Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৭—সোনমার্গ থেকে এবার যাত্রাশুরু লাদাখের উদ্দেশে, পঞ্চম পর্ব

Ladakh: ডাল লেক ঢোকার আগের রাস্তা মোটামুটি ভাবে ফাঁকাই। কোথাও রাস্তার পাশে পাড়ার ছেলেরা আপন মনে খেলে যাচ্ছে। কোথাও ঝাউ গাছ, আবার কোথাও উইলো গাছের ম্যান-মেইড জঙ্গল। চারপাশে ফাঁকা মাঠের সীমানায় পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। দোকানপাট এই দিকটায় অনেকটাই কম।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৭—সোনমার্গ থেকে এবার যাত্রাশুরু লাদাখের উদ্দেশে, পঞ্চম পর্ব
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 10, 2023 | 9:45 AM

Tanger ক্রস করে এবার উত্তর দিকে আমরা একে-একে লাইন করে চলতে শুরু করলাম। এখানে চেনাবের প্রধান নদী চলে গিয়েছে পশ্চিম দিকে। আর এখন আমরা চেনাবের উত্তর শাখার নদীর ডান পাশ দিয়ে এক একটি ছোট-ছোট বসতি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বানিহাল শহর। রাস্তায় প্রচুর গাড়ির সঙ্গে সেনার গাড়ি বেশি দেখলাম। মনে হচ্ছে, যেন কার্গিলে আবারও যুদ্ধ লেগেছে। এরপর আমরা সবাই বানিহাল টানেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই টানেলে প্রবেশ করে মনে হল কেন জানি না এটি একটি বিপজ্জনক টানেল। তারপর আঁকাবাঁকা মসৃণ রাস্তায় সেনাদের গাড়িকে একে-একে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। Polia-র কাছে দেখি গাড়ির ভিড়, প্রায় সব ট্য়ুরিস্টই একবার দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। পাশের সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা ‘টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট’। রাস্তার বাঁকে বাইকের উপর বসেই কাশ্মীরের একটু সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। চারিদিকে বিস্তীর্ণ জমি আর সবুজ ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকা। আর মানুষের একটু বেশি ভিড় দেখে ‘টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট’-এ দাঁড়িয়ে আর ছবি তোলা হল না। এবার আমরা ক্রমে যখন Qazigund, Songam-এ আসছি, ততই রাস্তায় এখানে ভাল এবং চওড়ায় কিন্তু গাড়ির গতিবেগ বাড়ানোর কোনও জো নেই। কারণ আমরা যতই শ্রীনগরের দিকে এগোচ্ছি, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনার টহলদারি।

How to Explore Leh Ladakh from Kolkata by Bike, Part Five

সেনার টহলদারি এতটাই যে, দেখে মনে হচ্ছিল কাশ্মীর আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যতই আমরা সামনের দিকে এগোচ্ছি, রাস্তার ধারে কিছু দূরে-দূরে কখনও ফাঁকা মাঠের দিকে, কখনও বন জঙ্গলের দিকে, কখনও বা ছোট-ছোট রাস্তা বা বাড়ি ঘরের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। এইসব দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বয়স্ক অফিসারকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম… তিনি উত্তরে কিছু না বলে একটা কথাই বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রীনগর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। তাই আর দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাল লেকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথে আমাদের একজনের সঙ্গে স্থানীয় একটি স্করপিও গাড়ির কথাবার্তা চলতে দেখলাম। পরে জানতে পারলাম, ওই গাড়িটি আমাদের ওভারটেক করে হঠাৎ গতি কমিয়ে গাড়ির ভেতরে একজন বলে উঠল, ‘ঝান্ডা উতার দে, ইয়ে কাশ্মীর হ্যায়, আপকা ভারত নেহি, ইয়ে ছোটা পাকিস্তান।’ আমরা জানি যতক্ষণ সোনমার্গ না পৌঁছচ্ছি, ততক্ষণ এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। আর সোনমার্গ শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আর বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে পৌঁছে গেলাম ডাল লেকে।

How to Explore Leh Ladakh from Kolkata by Bike, Part Five

আমরা কমবেশি সবাই কাশ্মীরের ইতিহাস জানি। সেই ১৫৮৬ সালের মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় এই অঞ্চল বিবাদমান অঞ্চল নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পরেও অনেক যুদ্ধ অনেক হিংসা অনেক সংগ্রাম করে এখানকার মানুষজন এবং আমাদের সেনাবাহিনী। ২০১৯ সালে অগস্টের ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু-কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ মর্যাদাকে বাতিল করে এবং ভারতের এই অঞ্চলটিকে পুনর্গঠনের আইন পাশ করে। তাতে কিছুটা সমাধান হয়। আমার মনে হয় এখানকার কিছু মানুষের ভ্রান্ত চিন্তাধারা এবং ধর্মীয় নির্বুদ্ধিতার কারণে কাশ্মীরকে আজও দ্বন্দ্ব এবং বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির রূপের পরিবর্তন। এখানকার মানুষ দেখেছে একের পর এক যুদ্ধ-চুক্তি-নিয়মকানুন। ধর্মীয় এবং সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের মতো করে নিয়ম তৈরি করে প্রচার এবং বহিরাগত মানুষের সঙ্গে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আঞ্চলিক যুদ্ধ, যার কোনও সমাপ্তি নেই। আমি দেখেছি তাদের সেই হাসির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সংগ্রাম, দেখেছি তাঁদের অস্থির চোখে বলে যাওয়া অনেক ভাষা।

বেলা পড়েছে। তাই ডাল লেক ঢোকার আগের রাস্তা মোটামুটি ভাবে ফাঁকাই। কোথাও রাস্তার পাশে পাড়ার ছেলেরা আপন মনে খেলে যাচ্ছে। কোথাও ঝাউ গাছ, আবার কোথাও উইলো গাছের ম্যান-মেইড জঙ্গল। চারপাশে ফাঁকা মাঠের সীমানায় পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। দোকানপাট এই দিকটায় অনেকটাই কম। পহেলগাঁও, গুলমার্গ এসব জায়গার থেকে শ্রীনগরের দৃশ্যটা অনেকটা আলাদা। আর শ্রীনগরের জেলা সদরগুলি যেমন অনন্তনাগ, বীজবেহেরা এইসব রাস্তার মোড়ে বা ধানের খেতে সেনারা প্রায় সবসময়ই বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার শ্রীনগরের উপকণ্ঠে পামপোরে টাউন বড়ই শান্ত। আগের তিন মাথার মোড় থেকে কেনা কলা,পাউরুটি এবং কলকাতা থেকে বহন করে আনা জ্যামের মাধ্যমে দুপুরের খাবার সমাপ্ত করলাম ডাল লেকের পাশে।

এখানে সিজ়ন এখনও শুরু হয়নি। তাই শিকারাগুলো এখন শান্ত হয়ে বিভিন্ন ঘাটের পাশে বসে আছে। আর ডাল লেকের শ্যাওলা, আগাছাগুলো পরিষ্কার হচ্ছে। এই লেকের পাশে থাকা এক ফুচকা দোকানে আমরা সবাই ফুচকাও খেলাম। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো ডাল লেকের চারপাশে কোথাও বা মানুষ মাছ ধরছেন ছিপ দিয়ে, কোথাও মানুষ দলবদ্ধভাবে বসে কথা বলছেন। আবার কোথাও চলছে হোটেল নিয়ে দালালদের দাদাগিরি। আবার কোথাও অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় এক বয়স্ক মানুষ মগ্ন হয়ে বাজিয়ে যাচ্ছেন ‘রবাব’। এই যন্ত্রের আওয়াজে সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। খিদেও যেন কোথায় চলে গেল। সেই মানুষটিকে দেখতে একেবারে কাশ্মীরি ধাঁচের, কাটা-কাটা চোখমুখে বয়স্কের ছাপ। গায়ের রং যদিও রোদে পুড়ে তামাটে। বৃদ্ধের কোলে সেই বাদ্যযন্ত্র, যার সুরের মধ্যে একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে… যা মনে করায় ঊষর মরুভূমির কথা, কোনও এক দূর পার্বত্য দেশের কথা… আর কোনও পূর্ব জন্মের যাযাবর জীবনে ইতিকথা। অর্থাৎ এক কথায় এর সুরের মধ্যে লুকিয়ে আছে এই বাদ্যযন্ত্রের জন্মস্থান মধ্য এশিয়ার নাড়ির টান।

How to Explore Leh Ladakh from Kolkata by Bike, Part Five

এরপরে আমরা ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেনে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে এবং ছবি তুলে বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে। তবে আমরা ফুল তেমন পাইনি, তার কারণ এখন অফ সিজ়ন। লেক রোড ছেড়ে আমরা সোনমার্গের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ একটানা চালানোর পর ঝিলম নদীর শব্দে এবং পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঠান্ডা হাওয়ার শীতল ছোঁয়ায় বেশ প্রশান্তি অনুভব করলাম। পাহাড় যে এত তাড়াতাড়ি রূপ বদলায়, তা কাশ্মীর অথবা লাদাখে না আসলে বোঝা যায় না। ঝিলম নদী পেরনোর পরই কোথা থেকে মুহূর্তের মধ্যে একরাশ কালো মেঘ চলে এল। সঙ্গে সঙ্গেই বড়-বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হল। বিপদ বুঝে তড়িঘড়ি করে আমরা একটি পেট্রোল পাম্পে আশ্রয় নিলাম। সঙ্গে রেইন কভার আছে, অগত্যা পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই এতটা জোরে বৃষ্টি নামল যে, চারিদিক প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই আগে যাওয়াটা ঠিক হবে না বলে আমরা সবাই বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টি থামতে সময় লেগে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। এ দিকে, সন্ধ্যে নেমে এসেছে। এখনও বেশ অনেকটাই দূরত্ব বাকি আজকের গন্তব্য স্থান সোনমার্গের থেকে। বৃষ্টি থামার পরই অদ্ভুত এক ধরনের শীতল ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। রাস্তার ডান দিক থেকে বয়ে চলা নদীর তীব্র শব্দ আর সন্ধ্যে নামার নিস্তব্ধতার শব্দে কান প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। এ দিকে ঠান্ডা হাওয়া এসে আমাদের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত রেখে পৌঁছে যাওয়ার তাগিদে ক্রমশ ছুটে যাচ্ছি বাইক নিয়ে। পাহাড়ের কোলে এক-একটি ঘরবাড়ি থেকে আলো জ্বলে উঠছে ক্রমে-ক্রমে। হঠাৎই দেখি ঘোর অন্ধকারে বাইকের হেডলাইটের আলোয় রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টাটকা বরফের প্রভা। প্রায়ই দাঁড়াতে হচ্ছিল আমাদের। সামনের দিক থেকে কনকনে হওয়ায় ভেসে আসা পেঁজা-পেঁজা বরফের টুকরো তীর হয়ে বিঁধছিল হাতের ওপরে। তাই গ্রিপ হারিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছিল আমাদের। প্রায় ঘণ্টাখানেকের লড়াইয়ে জয়ী হয়ে অবশেষে সোনমার্গ এসে পৌঁছলাম। অন্ধকারে হাতড়ে যতটুকু দেখা যায়… পাহাড়ের কোলে ন্যাড়া উপত্যকার মাঝে কয়েক ঘর বসতি, ছোট্ট বাজার এবং তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা কয়েকটা হোম-স্টে, হোটেল। রাস্তার বিপরীতে অনেকটা অংশ জুড়ে সেনা ছাউনি… এই নিয়েই সোনমার্গ। এটিএম-সহ মোটামুটি সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায় কম বেশি দামে। তবে ২০২২ এ সোনমার্গ আগের থেকে অনেক বেশি আধুনিক এবং ঘরবাড়ি সংখ্যাও অনেক বেশি। শরীর এমনিতেই সঙ্গ ছেড়েছিল অনেক আগেই, এখানে পৌঁছে মনও সমাপ্তি ঘোষণা করলো। তাই আর দেরি না করে হাতের কাছে সস্তার এক হোটেলে আজ রাতের ডেরা জমালাম। চারপাশটা একটু রেইকি করে যখন হোটেলে ফিরে এলাম, তখন প্রায় ন’টা হবে। ততক্ষণে হোম-স্টের রাঁধুনির রাঁধা গরম গরম খিচুড়ি রেডিই ছিল। চাল,ডাল আমাদেরই দেওয়া ওরা শুধু কিছু টাকার বিনিময়ে বানিয়ে দিয়েছিল এবং সঙ্গে ডিম ভাজা। একটুও সময় নষ্ট না-করে খাবার টেবিলে হামলে পড়লাম সবাই। খাওয়া শেষে ওপরের তলায় যে যার রুমে গিয়ে স্লিপিং ব্যাগের আশ্রয় নিলাম। নানা গল্পের ভিড়ে কখন যে চোখে ঘুম নেমে এল, টেরই পেলাম না।

২৭ মে…

সকাল হতেই ঘুম ভেঙে গেল। ভোর থেকেই নরম সূর্যের আলো বাইরে অপেক্ষায় ছিল। মাথার পাশের জানালার পর্দা সরাতেই সাদা কাঁচের ভিতর দিয়ে সারা ঘর আলো করে সোজা বিপরীতের দেওয়ালে এসে পড়ল। চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় বসে জানালায় চোখ রাখলাম। দূরে, অনেক দূরে বরফ শিখর, তারই নীচে পরম স্নেহে আগলে আছে ওক পাইনের ঘন জঙ্গল। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে সবুজ ঘাসের নেমে এসেছে ভ্যালি। জংলি ঘোড়া এ দিক-ও দিক, ছুটে গা গরম করছে। শিশিরসিক্ত হালি সবুজ ঘাসের ওপর সূর্যের আলো যেন এক শিল্পীর ক্যানভাসের রূপ নিয়েছে। এসবের মাঝেই বিছানায় চা এসে হাজির। গরম চায়ে চুমুক দিতে-দিতে আরও কিছুটা ওভাবেই বসে রইলাম বাইরের দিকে চোখ রেখে। আট’টা বাজল। প্যাকিং সেরে সবাই রেডি। রাতের ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি ছাড়লাম কার্গিলের উদ্দেশে। —-ক্রমশ প্রকাশ্য