তালিবানকে ‘কমিউনিস্ট’ ভাবতেন লাদেন, একদিন তাঁর কাছে নিজেই গেলেন মোল্লা ওমর
মার্চ ১৯৯৭-তে, লাদেন শর্ত ভাঙল। সিএনএন-কে ঝাঁঝালো ইন্টারভিউ দিল। লাদেনের মতে, সৌদি রাজ্ পরিবার আমেরিকার অধীনস্থ এবং শরিয়া অনুযায়ী তাঁরা অ-মুসলিম!
শৌর্য ভৌমিক: হিন্দু কুশ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জালালাবাদ। সেখান থেকে ৫ মাইল দক্ষিণে নদীর পাশে সোভিয়েত সেনার ফেলে যাওয়া ছাউনিতে ঘাঁটি বানাল ওসামা বিন লাদেন। নাম দিল নাজম-আল-জিহাদ (ষ্টার অব দ্য হোলি ওয়ার)। অদূরেই তোরাবোরার গুহায় জাঁকিয়ে চালু করল মধুর ব্যবসা। কিন্তু তালিবান এবং বিন লাদেন পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দিহান। বিন লাদেনের ধারণা, তালিবান কমিউনিস্ট। তালিবানের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী আবার বলছে- “আমরা চাইনা গোপনে আমাদের দেশ থেকে অন্য দেশে নাশকতামূলক কাজকর্ম হোক”। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। কারণ ৯৬-এর এই বিবৃতি ফেব্রুয়ারি ২০২০র আমেরিকা- তালিবান দোহা চুক্তির মতো। যেখানে বলা হয়েছে আল-কায়দাকে আফগান মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
লাদেনের আফগানিস্তান আসা ছিল তালিবানের কাছে সুযোগ। ধারণা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশকে গড়ে তুলবেন গৃহনির্মাণ ব্যবসায় রাজত্ব করা, লাদেন পরিবার। লাদেন তখন তোরাবোরার গুহকে ভাবছে মদিনার গুহা, নিজেকে ভাবছে প্রফেট। জীবনযাপন, খাওয়াদাওয়াও প্রফেটের অনুকরণে। মোল্লা ওমর বার্তা দিলেও তালিবরাও তো মদিনার গুহায় থাকা প্রফেটের ছাত্রের মতো। শর্ত একটাই। তালিবানের সাহায্যকারী সৌদি আরবকে আক্রমণ করা যাবে না এবং মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা বারণ।
মার্চ ১৯৯৭-তে, লাদেন শর্ত ভাঙল। সিএনএন-কে ঝাঁঝালো ইন্টারভিউ দিল। লাদেনের মতে, সৌদি রাজ্ পরিবার আমেরিকার অধীনস্থ এবং শরিয়া অনুযায়ী তাঁরা অ-মুসলিম! আমেরিকার বিরুদ্ধেও যুদ্ধের ডাক দিল, কারণ আমেরিকা ইজরায়েলের সমর্থক। এবার মোল্লা ওমর নিজেই গেল লাদেনের কাছে। জানিয়ে দিল কান্দাহারে থাকতে হবে লাদেনকে। লক্ষ্য, লাদেনকে নজরবন্দি রাখা। লাদেনের কান্দাহারের আস্তানার বাইরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল দুটো সোভিয়েত জমানার ট্যাঙ্ক ।
কিন্তু লাদেনের জিহাদের ডাকে সাড়া পড়তে শুরু করেছে। সৌদিদের কাছে খবর এল, লাদেন অস্ত্র চোরাচালান করছে তাদের দেশে। চেষ্টা চালাচ্ছে তার অনুগামীদের মাধ্যমে পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ করার। ১৯৯৮, রাজপরিবারের প্রিন্স তুর্কি বিন ফাইজল আল সাউদ রওনা দিলেন কান্দাহারের উদ্দেশে। ওমরের সঙ্গে দেখা করে দাবি করলেন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ বেঁকে বসলেন ওমর।
পশতু ট্রাইবাল বিধি। বিধি মোতাবেক অতিথির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা যায় না। কিন্তু আফগানিস্তানের ইতিহাস সাক্ষী, টাকা দিয়েও ‘খরিদ’ করা যায় ‘ইমান’। সৌদিদের তরফ থেকে বিপুল অর্থ, ৪০০ ট্রাকের সঙ্গে এসে পৌঁছল ওমরের দরবারে। দেড়মাস বাদেই সৌদিদের সাহায্যে বিরোধীদের দখলে থাকা মাজার-ই- শরিফ চলে এল তালিবানের কব্জায়। লাদেনের সাহায্য নিতেও পিছপা হয়নি ওমর। লাদেনের কয়েক’শ আরব যোদ্ধা যোগ্য সঙ্গ দিল তালিবানের। দু’দিন ধরে কচুকাটা করা হল শিয়া সম্প্রদায়ের হাজারাদের। ধর্ষণ করে, তপ্ত মরুভূমিতে ফেলে রেখে মারা হল অনেককে। আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল ৫০০০ কিলোমিটার দূরে।
সুদূর আফ্রিকার তানজানিয়া এবং কেনিয়াতে মার্কিন দূতাবাসে ট্রাক বোমায় উড়ে গেল ২০০ প্রাণ। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র সরাসরি যোগ পেল আল-কায়দার। আমেরিকা চুপ করে বসে থাকার নয়। শুরু হল অপারেশন ইনফাইনাইট রিচ। আফ-পাক সীমান্তের খোস্ত প্রদেশে অবিরাম মিসাইল বর্ষণ। কিন্তু ভুল ছিল মার্কিন ইন্টেলিজেন্স। অর্ধেকের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র পড়ল পাকিস্তানে। দু’জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হল। আফগানিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ল মসজিদে বা কারও বাড়ির শৌচাগারে। ২২ সাধারণ আফগান নিহত হলেন। কিছু টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ফাটেনি। সেগুলো চিনকে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিল লাদেন।
আরও বড় হিরোতে পরিণত হল বিন লাদেন। ওমর গেল রেগে। লাদেনকে সৌদিদের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও সুযোগ রইল না। ওমর ফোন করল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে। সোজা জানিয়ে দিল ইসলামিক বিশ্বে মার্কিন বিরোধী মনোভাব জেগেছে। সন্ত্রাসবাদী ঘটনা বাড়বে। উপায় একটাই, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যেন পদত্যাগ করেন! লাদেন অন্যদিকে সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখাল ওমরকে। বলল ওমর হচ্ছে ‘আমির অব মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ এবং সমগ্র মুসলিম দুনিয়া যেন তালিবানের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এরপরে আর লাদেন-ওমর জুটিকে আটকানো যায়নি। ঠিক ৩ বছর বাদেই লাদেনের স্বপ্ন সফল। চূর্ণ হল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। আরও পড়ুন: স্লিপার সেলকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ, দেশের একাধিক শহরে হামলার ছক কষছে তালিবানের প্রতিপক্ষ!