Nandigram: আজকের দিনেই ‘রক্তে স্নান করেছিল’ নন্দীগ্রাম! কী হয়েছিল সে দিন?
Nandigram: কিছু ছবি আজও চোখের সামনে স্পষ্ট। কিছু স্লোগান আজও কানে ভাসে। নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গে যখনই কথা ওঠে, তখনই যেন কানের পাশ দিয়ে কিছু অচেনা কণ্ঠ স্লোগান দেয়... "রক্ত দেব, প্রাণ দেব.. নন্দীগ্রাম দেব না" বা "তোমার নাম... আমার নাম... নন্দীগ্রাম, নন্দীগ্রাম ৷"
নন্দীগ্রাম ও কলকাতা : ২০০৭ সাল। ১৪ মার্চ। সেদিন রক্তাক্ত হয়েছিল নন্দীগ্রাম। তারপর ১৫ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনও দগদগে। কিছু ছবি আজও চোখের সামনে স্পষ্ট। কিছু স্লোগান আজও কানে ভাসে। নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গে যখনই কথা ওঠে, তখনই যেন কানের পাশ দিয়ে কিছু অচেনা কণ্ঠ স্লোগান দেয়… “রক্ত দেব, প্রাণ দেব.. নন্দীগ্রাম দেব না” বা “তোমার নাম… আমার নাম… নন্দীগ্রাম, নন্দীগ্রাম ৷” নন্দীগ্রামের এই অধ্যায় আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার রাজনীতির সঙ্গে। জড়িয়ে আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানেও। এমনকী আজ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক কেরিয়ারের সূচনা নন্দীগ্রামে লড়াইয়ের মধ্যে। সম্প্রতি এই নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করেই একুশে নির্বাচনে মমতা-শুভেন্দুর যুযুধান লড়াইয়ে সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। কী হয়েছিল সে দিন, যার পর নন্দীগ্রাম নন্দীগ্রাম হয়ে ওঠে?
প্রেক্ষাপট:
রাজ্যে তখন বাম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্যের কোণায় কোণায় তখন রব উঠছে, কাজ চাই। আর কাজের জোগান দিতে রাজ্যে শিল্প টানতে মরিয়া বাম সরকার। যেভাবেই হোক, শিল্প আনতেই হবে। যোগাযোগ হল সালেম গোষ্ঠীর সঙ্গে। ইন্দোনেশিয়া থেকে সালেম গোষ্ঠীকে ডেকে আনলেন বুদ্ধবাবু। ঠিক হল, কেমিক্যাল হাব তৈরি হবে বাংলায়। জায়গাও স্থির হয়ে গেল। স্পেশাল ইকোনমিক জ়োন। নন্দীগ্রাম। কিন্তু তার জন্য তো জমি লাগবে। সরকার জানাল, জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। নন্দীগ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে হলদি নদী। ওপারে হলদিয়া। বিশাল শিল্পাঞ্চল। বুদ্ধবাবুর সরকার সিদ্ধান্ত নিল, হলদি নদীর এ পারেও তৈরি হবে শিল্প বলয়। তাই সব দিক বিবেচনা করে নন্দীগ্রামকেই বেছে নিল সরকার।
নন্দীগ্রামে ‘লক্ষণশেল’
২০০৬ সাল। ডিসেম্বর মাস। হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের সর্বেসর্বা তখন লক্ষ্মণ শেঠ। দাপুটে নেতা। বলা হয়, তাঁর ভয়ে তখন বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। ২৮ ডিসেম্বর তিনি এক নোটিস জারি করেন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের তরফে। আর এটাই কাল হল। নোটিসে বলা হয়, নন্দীগ্রামের ২৫টি ও খেজুরির ২টি মৌজা মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করবে সরকার। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল নন্দীগ্রামের। ঘর ছেড়ে, জমি ছেড়ে যাবেন কোথায় তাঁরা! রুখে দাঁড়ালেন গ্রামবাসীরা। স্লোগান উঠল – রক্ত দেব, প্রাণ দেব নন্দীগ্রাম দেব না। বাম সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হল গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের আন্দোলন। তৈরি হল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। আর সেই প্রতিরোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযোগ করলেন, জোর করে কৃষি জমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।
আগুন জ্বলে উঠল নন্দীগ্রামে। একদিকে লক্ষ্মণ শেঠের নোটিস। অন্যদিকে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। আর সঙ্গে বিরোধীদের ঘৃতাহুতি। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি। হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের নোটিসের বিরুদ্ধে কালীচরণপুর পঞ্চায়েত ঘেরাও করেন বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা। আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে রণং দেহি মূর্তি নেয় পুলিশ। লাঠি চার্জ হয়। পাল্টা আগুন জ্বলে পুলিশের জিপেও। এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় নন্দীগ্রামে। নন্দীগ্রামে ঢোকার একাধিক রাস্তা কেটে দেন আন্দোলনকারীরা। কোথাও আবার রাস্তার উপর বড় বড় গাছ ফেলে দেওয়া হয়। রাতারাতি এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয় নন্দীগ্রাম। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির পাশে দাঁড়ায় তৃণমূল, এসইউসিআই, কংগ্রেস।
প্রথম রক্তাক্ত
এরপর, ৭ জানুয়ারি। গুলি চলল নন্দীগ্রামে। মারা গেলেন পাঁচ জন। কাঠগড়ায়, স্থানীয় সিপিএম নেতা শঙ্কর সামন্ত। অভিযোগ, শঙ্কর সামন্তের বাড়ি থেকেই গুলি চলেছিল। নন্দীগ্রাম তখন ফুঁসছে। শঙ্কর সামন্তের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িতেই আগুনে পুড়ে মারা যান সিপিএম নেতা। বুদ্ধবাবু তখনও দোষ চাপাচ্ছেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির উপরেই। এদিকে, স্থানীয় সিপিএম নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলতেই থাকে। মাঝে, বুদ্ধবাবুর সরকার নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সঙ্গে মাওবাদী ইন্ধনের একটি তত্ত্বও খাঁড়া করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন আন্দোলনকে দমানো যাচ্ছে না।
অনড় বুদ্ধ ও কুরুক্ষেত্র নন্দীগ্রাম
এদিকে রাজ্য সরকারও একরোখা। যেন-তেন-প্রকারে শিল্প টানতেই হবে রাজ্যে। কিন্তু এভাবে আন্দোলন চলতে থাকলে, সালেমরা যদি বেঁকে বসে? কিছুটা হয়ত সেদিন ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল বুদ্ধবাবুর সরকার। প্রমাদ গুনল সরকার। খেজুরিতে চলে গেলেন বুদ্ধবাবু। সভা করলেন। বললেন, যাঁরা জমি দিতে অনিচ্ছুক, তাঁদের থেকে জমি নেওয়া হবে না। কিন্তু তাতেও কোনও কাজ দিল না। তাই কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হল সরকারকে। নির্দেশ দেওয়া হল, আন্দোলনকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার। এরপর এল ১৪ মার্চ। প্রায় হাজার তিনেক পুলিশ ঘিরে ফেলল গোটা নন্দীগ্রাম। অভিযোগ ওঠে, পুলিশের উর্দি গায়ে হাওয়াই চটি পায়ে কিছু মানুষও যোগ দেয়। সবাই সশস্ত্র। বিরোধীরা বলেন, তারা নাকি ছিল সিপিএমের ক্যাডার বাহিনী। প্রত্যেকে প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র।
গ্রামবাসীদের কাছে আগে থেকেই কোনওভাবে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁরাও প্রস্তুত ছিলেন। দা, হাঁসুয়া, তির ধনুক হাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলল নন্দীগ্রামের মানুষ। প্রায় হাজার পাঁচেক গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে গড়ে উঠল প্রতিরোধ বাহিনী। সামনের সারিতে ছিল মহিলারা ও শিশুরা। মহিলাদের কারও হাতে ঝাঁটা, কারও হাতে খুন্তি – যে যা পেয়েছেন, তাই নিয়ে চলে এসেছেন জমি বাঁচাতে।
পুলিশ দুটি দলে ভাগ হয়ে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করে। একটি দল তেখালি সেতু দিয়ে। অন্য দলটি ভাঙাবেড়া সেতু দিয়ে। পুলিশ মাইকিং করে। কিন্তু রাস্তা আগলে জান কবুল লড়াই চালিয়ে যায় নন্দীগ্রাম। এরপর পুলিশ জোর করে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করতেই শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ। প্রথমে কাঁদানে গ্যাস। তারপর রবার বুলেট। শেষে গুলি। সরকারি হিসেবে ১৪ জন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। নিখোঁজ হন অনেকে। আহতের সংখ্যা আরও বেশি। সেদিন রক্তে স্নান করেছিল নন্দীগ্রাম।
নন্দীগ্রাম পরবর্তী অধ্যায়
সিঙ্গুর আন্দোলনে বামেদের বাংলার লাল দূর্গে যে ফাটল ধরেছিল, নন্দীগ্রামে তা একেবারে দুরমুশ হয়ে যায়। এদিকে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে ‘দেওয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের সিড়ি আরও মজবুত হয়। সেদিন মমতার নেতৃত্বে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তাঁর অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, শেখ সুফিয়ানরা। সেদিনের গণহত্যার পর পনেরো বছর কেটে গিয়েছে। রাজ্যে ঐতিহাসিক পালাবদল হয়েছে। বাম দূর্গের পতন ঘটিয়ে সরকার গড়েছেন মমতা। সেদিনের লাল বাংলা আজ সবুজে সবুজ। শহিদ বেদী তৈরি হয়েছে নন্দীগ্রামে। প্রতি বছর আজকের দিনটা নন্দীগ্রাম দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্য়েও অনেক জায়গাতেই ফাটল থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, নন্দীগ্রামের সেই প্রান্তিক মানুষগুলো আজ কেমন আছেন।
সেদিন নন্দীগ্রামের ভরসার ‘দাদা’ আর ‘দিদি’ আজ আড়াআড়ি বিভক্ত। শুভেন্দু আজ আর মমতার বিশ্বস্ত সেনাপতি নন, এখন তিনি বিজেপিতে। উঠতে বসতে আক্রমণ শানাচ্ছেন একে অন্যকে। আর চলছে, নন্দীগ্রাম কার বেশি আপন, তা প্রমাণের লড়াই। আর এই লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে, যাঁদের জন্য সংগ্রাম, সেই নন্দীগ্রামের প্রান্তিক মানুষরাই ভুক্তভোগী হচ্ছেন না তো? আরও একবার সেই প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে আজকের নন্দীগ্রাম দিবসে।
আরও পড়ুন : Harassment Case: এম পি বিড়লা স্কুলের মধ্যেই ছিল নির্যাতনের অভিযোগ! প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস অভিযুক্ত
আরও পড়ুন : HS Exam 2022: উচ্চমাধ্যমিকের মাঝে কীভাবে উপনির্বাচন? দ্রুত অবস্থান জানাবে রাজ্য