Project Cheetahs: কুনো জাতীয় উদ্যানের সঙ্গে কী যোগ দুই তরুণ বাঙালি প্রাণিবিদের?
Kuno National Park: চিতা রি-ইন্ট্রোডাকশন প্রজেক্টে দীর্ঘদিন ধরে দেশে এবং মার্কিন মুলুক ও নামিবিয়ায় কাজ করেছেন দুই বঙ্গসন্তান। প্রজেক্ট চিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দুই বাঙালি গবেষক।
নন্দন পাল
২০২২-এ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। দেশের বনাঞ্চলে পুনরায় চিতা ফিরিয়ে আনার জন্যই এই চুক্তি। চিতা প্রত্যাবর্তনের এই চুক্তির ফলে প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে কুনো জাতীয় উদ্যানে ছাড়া হয় ৮টি চিতা। আর আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আরও ১২টি চিতা কুনো জাতীয় উদ্যানের মাটিতে পা রাখতে চলেছে। এই চিতা রি-ইন্ট্রোডাকশন প্রজেক্টে দীর্ঘদিন ধরে দেশে এবং মার্কিন মুলুক ও নামিবিয়ায় কাজ করেছেন দুই বঙ্গসন্তান। প্রজেক্ট চিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দুই বাঙালি গবেষক মৌলিক সরকার ও কথন বন্দোপাধ্যায়। মৌলিক সরকার মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, আর কথন বন্দোপাধ্যায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী। মৌলিক ও কথন বর্তমানে কুনো জাতীয় উদ্যানে কর্মরত। কুনো বনাঞ্চলের ৮টি চিতা ও অন্য মাংসাশী খাদকদের প্রতিদিনের মনিটরিং, ক্যামেরা ট্রাপিং, তৃণভোজী প্রাণীদের গণনায় যে গবেষক দল নিয়োজিত, সেই দলের সদস্য এই দুই বাঙালি গবেষক। গবেষণার অঙ্গ হিসেবে ড. লরি মার্কারের নেতৃত্বাধীন চিতা কনজারভেশন ফান্ড (CCF)-এও বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন এই দুই তরুণ বাঙালি প্রাণিবিদ।
কথন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌলিক সরকার বলছেন, “দ্বিতীয় দফায় আজ যে ১২টি নতুন চিতা কুনোয় আসছে প্রজেক্ট চিতার ইনিশিয়াল স্টকের জন্য, তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনার সাক্ষী থাকবেন মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শিবরাজ সিং চৌহান ও দেশবিদেশের বিভিন্ন চিতা বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা। ২০২২-এর ২০ জুলাই ভারত ও নামিবিয়া সরকারের মধ্যে চিতা পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় initial stock দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ২০২২-এর ১৭ সেপ্টেম্বর ৫টি মেয়ে চিতা—সাশা, সাভানা, সিয়ায়া, টিবিলিসি ও আশা—আর—এলটন, ফ্রেডি, ওবান নামের ৩টি পুরুষ চিতা—মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ভারতের মাটিতে পা রাখে। ৭৫ বছর পর চিতার এই নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের পিছনে বিশেষভাবে সহায়তা করে ড. লরি মার্কার এর নেতৃত্বাধীন চিতা কনজারভেশন ফান্ড (CCF)।”
২০২০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (WII)-র গবেষক দল ড. যাদবেন্দ্রদেব ঝালার নেতৃত্বে, কুনো ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি (Kuno Wildlife Sanctuary), নৌরাদেহি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি (Nauradehi Wildlife Sanctuary) ও মুকুন্দারা হিলস টাইগার রিজার্ভ (Mukundara Hills Tiger Reserve)-এ চিতা পুনর্বাসনের গবেষণা শুরু হয়। এই গবেষণার মূল বিষয় ছিল চিতার খাদ্য, বাসস্থান ও সহ-খাদকের (Co-predator) গণনা। ওই গবেষকদল সংশ্লিষ্ট বনবিভাগকে এই ক’টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল চিতাবান্ধব করে তোলার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করে, যা পরবর্তীকালে চিতা পুনর্বাসন অ্যাকশন প্ল্যান হিসেবে প্রকাশিত হয়।
অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, এই গবেষণায় এবং প্রজেক্ট চিতার সঙ্গে যুক্ত বাঙালি গবেষক মৌলিক সরকারের মতে, “ভারতে বহু প্রতীক্ষিত ‘প্রজেক্ট চিতা’ আসলে বাস্তুতন্ত্রের বিজ্ঞানে ব্যবহৃত ‘মেটাপপুলেশন কনসেপ্ট’-এর উপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত। ভারতের বিভিন্ন সম্ভাব্য বনাঞ্চলের মধ্যে কুনো অন্যতম। এছাড়াও পরবর্তীকালে গন্ধিসাগর, মুকুন্দরা, নৌরাদেহি ও বিভিন্ন বনভূমিতে চিতা ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলির সঠিক ম্যানেজমেন্ট, পর্যাপ্ত শিকারের যোগান ও বাসস্থানের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিতার একটা ভাল পপুলেশন তৈরি হবে। পরবর্তীকালে সেই পপুলেশন করিডরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া-আসা করে একটি সামগ্রিক ফ্রি রেঞ্জিং (Free Ranging) পপুলেশন এর জন্ম দেবে।”
আর এক গবেষক কথন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন। তৃণভূমিকে কৃষিজাত জমি করে তোলা ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করা হয়। কখনও আবার সংরক্ষণের প্রাচীনপন্থী নীতির জন্য তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্রকে ক্রমাগত অবহেলা করা হয়েছে। চিতা পুনঃপ্রবর্তন প্রজেক্ট শুধুমাত্র চিতার সংরক্ষণের কথা দাবি করে না, বরং সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক সংরক্ষণ ও বিকাশের কথা বলে। এই প্রোটেক্টেড এরিয়াগুলিতে একদিকে যেমন চিতার সংরক্ষণ হবে। অন্যদিকে, তেমন চিতার সংরক্ষণের কারণেই পরোক্ষভাবে বেশ কিছু বিপন্ন প্রজাতি যেমন কেরাকেল, ভারতীয় বাস্টার্ড, হায়না, উলফ, লেসার ফ্লোরিকেন ইত্যাদি প্রাণীর জনসংখ্যা চিরস্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পাবে।”
প্রজেক্ট চিতায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের মধ্যে যে পুনর্বাসন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এরকম আন্তঃমহাদেশীয় পুনর্বাসন। চিতার মতো বড় মাংসাশী প্রাণীর Large Carnivore-এর ক্ষেত্রে এই ধরনের আদান-প্রদান প্রথম। ‘প্রজেক্ট চিতা’য় নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে একটি বহুল চর্চিত পদ্ধতি। বন্য জীব-বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘সফট রিলিজ’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই প্রথম পর্যায়ে ৮টি চিতা ছাড়া হয় কুনোর বনে। দ্বিতীয় দফাতেও অবলম্বন করা হচ্ছে ওই একই পদ্ধতি জানাচ্ছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরা। এছাড়াও জিপিএস প্রযুক্তির সুবাদে চিতার স্বাস্থ্য, শিকার করা ও দৈনিক গতিবিধির উপরে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে। ভারতের মাটিতে চিতার সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধি পৃথিবীর বন্য জীব-বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অসীম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করছেন প্রজেক্ট চিতার সঙ্গে যুক্ত প্রানী বিজ্ঞানীরা। ভারতবর্ষের মাটিতে পরবর্তীকালে বাঘ, সিংহ লেপার্ডের মতোই ওদের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াবে চিতাও। এমনই আসায় বুক বাঁধছেন দুই তরুণ বঙ্গসন্তান।
(কথন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌলিক সরকারের সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে লিখিত)