বিশ্লেষণ: দেউলিয়া হতে বসেছে ভোডাফোন, কেন এমন অবস্থা? কী প্রভাব পড়তে পারে আপনার ওপর?

Explained: দেনার দায়ে ডুবতে বসেছে ভোডাফোন। তারই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন ভোডাফোন-আইডিয়ার চেয়ারম্যান কুমার মঙ্গলম বিড়লা।

বিশ্লেষণ: দেউলিয়া হতে বসেছে ভোডাফোন, কেন এমন অবস্থা? কী প্রভাব পড়তে পারে আপনার ওপর?
অলংকরণ- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Aug 15, 2021 | 3:48 PM

বিপুল লোকসান হয়েছে আগেও। এক সময় প্রচুর টাকার দেনার দায়ে ভারতে ব্যবসা গোটাতে বসেছিল ভোডাফোন। পরে সেই পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠলেও ফের একবার খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে এই টেলিকম সংস্থা। সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ এসেছে, তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে কোনোরকম আর্থিক সাহায্য না পেলে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে ভোডাফোন। আর যদি ভোডাফোন কোনও কারণে ডুবে যায় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংস্থার গ্রাহকরা, সংস্থার বহু কর্মী ও ভারতের টেলিকমের বাজার।

ভোডাফোনের ব্যবসা যদি সত্যিই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ভারতের বৃহত্তম টেলিকম কোম্পানি হিসেবে পড়ে থাকবে এয়ারটেল ও জিও। ভোডাফোনের বিপুল সংখ্যক গ্রাহক সমস্যায় পড়বেন, কর্মীরা কাজ হারাবেন। তবে এক বড় সমস্যায় পড়তে পারে কেন্দ্রীয় সরকারও। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিকম সংস্থার ব্যবসা ডুবে গেলে ভবিষ্যতে অন্য কোনও বিদেশি টেলিকম সংস্থা ভারতের বাজারে আসার আগে দু’বার ভাববে, এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাই এই মুহূর্তে ভোডাফোনের ঘুরে দাঁড়ানো সবার জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়াতে হল ভোডাফোন-আইডিয়া কে?

ঘুরে দাঁড়াতেই জুড়েছিল ভোডাফোন ও আইডিয়া:

কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে সংস্থার সাম্প্রতিক ইতিহাসে। মুকেশ আম্বানীর জিও-কে টেক্কা দিতে গাঁটছড়া বাঁধে ভোডাফোন ও আইডিয়া। ইউকে-র সংস্থা ভোডাফোন ও আদিত্য বিড়লা গ্রুপের আইডিয়া একজোট হয় ২০১৭ সালে। এই যৌথ প্রয়াসে ভোডাফোনের হাতে ছিল ৪৫ শতাংশ স্টেক ও আইডিয়ার হাতে ছিল ২৭ শতাংশ স্টেক। কিন্তু এই গাঁটছড়া বাঁধার পর থেকে কোনও ত্রৈমাসিকেই লাভের হিসেব দিতে পারেনি ভোডাফোন। দিনের পর দিন লোকসানের বোঝা বাড়তে থাকে।

জিওর ধাক্কায় বেসামাল ভোডাফোন

বাজারে এসেই কার্যত বিপ্লব ঘটিয়েছিল রিলায়েন্স। এত সস্তায় কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আগে ভারতে কোনও সংস্থায় দেয়নি। বিপুল সংখ্যক গ্রাহক টানার চেষ্টায় অস্বাভাবিক কম দামে ডেটা প্ল্যান আনে জিও। স্বাভাবিকভাবেই দেশ জুড়ে গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকে এই সংস্থার। সেই সময়ই বহু গ্রাহক হারায় ভোডাফোন, এয়ারটেলের মতো সংস্থা। শুধু তাই নয় জিওর সঙ্গে টেক্কা দিতে প্ল্যানের দাম অনেকটাই কমাতে হয় এই সংস্থাগুলিকে। আর তার জেরেই দিনের পর দিন ক্রমশ দেনায় ডুবে যেতে থাকে ভোডাফোন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই আইডিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে এই সংস্থা। এই দুই সংস্থা একজোট হয়ে ওঠা হওয়ার পর এরাই হয় ভারতের বৃহত্তম টেলিকম সংস্থা। এই সংস্থার গ্রাহকসংখ্যা ৪৩০ মিলিয়ন।

দেনার বোঝা ১.৮ লক্ষ কোটি

শুধু আইডিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাই নয়, সংস্থাকে দাঁড় করাতে সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছিল ভোডাফোন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি খুব একটা। প্রত্যেকটা ‘ত্রৈমাসিকে শুধুই ভোডাফোনের লোকসানের হিসেব সামনে এসেছে। জিও কে সামলানো যে খুব একটা সহজ হচ্ছে না তা কিছু দিনেই বুঝে গিয়েছে ভোডাফোন। দেনার ওপর দেনা চাপতে থেকেছে এই সংস্থার। বর্তমানে সেই দিনা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১.৮ লক্ষ কোটিতে। এরই মধ্যে থাবা বসিয়েছে করোনা পরিস্থিতি। বাকি পাঁচটা সংস্থাও যখন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে, বাদ যায়নি ভোডাফোন। তবে অতিমারি মূল কারণ নয়, ১৪ বছর ধরে চলে থাকা সমস্যাই কোণঠাসা করে দিয়েছে এই সংস্থাকে।

অলংকরণ- অভীক দেবনাথ

বকেয়া মেটাতে হবে ৫০ হাজার কোটি

ভোডাফোনের সামনে যেটা সবথেকে বড় কাঁটা, সেটা হল অ্যাডজাস্টেড গ্রস রেভিনিউ। কয়েক হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে ভোডাফোনের। এ সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। বছর কয়েক আগেও এই বকেয়ার ধাক্কাতেই কার্যত ব্যবসা গোটানোর অবস্থা হয়েছিল ভোডাফোনের। শুধু ভোডাফোন নয় এই বকেয়ার বোঝা চেপেছিল এয়ারটেলের ঘাড়ে্রও। এই সমস্যা নিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল টেলিকম সংস্থাগুলি। কিন্তু তাতে খুব বেশি সুরাহা হয়নি। শুধু বকেয়া মেটানোর মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের তরফে। সেই নির্দেশ মতো ২০৩১- এর ৩১ মার্চের মধ্যে বকেয়া টাকা মেটাতে হবে। টেলিকম বিভাগের পক্ষে গিয়েছিল আদালতের সেই রায়। টেলিকম বিভাগের হিসেব অনুযায়ী ১.৫২ লক্ষ কোটি টাকা মেটাতে হবে এই সংস্থাগুলিকে। এর মধ্যে সবথেকে বেশি অঙ্কের বকেয়া ভোডাফোনেরই। ভোডাফোনকে মেটাতে হবে ৫৮ হাজার কোটি টাকা, এয়ারটেলকে মেটাতে হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

তুলনামূলকভাবে জিওর বকেয়া অনেকটাই কম মাত্র ১৯১ কোটি টাকা, ইতিমধ্যে ৭,৮৫৪ হাজার কোটি টাকা মিটিয়েছে ভোডাফোন। বাকি রয়েছে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-এ পরের কিস্তির টাকা দিতে হবে ভোডাফোনকে। টেলিকম বিভাগের ওই হিসেবে ভুল ছিল, এমন দাবি জানিয়েই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল এই সংস্থাগুলি। পুনরায় হিসেব কষার আর্জি জানানো হয় আদালতে। কিন্তু আদালত সেই আর্জি খারিজ করে দিয়েছে ও ডেডলাইনের মধ্যে টাকা জমা করার নির্দেশ দিয়েছে।

কুমার মঙ্গলম বিড়লার পদত্যাগের পর থেকেই ধসের মুখে ভোডাফোন

ভোডাফোন-আইডিয়া বোর্ডের নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যানের পদ থেকে কয়েক দিন আগেই ইস্তফা দিয়েছেন কুমার মঙ্গলম বিড়লা। গত ৪ আগস্ট ইস্তফা দেন তিনি। আর সেই খবর প্রকাশে আসতেই ধস নামতে শুরু করেছে সংস্থায়। এক ধাক্কায় পতন হয় ভোডাফোন আইডিয়া শেয়ার। স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও কমছে। ভোডাফোনের এই বিপুল দেনার মধ্যে চেয়ারম্যানের পদত্যাগ সংস্থাকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পদত্যাগের কিছুদিন আগেই কেন্দ্রকে একটি চিঠি লিখেছিলেন কুমার মঙ্গলম বিড়লা। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর অংশীদারিত্ব ছেড়ে দিতে চান কেন্দ্রের হাতে। কেন্দ্রকে তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ভোডাফোনকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। সরকারি বা বেসরকারি কোনোরকম আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া সংস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোনও উপায় নেই। তাই তিনি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে ২৭ কোটি গ্রাহকের কথা ভেবে তিনি তাঁর অংশিদারিত্ব সরকার বা কোনও পাবলিক সেক্টরের হাতেই তুলে দিতে চান।

ভোডাফোনের ব্যবসা ডুবলে কী হবে

সংস্থা যদি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে না পারে তাহলে সরাসরি প্রভাবিত হবে সাধারণ মানুষ থেকে সরকার। বিভিন্ন খাতে বিপুল বকেয়া টাকা ভোডাফোনের কাছে সরকার পায় তা আর পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয় যে সব ব্যাঙ্কের কাছে ভোডাফোনের ঋণ রয়েছে, সেই ঋণও সরকারকেই মেটাতে হবে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সহ মোট আটটি ব্যাংকে ঋণ রয়েছে এই সংস্থার। ভোডাফোন দেউলিয়া হয়ে গেলে সেই টাকা সরকারকে মেটাতে হবে। আর সংস্থার কাজ বন্ধ হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই কাজ হারাবেন সংস্থার কর্মীরা। ভোডাফোনের চলে গেলে ভারতের টেলিকমের বাজারে পড়ে থাকবে আর দুটি বড় সংস্থা এয়ারটেল ও জিও। সাধারণ মানুষের থেকে একটি অপশন চলে যাবে। এর ফলে ওই দুই সংস্টার ট্যারিফ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেলেও কিছু করার থাকবে না।

দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ এই সংস্থার গ্রাহক। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কর্মী। তাই প্রভাব পড়ার আগে ভোডাফোনের ঘুরে দাঁড়ানো জরুরি। কী ভাবে সংস্থা টিকভে, সে ব্যাপারে এখনও কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: এ বার ঘরে বসেই বদলির আবেদন! ‘উৎসশ্রী’র সব প্রশ্ন জানুন এক ক্লিকে