Virat Kohli-Khela Hobe: বিরাট কোহলির মুখে ‘খেলা হোবে’! কারণ জানলে আপনারও রক্ত গরম হবে…
ICC MEN’S T20 WC 2022: নওয়াজ পা লক্ষ্য করেই বল করছিলেন। অশ্বিন এত দ্রুত সরে যান, ওয়াইড বল হয়। বিরাট হেসে বলেন, 'আমি শুধু সে সময় ভাবছিলাম, বলটা যদি প্যাডে লাগত!' ওয়াইড হওয়ায় শেষ বলে ১ রান প্রয়োজন ছিল। ঘাবড়ে গিয়ে নওয়াজ মিডল-লেগ স্টাম্পেই বল করেন। কিন্তু গতি বেশি ছিল। অশ্বিন রুম বানিয়ে মিড অফের উপর দিয়ে মারেন। ভারতের ঐতিহাসিক জয়। বিরাট বলেছিলেন খেলা হবে, খেলা হয়েছিল, জিতেছিল ভারতই।
কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান, ‘খেলা হবে’ কোনও রাজনৈতিক স্লোগান কীনা। বরং মনে করার চেষ্টা করুন, আপনার জীবনের কোনও পরিস্থিতি। যেখান থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এমন কোনও মুহূর্ত, যা আপনি চাইলেও ভুলতে পারবেন না। ঘুরে ফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই মুহূর্ত। বিরাট কোহলির কেরিয়ারে এমন হাজারো মনে রাখার মতো মুহূর্ত রয়েছে। কিন্তু আমার, আপনার এবং বিরাটের কেরিয়ারে একটা মুহূর্ত, আজীবন আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে। একটু ফ্ল্যাশ ব্যাকে যাওয়া যাক।
বছর দুয়েক আগের মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। তারিখটা! ২৩ অক্টোবর। পরদিন দিওয়ালি। আলোর উৎসব। ভারতীয় ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে যদিও একদিন আগেই সেই সুযোগ এসেছিল। সৌজন্যে বিরাট কোহলি। এ বার সেই তারিখটা নিয়ে একটু কথা বলা যাক। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্রায় এক লক্ষ দর্শক। মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। বিশ্বকাপের মঞ্চে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বরাবরই ভারতের আধিপত্য। কিন্তু সে বার পরিস্থিতি সামান্য ব্যতিক্রমী ছিল।
তার আগের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, অর্থাৎ ২০২১ সালে ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়েছিল পাকিস্তান। ভারতের তৎকালীন ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলির কেরিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। আর তাঁর ক্যাপ্টেন্সিতেই বিশ্বকাপের মঞ্চে পাকিস্তানের কাছে ভারতের প্রথম হার। সেই দিনটা ছিল হতাশার। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর তারই পুনরাবৃত্তির যেন আশঙ্কা ছিল। ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং বিরাট কোহলিই। যতটা সহজে লাইনগুলো লেখা যাচ্ছে, বিষয়টা একেবারেই এমন ছিল না।
টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। শান মাসুদ ও ইফতিকার আহমেদের হাফসেঞ্চুরিতে ভারতকে ১৬০ রানের লক্ষ্য দেয় পাকিস্তান। স্কোরটা আর একটু কম হতেই পারত। শাহিন আফ্রিদি লোয়ার অর্ডারে ৮ বলে ১৬ রান করেছিলেন। যা ভারতীয় শিবিরে ‘এক্সট্রা’ চাপ ছিল। এরপর রান তাড়ার পালা। গোড়ায় গণ্ডগোল। দ্বিতীয় ওভারে লোকেশ রাহুল, চতুর্থ ওভারে রোহিত, আর পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভারে ‘সূর্যাস্ত’।
২৬ রানে ৩ উইকেটেও রেহাই নেই। পাওয়ার প্লের পরের ওভারের প্রথম বলেই রান আউট অক্ষর প্যাটেল। আর এতে ভুল ছিল বিরাট কোহলির। এটা তিনি স্বীকারও করেছেন। ক্ষমাও চেয়েছিলেন অক্ষরের কাছে। স্কোর হয়ে দাঁড়ায় ৩১-৪! আচ্ছা, এরপর ভারতীয় ক্রিকেট প্রেমীরা কী ভাবছিলেন? বিরাট নিজেই বা কী ভাবছিলেন? বিরাটের মনে কী চলছিল! সে তো তিনিই বলতে পারবেন। বলেছেনও। স্টারস্পোর্টসের স্পেশ্যাল শো ‘বিলিভ’-এ এই ম্যাচ নিয়ে আলাদা করে নানা মুহূর্তের কথা তুলে ধরেছেন।
এ বার কিছুটা ফ্ল্যাশ ব্যাক এবং বিরাটের স্মৃতি হাতড়ানোর মুহূর্ত। যদিও খুব বেশি ভাবতে হয়নি। এটা এমনই একটা ম্যাচ, যার পরতে পরতে গল্প রয়েছে। অক্ষর রান আউট হতেই ক্রিজে প্রবেশ হার্দিক পান্ডিয়ার। তাঁকে দেখে বিরাট প্রথম কী বলেছিলেন? সঞ্চালক যতীন সপরুকে খোলসা করলেন বিরাট। বলেন, ‘সেই মুহূর্তে হার্দিককে জাস্ট বলেছিলাম, পার্টনারশিপ গড়ব। হার্দিক একটা বিষয় বার বার বলছিল, আমরা স্ট্রাইক রোটেট করতে থাকব, সুযোগ পেলে বাউবন্ডারি মারব। ওভারে অন্তত ৭রান করে ম্যানেজ করতে হত। আমি ওকে বলি, ওরাও একটা সময় প্যানিক করবে। কোন সময়, সেটা জানা ছিল না।’
পার্টনারশিপ গড়লেন। ম্যাচ ক্রমশ গভীরে গেল। কাজ তখনও শেষ হয়নি। পার্টনারশিপ গড়ার একটা সময় ভরসা আসে, এ বার একটু ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে। সম্ভবত, দ্বাদশ ওভার। ড্রিঙ্কস ব্রেক। কোচ রাহুল দ্রাবিড় মাঠে ছিলেন। সেখানে হার্দিক জানান, বাঁ হাতি স্পিনার নওয়াজকে টার্গেট করবেন। আর বিরাট বলেন, যে দিকে বাউন্ডারি ছোট, সে দিক থেকে রান তোলার চেষ্টা করবেন।
বিরাট কোহলি ২১ বলে ১২ রানে। সে সময় বিরাটই প্যানিক করছিলেন। এখান থেকে কীভাবে পরিস্থিতি বদলানো যায়। হার্দিক শট খেলা শুরু করেন। দ্বাদশতম ওভারে নওয়াজকে টার্গেট করেন হার্দিক-বিরাট। সেই ওভারেই ভারতীয় ইনিংসের প্রথম ছয় আসে হার্দিকের ব্যাটে। এরপর স্ট্রাইক পান বিরাট। ২৪ বলে ১৫ রানে ছিলেন। নওয়াজের বলে স্ট্রেট বাউন্ডারিতে বিশাল ছয়। সব মিলিয়ে এই ওভারে ২০ রান আসে।
অনেক কিছুই সাধারণ দর্শকরা খেয়াল করেন না। কিন্তু কিং কোহলি করেন। বোলার বিরক্ত কীনা, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বোলার কিংবা কোনও ফিল্ডারের তর্ক হচ্ছে কীনা। সেই থেকে আন্দাজ করেন, প্রতিপক্ষ এ বার চাপে রয়েছে। দ্বাদশতম ওভারে ২০ রান আসায় পাক শিবিরে সেটাই হয়েছিল। পাকিস্তান টিমে পাঁচ জনই বোলার ছিলেন। পাকিস্তানের কী প্ল্যান হতে পারে, সেটাও হিসেব কষছিলেন। শাদাবের এক ওভার বাকি ছিল। বিরাট নিশ্চিত ছিলেন, শাদাব-নওয়াজ জুটিতে বোলিং করবেন না। ফলে তিন পেসার যাঁরা ভারতকে খাদের কিনারায় ফেলেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই কোনও একজন বোলিং করবেন। কিন্তু কে করবে, সেটা নিশ্চিত ছিলেন না। তেমনই এই বিশ্বাসও দৃঢ় হয়নি যে, ম্যাচ এ বার ভারতের হাতে।
প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল তিন পেসারকে সামলানো। নাসিম শাহ এবং শাহিনের ওভারে তাঁদের গতিটাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন বিরাট। নজর ছিল, গ্যাপে বল প্লেস করা। ১৫ ওভারের পর শাহিন যখন বোলিংয়ে এলেন, বিরাটের মাথায় ছিল, এটাই তাঁর শেষ ওভার। শাহিনের রান আপ দেখে মনে হয়েছিল, শুরুর দিকের মতো মানসিকতা নেই। সেই ওভারে শাহিনকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। হিসেব ছিল, ওরা শাহিনকে এনেছে মানে, নওয়াজ কোনও একটা ওভার করবেই। শেষ পাঁচ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ৬০ রান। প্রত্যেকের এক ওভার করে বাকি। শাহিনকে কাউন্টার করেন।
শেষ ২ ওভারে ৩১ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায়। এরপর ১৯তম ওভার। বোলিংয়ে হ্যারিস রউফ। এই ওভারটাই যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। চাইছিলাম, এই ওভারে ২০ রান আসুক। কিন্তু রউফের বিরুদ্ধে কঠিন ছিল। ও প্রথম তিন ওভার দুর্দান্ত বোলিং করেছে। বাস্তবটাকে ইগনোর করেননি। প্রথম চার বলে মাত্র ৩ রান! বিরাট স্ট্রাইকে এলেন। তখন হিসেব দাঁড়িয়েছে ৮ বলে ২৮ রান। মাথায় শুধু ঘুরছিল, আমার দুটো ছয় মারতেই হবে। কী ভাবে মারব জানা ছিল না। নিজেকে বলছিলাম, ‘কাম অন চিকস (বিরাটের ডাক নাম চিকু)।’
বিরাট বলছেন, ‘সেই মুহূর্তে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। কোথায় মারব, কী ভাবে, কোন শট, মাঠে কী হচ্ছে, বিশ্বে কী হচ্ছে, শুধু ঘুরছিল দুটো ছয় মারতে হবে। আমি আজও বলতে পারব না, এরপর কী হল, কী ভাবে হল, কেন হল! মিলি সেকেন্ডের জন্যও ভাবিনি, রউফের কী দক্ষতা রয়েছে। এতটাই চাপে ছিলাম, আমার মাথায় শুধু ছিল, বল দেখতে হবে, মারতে হবে। এই দুটো বল মিস করলে, সব শেষ। ফিল্ড প্লেসমেন্ট কী ছিল, তাও দেখিনি। আমার হাতে ব্য়াট রয়েছে, আমাকে মারতেই হবে। বিশ্বাস করুন, আমি যদি এখন দাবি করি, সে সময় জানতাম ম্যাচ জিতব, মিথ্যে বলা হবে। আমি সত্যিই জানতাম না কী হতে চলেছে।’
এরপরই ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা শট। হ্য়ারিস রউফের ডেলিভারি বুকের উচ্চতায়। টেনিসের ফোরহ্যান্ড রিটার্নের মতোই সাইট স্ক্রিনে ছয় মারেন বিরাট। পরের বলটি ফ্লিক শটে ছয়। বিরাটের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘এই দুটি শট আমি কোনও দিন খেলিনি, আর কোনওদিন হয়তো খেলতেও পারব না।’ হ্যারিস রউফ ঝুঁকে পড়েন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, মুখের গ্রাস কেড়ে নিলেন বিরাট কোহলি।
শেষ ওভারে অঙ্ক দাঁড়ায় ১৬ রান। ততক্ষণ এটুকু নিশ্চিত হয়ে যায়, শেষ ওভারে বোলিং করবেন নওয়াজ। যতীনকে পাল্টা বলেন বিরাট, ‘এটাই হল স্পোর্ট। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, হার্দিক স্ট্রাইকে, নওয়াজ বোলিং করছে, হার্দিক তিন বলে অন্তত দুটো ছক্কা মেরেই দেবে। আর স্পোর্ট আমাদের বলে, এসো দেখি কেমন পারো।’ সে সময়ই যতীন বলেন, ‘খেলা হবে’। বিরাটও হেসে বলেন, ‘একদম ঠিক, এই মুহূর্তটা ছিল, খেলা হোবে।’
নওয়াজের প্রথম ডেলিভারিতেই বড় শট খেলার চেষ্টায় ক্যাচ আউট হয়ে ফেরেন হার্দিক। কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে খেলা জিতেছিল ভারত। জিতেছিলেন বিরাট কোহলি। তবে অশ্বিনের অবদানটা ভুলছেন না। কী হয়েছিল মনে পড়ে? বিরাট যা বলছেন, সেটা থেকেই কল্পনা করুন! শেষ ১ বলে ২ রান। স্ট্রাইকে অশ্বিন। কেউ হয়তো বলতেই পারেন, এটা আর কী কঠিন কাজ? আসলে তার আগের ডেলিভারিতেই জয়ের গন্ধ পেয়েছিলেন বিরাট। কী ভাবে?
তার আগে একটি ডেলিভারি ফ্রি-হিট ছিল। বোল্ড হন বিরাট। বল যায় থার্ডম্যানে। ফ্রি-হিটে বোল্ড আউট হবে না। আর বলও ডেড হয়নি। বল এমন জায়গায় গেল যেখানে শাহিন ফিল্ডিং করছিলেন। বিরাট লক্ষ্য করেছিলেন, শাহিন খোড়াচ্ছে। তিন রান নিতে দ্বিধা করেননি। সেখানেই বিরাট জয়ের গন্ধ পান। এ বার শেষ বলের গল্পে আসা যাক। অশ্বিন স্ট্রাইকে। বিরাট তাঁকে আগেই অনুমান করে বলেন, পা লক্ষ্য করেই বলতে করতে পারে। সুতরাং, অশ্বিন যেন অনসাইডে না খেলে। বরং রুম বানিয়ে কভারের উপরে খেলুক। কিন্তু অশ্বিন যা করেছিলেন তা চমকে দেয় বিরাটকেও।
নওয়াজ পা লক্ষ্য করেই বল করছিলেন। অশ্বিন এত দ্রুত সরে যান, ওয়াইড বল হয়। বিরাট হেসে বলেন, ‘আমি শুধু সে সময় ভাবছিলাম, বলটা যদি প্যাডে লাগত!’ ওয়াইড হওয়ায় শেষ বলে ১ রান প্রয়োজন ছিল। ঘাবড়ে গিয়ে নওয়াজ মিডল স্টাম্পে বল করেন। কিন্তু গতি বেশি ছিল। অশ্বিন রুম বানিয়ে মিড অফের উপর দিয়ে মারেন। ভারতের ঐতিহাসিক জয়। বিরাট বলেছিলেন খেলা হবে, খেলা হয়েছিল, জিতেছিল ভারতই।