দয়া করে আগুন নিয়ে খেলবেন না, ক্ষমা চান, মমতাকে রাজ্যপাল
গতকাল মুখ্যসচিব ও রাজ্য পুলিসের ডিজির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে রাজ্যপাল বলেন,"ওনারা কোনও রিপোর্ট ছাড়াই এসেছিলেন। এই ঘটনায় আমি অবাক ও লজ্জিত। তাদের কিছু তো কর্তব্য পালনের বোধবুদ্ধি রয়েছে। যে বিষয়গুলিতে আমি জানতে চাই, তা বিগত ১২ মাস ধরে আটকে পড়ে রয়েছে।"
কলকাতা: রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সাংবাদিক বৈঠকেও পার পেলেন না মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনায় রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুললেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীকে সাফ জানালেন, তিনিও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সাংবিধানিক কর্তব্য রয়েছে।
মুখ্যসচিব ও রাজ্যপুলিসের ডিজির সঙ্গে বৈঠকের পরই রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় জানিয়েছিলেন আজ রাজ্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা তুলে ধরতে সাংবাদিক বৈঠক করবেন। প্রতিশ্রুতি মতোই আজ বেলা ১২টায় রাজভবনে সাংবাদিক বৈঠকের শুরু হয়। প্রথমেই গতকাল বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার কনভয় হামলার নিন্দা করে রাজ্যপাল বলেন, “বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের লজ্জা। এসব আর মেনে নেওয়া চলবে না। উনি ক্ষমা চাইলে তাঁর সম্মান বাড়বে। আমাদের গণতন্ত্র মূল্যবান। যা ঘটেছে গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জার। ভারতীয়দেরই বহিরাগত বলছেন।”
মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,”মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দয়া করে আগুন নিয়ে খেলবেন না। যারা সংবিধানে বিশ্বাস করেন, তাদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব।”
ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে বরাবরই বিবাদ লেগে রয়েছে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে। আজ ফের একবার সেকথাই মনে করিয়ে তিনি বলেন,”কেন রাজ্যপালের সঙ্গে তথ্য ভাগ করছেন না? আমি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালন করছেন না।”
গতকাল তৃণমূলের তরফ থেকে ১০ বছরের কাজের খতিয়ান হিসাবে একটি রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করা হয়, সেই বিষয়কে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “২৫ অগস্ট ২০২০ আমি মুখ্যমন্ত্রীকে লিখেছি ১২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ কে করছে ? কোথায় হচ্ছে? মাটির উপরে না নীচে, আমায় জানান। সাধারণ কয়েকটা প্রশ্ন করেছি। ১২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ কোথায়? সমুদ্রে, পাহাড়ে কোথায়? ১০ বছরের উন্নতির চর্চা করছেন, অথচ আমার চিঠির জবাব দিচ্ছেন না। ৩ সেপ্টেম্বরও আমি মুখ্যমন্ত্রীকে লিখেছি। বুঝতেই পারিনা যত দুর্নীতির সম্পর্কে লিখি কিছুরই উত্তর আসে না। যাদের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, তাঁদের দিয়েই তদন্ত করাচ্ছেন। রিপোর্ট এলে মিডিয়াকে জানাব। কিন্তু রিপোর্ট আসবে বলে মনে হয় না।”
আরও পড়ুন: গরুপাচারকাণ্ড: মূল চক্রী এনামুলের আত্মসমর্পণ, সতীশের মুখোমুখি জেরার সম্ভাবনা
নাম না করেই রাজ্যপাল আরও জানান, সময় এলেই তাঁরা বুঝতে পারবে আইনের সুর সাধারণ মানুষের হাতে রয়েছে, যারা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করছে তাদের হাতে নয়। রাজ্যপুলিসের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “আপনার পুলিস এখন রাজনৈতিক পুলিসে পরিণত হয়েছে।”
গতকাল মুখ্যসচিব ও রাজ্য পুলিসের ডিজির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে রাজ্যপাল বলেন,”ওনারা কোনও রিপোর্ট ছাড়াই এসেছিলেন। এই ঘটনায় আমি অবাক ও লজ্জিত। তাদের কিছু তো কর্তব্য পালনের বোধবুদ্ধি রয়েছে। যে বিষয়গুলিতে আমি জানতে চাই, তা বিগত ১২ মাস ধরে আটকে পড়ে রয়েছে। সংবিধানের নিয়ম মেনে তারা কোনওভাবেই আমায় সাহায্য করতে পারেননি।”
গতকালের ঘটনা আরও একবার উল্লেখ করে রাজ্যপাল জানান, বিরোধীদলগুলিকে যেভাবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিরোধীরা প্রতিবাদের কোনও জায়গাই পাচ্ছে না। নৃশংসভাবে তাদের সমস্ত কার্যকলাপ দমন করা হচ্ছে। গতকাল একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতির উপর হামলার ঘটনা তা আরও একবার প্রমাণ করল। আমরা কি এমন পরিস্থিতিতে রয়েছি, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের আনুগত্য না থাকলে কোনও অধিকার থাকবে না। এটা কি গণতন্ত্রের মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয় না? এমন ঘটনা মেনে নেওয়া হবে না।
মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি অনুরোধ করে বলেন,”যদি রাজ্যপাল ভুল তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। যদি অন্য কেউ ভুল তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিন। কোথায় আছি আমরা, কত মিথ্যে বলবেন? কি করে আপনি বললেন সরকারি রিপোর্ট নয়। জেলা শাসক সরকারি নয়? এমন চলতে পারে না। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী সাংবিধানিক প্রধানকে কোনও উত্তর দেন না। কোথায় স্বচ্ছতা আমি দেখতে চাই। কেন আমার প্রশ্নের উত্তর আসে না, আমি আমার অখুশি প্রকাশ করিনি। আমি গণতন্ত্রের লঙ্ঘনে প্রতিক্রিয়া দিয়েছি। পুলিস রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে। এটা আমার কর্তব্য যা আমি পালন করছি। প্রজাতন্ত্রর সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সাধারণ জনগণ। প্রজাতন্ত্রর সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় যোদ্ধা সাধারণ জনগণ।”
রাজ্যপাল জানান, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তবে সেই রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করতে চান না, কারণ গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সংবাদমাধ্যমও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংবিধানের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ভারতীয় সংবিধান সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য তৈরি। ৭০ সাল ধরে যে সমস্যা চলছিল, তার কী হল। অনুচ্ছেদ ৩৭০ আর নেই। সমস্যা যেমন আছে, তেমনই সমাধান আছে। রাজ্যপাল পোস্ট অফিস নয়।”
তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না, এই অভিযোগ করেও রাজ্যপাল বলেন,”বুঝতে পারি না শিক্ষিত লোকরা কি রাজ্যপালকে উদ্দেশ্য করে যা ইচ্ছে বলতে পারে? ব্যাথা হয়। কেউ আমাকে আঙ্কেল বলে দেয়।”
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে সন্ত্রাসের ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন,” আমাদের এখানে হিংসা ছাড়া নির্বাচন হয় না। এটা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। ইতিহাস বদলান। রাজনীতির ভেতরে সংস্কৃতির আহুতি করবেন না। জলাঞ্জলি দেবেন না। বাংলার সংস্কৃতির আহুতি দেবেন না। ক্ষমা চাইলে সম্মান বাড়বে।”
আরও পড়ুন: উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের