Uber: চালকদের দাঙ্গার মুখে ফেলতেও দুইবার ভাবেনি ‘উবার’! লক্ষাধিক নথি ফাঁস, সামনে সংস্থার ভয়ঙ্কর রূপ
Leaked Uber Files: 'উবার' সংস্থার ধূমকেতু-সম উত্থান একেবারেই সোজা পথে নয়। আইন ফাঁকি দেওয়া, সাংসদ-বিধায়কদের সঙ্গে যোগসাজশ করা, আইনের ফাঁক খুঁজে তার সুযোগ নেওয়া, এমনকি, চালকদের নিরাপত্তার সঙ্গে আপোস করতেও ছাড়েনি তারা।
নয়া দিল্লি: গত এক দশকে ভারত ও গোটা বিশ্বে ধূমকেতুর গতিতে উত্থান ঘটেছে ‘উবার’ সংস্থার। বর্তমানে বিশ্বের ৭২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে উবারের ব্যবসা। সব মিলিয়ে এখন সংস্থার মূল্য ৪৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে, উবারের এই বিস্ময়কর উত্থান কিন্তু একেবারেই সোজা পথে নয়। বরং, সংস্থার এই ব্যপ্তির পিছনে রয়েছে আইন ফাঁকি দেওয়া, সাংসদ-বিধায়কদের সঙ্গে যোগসাজশ করা, আইনের ফাঁক খুঁজে তার সুযোগ নেওয়া। এমনকি, তাদের নিজেদের ক্যাব-চালকদের নিরাপত্তার বিনিময়েও তারা সংস্থার ব্যবসা বাড়াতে চেয়েছে। সম্প্রতি, উবারের অভ্যন্তরীণ কিছু নথি ফাঁস হয়েছে। সামনে এসেছে তাদের এক ভয়ঙ্কর রূপ।
‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এক গোপন সূত্রে ওই নথিগুলি সংগ্রহ করেছে। নথিগুলি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট বা আইসিআইজে (ICIJ)-র সঙ্গে শেয়ারও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১,২৪,০০০টি ইমেল, বার্তা এবং অন্যান্য নথি রয়েছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে এক ২৫ বছর বয়সী তরুণীকে ধর্ষণ করেছিল উবার চালক। সেই ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ করলেও, নেপথ্যের ইমেল বলছে অভিযুক্ত ড্রাইভারের দায় নেয়নি উবার।
ওই ঘটনায় উবার সংস্থার ভারতীয় শাখায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। কীভাবে বিষয়টি সামাল দেওয়া হবে, তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল শীর্ষ কর্তাদের মধ্যে। তারা চালকের দায় না নিয়ে, ভারতের তথ্যভাণ্ডারের ত্রুটিকে দায়ী করতে চেয়েছিল। বলেছিল, বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেওয়ার সময়, সরকার ভালভাবে চালকদের ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করেনি। উবারের কমিউনিকেশন হেড, নাইরি হাউরদাজিয়ান এক সহকর্মীকে ইমেল পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন যে সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। কখনও কখনও আমাদের সমস্যা হবে। কারণ, আমাদের অনেক কাজই অবৈধ’।
পাশাপাশি, সরকারি তদন্তের হাত থেকে বাঁচতে তারা ব্যবহার করত ‘কিল সুইচ’। কী এই কিল সুইচ? সরকারের যাতে তাদের প্রধান ডেটা সিস্টেম থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে না পারে, তার জন্য উবার সংস্থা তাদের সফটওয়্যারটি বন্ধ করে দিত। উবার-এর অফিসে অভিযান হবে, এরকম জানতে পারলেই সংস্থার পক্ষ থেকে সংস্থার তথ্য-প্রযুক্তি কর্মীদের সফটওয়্যারটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ পাঠানো হত। ফলে, তাগের অফিসে হানা দিয়েও, কর্তৃপক্ষ কোনও প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারত না। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে ভারত, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, হাঙ্গারি এবং রোমানিয়ায় অবস্থিত উবারের বিভিন্ন কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের সময় অন্তত ১২ বার এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে এবং ২০২১ সালে, উবারের বেঙ্গালুরু অফিসে দুবার অভিযানের সময় এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছিল।
উবারের ফাঁস হওয়া ফাইলগুলি থেকে জানা গিয়েছে, স্থানীয় ট্য়াক্সি পরিষেবাকে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে বিভিন্ন দেশেই সেখানকার সাংসদ-বিধায়ক-নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিল। সংস্থার প্রাক্তন সিইও ট্রাভিস কালানিক এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর যেমন গলায় গলায় সম্পর্ক ছিল। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ফ্রান্সে সংস্থার ব্যবসা বৃদ্ধিতে অবৈধভাবে সহায়তা করেছিলেন ম্যাক্রঁ, ফাঁস হওয়া নথিগুলি থেকে এমনটাই জানা গিয়েছে। এমনকি, ম্যাক্রঁ না কি ফরাসি মন্ত্রিসভায় বিরোধী পক্ষের সঙ্গে একটি গোপন ‘চুক্তি’ পর্যন্ত করেছিলেন। এছাড়াও, আপাতদৃষ্টিতে সংস্থার বৃদ্ধির জন্য জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিলেন কালানিক।
ফাঁস হওয়া নথিতে আরও দেখা গিয়েছে, দাঙ্গা-হিংসার মতো ঘটনাকেও উবার তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির কাজে লাগিয়েছিল। এর জন্য নিজেদের চালকদেরই নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করেছিল সংস্থা। প্যারিসে ট্যাক্সি ধর্মঘট এবং তাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গাহাঙ্গামার সময়, একের পর এক উবারচালক হামলার মুখে পড়েছিলেন। সংস্থার প্রাক্তন সিইও কালানিক অন্যান্য কর্তাদের বলেছিলেন, ‘আমার মতে এটা (চালকদের উপর হামলা) সংস্থার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান… এই হিংসা সংস্থার সাফল্যকে নিশ্চিত করবে।’
এই ভয়ঙ্কর তথ্য ফাঁসের ফলে স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে পড়েছে উবার। সংস্থার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উবার অতীতের ‘ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ’গুলি মেনে নিচ্ছে। তবে ২০১৭ সলের পর থেকে গত পাঁচ বছরে সংস্থা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ‘বিষাক্ত কর্ম সংস্কৃতির প্রচার’ এবং ‘উবারে লিঙ্গ বৈষম্য এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ উপেক্ষা করা’র অভিযোগে বিদ্ধ হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সংস্থার প্রাক্তন সিইও কালানিক। বর্তমানে সংস্থার প্রধান দারা খোসরোশাহী।