Jagannath Puri Rath Yatra 2022: এই মন্দিরেই অলৌকিক অন্তর্ধান হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের! ‘ঈশ্বরের বাগানবাড়ি’ই কি জগন্নাথের মাসির বাড়ি?
Gundicha Temple: মন্দিরটি একটি সুন্দর বাগানের মাঝে অবস্থিত, যা জগন্নাথদেবের বাগানবাড়ী বা ঈশ্বরের গ্রীষ্মকালীন বাগান 'অপগম' নামেও পরিচিত। আষাঢ় মাসের রথযাত্রার সাতদিন যাবৎ এই গুণ্ডিচা মন্দিরেই জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার আরাধনা করা হয়।
কৌলিন্য, জাঁকজমক ও জনসমারোহের হিসাবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল পুরীর রথ (Puri Rath Yatra 2022)। এখানকার বৈশিষ্ট্য হল -অন্য সব জায়গায় রথযাত্রায় একটা রথ দেখা গেলেও এখানে তিনটে রথ দেখা যায়। সারা বছর পুরীর মন্দিরে (Puri Jaganath Temple) জগন্নাথদেব পূজিত হলেও সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই আপামর জনসাধারণ যাতে জগন্নাথদেবর দর্শন করতে পায় সে জন্যই এই রথযাত্রা – জগন্নাথের গুণ্ডিচা যাত্রা (Jaganath Gundicha Yatra)। জগন্নাথ দেবের রথের প্রতিটি অংশই অতি পবিত্র, কারণ তিনটি রথেই বিরাজ করেন তেত্রিশ কোটি দেবতা। তাই এই রথের রশি একটু স্পর্শ করা বা টানা মানে এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর চরণ স্পর্শ করা।
কথিত রয়েছে , পুরীর রথযাত্রায় যিনি একবার রথের রশি ছুঁয়ে নেন, তাঁর সমস্ত ইচ্ছা পুরণ হয়। আর সেই থেকে রথের দড়ি ছোঁয়া ও টানবার পরম্পরা চালু হয়েছে। প্রতি বছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরা ক্রমে পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। সেই রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে, যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনিই পুরীর রাজা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পর পর তিনটি রথের সামনে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন এবং সোনার ঝাড়ু ও সুগন্ধী জল দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেন। তারপরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। বাংলা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথ উৎসব হয়ে থাকে। এই দিন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে গুন্ডিচা মন্দিরে যান জগন্নাথ। সেখান থেকে সাতদিন পর নিজ মন্দিরে ফিরে আসেন। গুন্ডিচা মন্দির ভ্রমণকেই আবার মাসির বাড়ি যাওয়া মনে করেন অনেকে। পুরাবিদেরা বলেন, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রীই ছিলেন গুণ্ডিচা।
গুণ্ডিচা মন্দির জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি বা বাগানবাড়ি নামেও পরিচিত। মন্দিরটি একটি সুরম্য বাগানের মাঝে অবস্থিত এবং তা চারিদিকে উঁচু পরিখাবেষ্ঠিত। এটি শ্রীজগন্নাথদেবের মূল মন্দির তথা “শ্রীমন্দির”-এর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মন্দিরটি একটি সুন্দর বাগানের মাঝে অবস্থিত, যা জগন্নাথদেবের বাগানবাড়ী বা ঈশ্বরের গ্রীষ্মকালীন বাগান ‘অপগম’ নামেও পরিচিত। আষাঢ় মাসের রথযাত্রার সাতদিন যাবৎ এই গুণ্ডিচা মন্দিরেই জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার আরাধনা করা হয়। কিন্তু বছরের অন্যান্য সময়ে মন্দিরটি প্রায় শূণ্য থাকে। রথযাত্রার ঠিক একদিন আগে থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার থাকার উপযুক্ত করে তোলার জন্য ধর্মীয়ভাবে গুণ্ডিচা মন্দির পরিচ্ছন্নকরণ চলে। রথযাত্রা শুরু হওয়ার প্রথম দিন আলাদা আলাদা রথে চড়িয়ে দেবমূর্তি তিনটি মূল মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এটিই জগন্নাথ পুরী বা মাহেশ্বরী পুরীর বিশ্বচর্চিত বিখ্যাত রথযাত্রা। প্রথম দিনে মূর্তি তিনটি রথেই থাকে এবং রথযাত্রার দ্বিতীয় দিন প্রথা মতো তাদের গুণ্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। তারা প্রবেশের পর থেকে আগামী সাতদিন যাবৎ গুণ্ডিচা মন্দিরেই অবস্থান করেন।
পৌরাণিক কাহিনি
কিংবদন্তী অনুসারে, একটি ঘটনা জগন্নাথ মন্দিরর নির্মাতা মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী গুণ্ডিচা দেবীকে উদ্দেশ্য করে রয়েছে। রাণী গুণ্ডিচার নামেই সংশ্লিষ্ট মন্দিরটি নির্মিত। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা জগন্নাথ মূর্তি তৈরি করার সময় রাণী গুণ্ডিচা বন্ধ দরজার বাইরে থেকে নিষেধ অমান্য করে উঁকি মারেন। অর্ধেক তৈরি জগন্নাথ মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি তার স্বামীকে মূর্তি স্থাপনার জন্য একটি সুদর্শন মন্দির নির্মাণ করে বাৎসরিক রথযাত্রার ব্যবস্থা করতে বলেন। আবার অনেকের মতে জগন্নাথদেব তার জন্য তৈরি মন্দির দেখে সন্তুষ্ট হন, তাই এই রাণী গুণ্ডিচাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি তার বাড়ীতে আসবেন। যেটি বর্তমানে গুণ্ডিচা মন্দির নামে খ্যাত।
একটি ঘটনা রয়েছে গুণ্ডিচা নামের পেছনে। “গুণ্ডিচা” ছিলেন স্থানীয় দেবী, যিনি দেবী দুর্গার রূপ হিসাবে পরিগণিত হন এবং গুটিবসন্ত রোগ নিরামক। ওড়িয়া ভাষাতে “গুণ্ডি” শব্দটির অর্থ গুটিবসন্ত, যা বাংলা “গুটি” শব্দটি থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। এবং বাংলার গুটিবসন্ত নিরাময়ের দেবী “গুটিকা ঠাকুরাণী” এবং ওড়িয়া “গুণ্ডিচা”কে একই ব্যক্তিত্ব বলে মনে করা হয়। গুণ্ডিচাকে কৃষ্ণ-জগন্নাথের মাসি বলেও অভিহিত করা হয়, ভাই-বোনের সঙ্গে তিনি তার মাসির বাড়িতে বছরে একবার দেখা করতে আসেন।
আরও একটি জনশ্রুতি অনুসারে, যখন জগন্নাথ দেব গুণ্ডিচা মন্দিরে সাত দিন থাকার সময়ে ইচ্ছা করে পরিকল্পনা মাফিক তার স্ত্রী দেবী লক্ষ্মীকে মূল মন্দিরের সংগ্রহকক্ষে বন্দিনী করে রেখে আসেন। আবার গুণ্ডিচা মন্দিরে তিনি তার প্রিয় গোপীগণের দ্বারা আহ্লাদিত হন, ঠিক যেমন তিনি এবং তার গোপীশ্রেষ্ঠা রাধা বৃন্দাবনে রাসলীলা করতেন। এই অনুষ্ঠানের সময়ে মন্দিরের সেবারত দেবদাসীদের গোপী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। জগন্নাথ তার কামার্ত অবলীলা সাঙ্গ করে তার মূল মন্দিরে ফেরত এলে লক্ষ্মীদেবী তার সাথে মন্দিরের সিংহদুয়ারে সাক্ষাৎ করেন এবং তার ওপর কিছু অলৌকিক শক্তি প্রয়োগ করেন। ফলে জগন্নাথ গুণ্ডিচা মন্দিরে পলায়নের ঘটনা এবং সেখানে তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা ভুলে তার স্ত্রীয়ের সঙ্গে পুণর্মিলিত হন এর স্বামীস্নেহ ভোগ করেন।
গুণ্ডিচা মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর। ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে যিনি কৃষ্ণেরই অবতার৷ তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক এবং জগন্নাথ অষ্টকমের সুরকার হিসাবে পরিচিত। তিনি বহুবছর ধরে পুরীতে বাস করেন এবং জগন্নাথ দেবের চন্দনযাত্রা ও রথযাত্রার সময়ে অন্যান্য ভক্তবৃৃন্দের সাথে ভজন, কীর্তন করতেন বলে জানা যায়। তিনি প্রত্যহ গরুড়স্তম্ভের (গরুড় অঙ্কিত স্তম্ভ) পেছনে দাঁড়িয়ে জগন্নাথদেবের কাছে প্রার্থনা করতেন এবং অশ্রুধারা করতেন। রাজার সম্মতি নিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু একদা রথযাত্রার আগের দিন গুণ্ডিচা মন্দির পরিষ্কার করার দায়িত্ব নেন। এই রীতিটি বর্তমানেও রথযাত্রার আগের দিন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীরা পালন করে থাকেন। কথিত রয়েছে যে চৈতন্য মহাপ্রভু একদা তার সঙ্গীসাথীর চোখ এড়িয়ে গুণ্ডিচা মন্দিরের দিকে রওনা হন এবং তাকে শেষবার জগন্নাথের “মণিকোঠা”র দিকে যেতে দেখা যায়। এরপর থেকে তাকে আর কখনো দেখা যায়নি। শ্রীচেতন্যের এই অলৌকিক অন্তর্ধান আজ অবধি ব্যাখ্যার অতীত এবং তাকে নিয়ে রচিত কোনও বইতেই এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিশ্বাস করা হয় যে, তিনি মন্দিরে শ্রীজগন্নাথের কাষ্ঠমূর্তিতে বিলীন হয়ে যান।