Lionel Messi: চোখের জল, মুক্তো ঝরা হাসি আর সোনার বল!
আমার সাম্রাজ্য তোমাকে দিয়ে গেলাম। ছেলেবেলা থেকে যার প্রেমে আকুল থেকেছি, সেই প্রিয় বলটা তোমাকে দিয়ে গেলাম। আজ থেকে আমিও তোমাকে ঈশ্বর বলে ডাকব!
প্রিয় মেসি,
চোখের জল বড় সংক্রামক। কখনও খুব অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ভরা মঞ্চে, কোটি কোটি লোকের সামনে যখন কেউ কাঁদে! মনে হয়, এত দিনের জমিয়ে রাখা স্বপ্ন, আবেগ, না-পাওয়ার আক্ষেপ, হতাশা- সব গলে যাক। ঝরে যাক। ভিজিয়ে দিক আকন্ঠ। চোখের জলই পারে নির্ভার করতে। দুঃখ ভোলাতে। আর কেউ যদি শুধু হেসেই চলে? দি মারিয়ার বুকে, আলভেরাসের কাঁধে, মার্তিনেজের জার্সি খামচে ধরে, ওতামেন্দিকে জড়িয়ে ধরে? চোখ তবু কেন ভিজে যে যায়!
তোমার ঈষৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর সময় মোহিত হয়ে দেখছিলাম। থমকে যাচ্ছিলাম, বিপক্ষের বেড়া টপকে তোমার এঁকেবেঁকে দৌড়নোর সময় । বুক চিতিয়ে হাঁটার সময়, ঈষৎ কাঁধ তুলে দাঁড়িয়ে থাকার সময়, ক্ষোভ দেখানোর সময়, বিরক্তির সময়, আক্ষেপের সময়, পড়ে যাওয়ার সময়, উঠে দাঁড়ানোর সময়। এত ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্যেও তোমার স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিল।
একটা ফুটবল ম্যাচ আর কতটুকুই বা সময়। কেউ আজীবন এই সময়টুকু পার করার চেষ্টা করে। তোমার বোধহয় আট বছর লেগে গেল নব্বই মিনিট পার করতে। সেই ২০১৪ সালে জার্মানির কাছে হারের পর। মারাকানায় ওই বিশ্বকাপ ফাইনালটা পর মাঠের মাঝখানে অনেকক্ষণ বসেছিলে। হয়তো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলে, আর একটা ফাইনাল নেমে আসুক তোমার জীবনে। আর একবার… তোমার কাছে নব্বই মিনিটের মেয়াদ ছয় কিংবা পাঁচবছরও হতে পারে। দুটো কোপা ফাইনালে পর পর হার। তুমি বিরক্ত, রিক্ত, নিঃস্ব। ২০১৭ সালে অবসর নিয়ে নিয়েছিলে বিনা নোটিশে। তোমার ডাকে এ বার সাড়া দিলেন ঈশ্বর। সেই টাইব্রেকারেই শাপমুক্তি হল তোমার!
তুমি টাইব্রেকারে প্রথম কিকটা মারতে গেলে, দুরু দুরু করছিল বুক। তুমি হাঁটলে, থমকালে, কিক নিলে। যেন ছবি আঁকলে বাঁ পায়ের ছোঁয়ায়। ডান দিকে পড়তে পড়তে স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখল হুগো লরিস। নাকি, তোমার বিশ্বকাপ জয়ের দরজাটা হাট করে খুলে যেতে দেখল? তা-ই হয়তো! একটা বল, একটা মাঠ, একটা ১২০ মিনিট, একটা বিশ্বকাপ- যুগপৎ স্বপ্নে তখন একাকার। কাতারেই তোমায় শেষবার দেখা গেল। শেষবার তোমার পায়ে ঘুরল বল। তোমার কথা শুনল। পরম তৃপ্তি নিয়ে জালে জড়াল। শেষবার তোমার স্বপ্নে বিলীন হয়ে গেল ফুটবল।
শেষ কবে কারও জন্য এত আকুতি দেখিয়েছে ফুটবল? রোনাল্ডোর জন্য নয়। নেইমারের জন্য নয়। মদ্রিচের জন্য নয়। এত আকুল, এত স্নেহ, এত প্রশ্রয় আর কাকে দিয়েছে ফুটবল? পায়ে পায়ে হাঁটলে ফিরে যেতে হবে ৩৬ বছর আগে! দিয়েগো মারাদোনার কাছে। সেই তিনিও ফুটবলের বরপুত্র। নীলে-সাদায় একাকার। ৩৬ বছর পর আবার নীল-সাদা হয়ে গেল ফুটবল। ভুল বললাম, পুরো কাতার, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, সারা বিশ্ব। যদি মারাদোনা বেঁচে থাকতেন, যদি কাতারের গ্যালারিতে হাজির থাকতেন, তোমার জন্য উঠে দাঁড়াতেন অসংখ্য ভক্তের কাঁধে। আপ্লুত হয়ে বুক ঠুকতেন। অস্ফুটে বলতেন, আজ আমার সাম্রাজ্য তোমাকে দিয়ে গেলাম। ছেলেবেলা থেকে যার প্রেমে আকুল থেকেছি, সেই প্রিয় বলটা তোমাকে দিয়ে গেলাম। আজ থেকে আমিও তোমাকে ঈশ্বর বলে ডাকব!
জীবন অনেকটা ফুটবলের মতোই। নব্বই মিনিটের মতো। ব্যর্থতা আছে। স্বপ্নভগ্ন আছে। হার আছে। যন্ত্রণা আছে। ছোট ছোট পাসে, ঘাতক ড্রিবলে, ছোট্ট টোকায়, নিখুঁত নিশানার ফ্রি কিকে, বাঁকানো শটে তুলে আনা গোলে, পেনাল্টি কিকে কেউ কেউ সে সব পার করে সাফল্যের আকাশ খুঁজে পায়। তখনও সে কাঁদে। জমিয়ে রাখা যন্ত্রণা বের করে। পুষে রাখা ক্ষোভ গলায়। বিনিদ্র রজনী ভিড় করে আসে। একটানা, ক্লান্তিকর ব্যর্থতা থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়ে। তোমার মতো। ছোট ছোট মুক্তো দানার মতো, ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল মিছিল করে বেরিয়ে আসে। উল্লাসে, উৎসবে, হাসিতে।
রোসারিও, বুয়েনস আইরেসে, রিও দে জেনেইরোতে, নাপোলিতে, প্যারিসে, দোহায়, এমনকি, কলকাতাতেও অনেক অনেক মেসি দেখতে পেলাম। সেই ভিড়ে আমিও ছিলাম। সেই ভিড় চোখের জলে ভাসছে। মন ভালো করা হাসি হাসছে। তোমার সঙ্গেই, তোমার আগে, হয়তো তোমার পরেও ওরা হাসবে-কাঁদবে, সারারাত। হয়তো আর কখনও বিশ্বকাপে দেখবে না তোমায়। কোনও তারকা যদি তোমার মতো মেসি হয়ে ওঠে, ভরসা দেয়, তুমি ফিরে আসবে মনে, মাথায়। পেলের মতো। মারাদোনার মতো। মেসির মতো…!
ধন্যবাদ, একটা বিশ্বকাপ উপহার দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ, মুগ্ধতা নিয়ে নীল-সাদা জার্সি পরার সুযোগ দেওয়ার জন্য। ওই জার্সির পিঠে ১০ নম্বর, মেসি লেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ, ওই জার্সির নীচে নিজেকে মনে মনে মেসি ভাবার সুযোগ দেওয়ার জন্য!
ভালো থেকো ঈশ্বর।
ইতি,
এক ফুটবল পাগল
অভিষেক সেনগুপ্ত