্যাম্পিং করার সুযোগও আছে।

বিদ্যাং ভ্যালি, ছবি: সঞ্জীব নস্কর

তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্র রেখে সকালের ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। বহুবার নদীর পার ধরে হাঁটা, নদীর নুড়ি পাথর কুড়িয়ে তারপরে একটির পর একটি করে উঁচু করে রাখা, জঙ্গলের মাঝে পাখির আওয়াজ, আর বয়ে চলা নদীর শব্দে আপনি হারিয়ে যাবেন। ঝুলন্ত সেতুর বেশ কাছেই নদীর তীরে একটি ছোট জলপ্রপাত রয়েছে। জলপ্রপাতের পথ খুঁজে পেতে আপনি কেবল নদীর ধারে হেঁটে যেতে পারেন। এই জলপ্রপাতটি সম্ভবত নামহীন। কারণ এটাকে কী বলে, কেউ বলতে পারেনি। ডিমা জলপ্রপাত নামে আরেকটি জলপ্রপাত রয়েছে। একটি সরু এবং পাথুরে চড়াই পথ জলপ্রপাতের দিকে নিয়ে যায়। এই গভীর অরণ্যে যখন- তখন বৃষ্টি নেমেই থাকে। তার ফলে এই সরু পাথরের রাস্তাটি হয়ে ওঠে পিচ্ছিল। পরে আমি গ্রামটি ঘুরে দেখেছি, সবজির খামার এবং বাগান পরিদর্শন করেছি। কাছেই একটা কমলালেবুর বাগান রয়েছে। সেখানে পৌঁছতে আপনাকে প্রায় ১৫ মিনিট ট্রেক করতে হবে। আর হ্যাঁ, এই ট্র্যাকের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাবেন প্রকৃতির এক্কেবারে কাছে। এছাড়া আপনি যদি নদীতে স্নান করতে চান, তা-ও করতে পারেন! তবে, পাথর এবং নদীর গভীরতা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। কোথাও কোথাও নদী বেশ দ্রুত প্রবাহিত হয়। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যখন-তখন।

এখানে নদীর জল প্রচন্ড ঠাণ্ডা হওয়ার কারণে আমি স্নান না-করে শুধু পা ডুবিয়েই চলে এসেছিলাম আমার টেন্ট-এ। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আমার তাবুর মধ্যে এ পাশ-ও পাশ করে প্রকৃতি এবং নদীর আওয়াজ শুনে মনের ক্লান্তি দূর করছিলাম। কখন যে আমার চোখটা লেগে এসেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। চারপাশে পাহাড় থাকার কারণে এখানে ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। এখানে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি কেমন যেন তার রূপ ১৮০° পরিবর্তন করে ফেলল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সঙ্গে দূরের কিছু শেয়ালের ডাক এবং তার সঙ্গে অন্য পশুর ডাকও শোনা যায়… শুধু পরিবর্তন হয়নি একটা নদী বয়ে চলার শব্দের। রাতটা ছিল সমান মোহময়, যদিও পূর্ণিমার রাত ছিল না তাও এই ভ্যালির প্রকৃতিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

বিদ্যাং ভ্যালি, ছবি: সঞ্জীব নস্কর

রাতে খাবার সময় আমার তাবুর পাশে থাকা হোমস্টের একজন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে পরের দিনের প্ল্যান করে ফেললাম। সেই লোকটির সঙ্গেই সকালে উঠে কিছু খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইহুর ফরেস্ট ট্রেক-এ। এই ট্রেক-এ আবিষ্কার করলাম নতুন একটা ঝর্ণা, জঙ্গল এবং তার মধ্যে বন্য পশুর পায়ের ছাপ, এবং ছোট-বড় পাহাড় অতিক্রম করে আবার দুপুরের মধ্যে ফিরে এলাম বিদ্যাং ভ্যালিতে। সে এক রোমহর্ষ অভিজ্ঞতা, বলে বোঝানো যাবে না। জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় এতটাই বন্য পশুর গন্ধ পেয়েছিলাম যে, মনে হল যেন চিড়িয়াখানায় চলে এসেছি। আমার মনে হয় আপনি যে কোনও জায়গাতেই যান না কেন, সেখানকার আঞ্চলিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে সেই জায়গার সম্পর্কে এবং সেখানে নতুন কিছু দেখা বা জানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া খুবই দরকার।

তাই আর দেরি না করে সন্ধে নামার ঠিক আগেই আমার টেন্ট এবং জিনিসপত্র সব গুছিয়ে বাইকে বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম কালিম্পং হয়ে বাগডোগরা উদ্দেশ্যে। কারণ আজকের রাতের আমার থাকার জায়গা বাগডোগরা এয়ারফোর্স স্টেশনের গেস্ট হাউস। সন্ধের সময় কালিম্পং এবং শিলিগুড়িতে জ্যাম থাকার কারণে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে গেল। পরের দিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বাগডোগরা থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমার শহর কলকাতার উদ্দেশ্যে।