Buladi: বাঙালির কানে আর পৌঁছয় না বুলাদির বুলি!

প্রায় দু’দশক আগে এই রূপেই আবির্ভাব হয়েছিল বুলাদির। লোকমুখে ছড়িয়েছিল তার নাম। তবে বুলাদি কোনও বাস্তবিক চরিত্র নন। ২০০৪ সালের ১লা ডিসেম্বর, বিশ্ব এইডস দিবসে পশ্চিমবঙ্গের এডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সোসাইটি (WBSPACS)-র উদ্যোগে 'বুলাদি'র ম্যাসকট আত্মপ্রকাশ করে। ঝুঁকিহীন যৌন আচরণ এবং এইডস প্রতিরোধ সম্পর্কে জন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছিল এই চরিত্র।

Buladi: বাঙালির কানে আর পৌঁছয় না বুলাদির বুলি!
বুলাদির প্রচার
Follow Us:
| Updated on: Aug 08, 2024 | 8:34 PM

দৃশ্য ১: রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে বসে গল্প করছেন স্বামী-স্ত্রী। স্বামীর আবদার সত্ত্বেও কন্ডোম না থাকায় মিলিত হতে চাইছেন না স্ত্রী। এর মধ্যেই এক কাধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে হাজির এক ‘দিদি’। দিলেন সচেতনতার বার্তা। তার পর নিরাশ স্বামী সময় কাটাতে স্ত্রীকে বললেন, “চলো তাহলে এক দান লুডোই খেলি।”

দৃশ্য ২: গীতা যাচ্ছে সীতার বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে। বারান্দায় চুল বাঁধতে বাঁধছেন অপর এক মাঝবয়সী মহিলা। গীতা সীতার বাড়ি যাচ্ছে শুনেই তিনি চমকে উঠলেন। সীতার এইচআইভি সংক্রমণের বিষয়ে গীতাকে জানালেন। কিন্তু গীতা সে সবের পরোয়া না করেই সীতার ডিমের ডেভিলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। এর পর ফের হাজির সেই ‘দিদি’।

এ রকমই কয়েকটি বিজ্ঞাপণ টিভি-র পর্দায় ভেসে উঠলেই অস্বস্তি বেড়ে যেত রক্ষণশীল বাঙালি সমাজের। যে বিষয় আড়াল করতে অভ্যস্ত, তা নিয়ে প্রকাশ্যে দেওয়া হচ্ছে বার্তা। সহজ ভাষায় কন্ডোম, সুরক্ষিত যৌনতা, এইচআইভি-এডসের মতো বিষয় নিয়ে বলছেন এক ভদ্রমহিলা। পরণে তাঁর সাদামাটা শাড়ি। চুল পরিপাটি করে বাঁধা। কপালে লাল টিপ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। মুখে অনবরত সচেতনতার বার্তা। মূলত যৌনরোগের থেকে সুরক্ষিত থাকার পরামর্শ দিতেন বাঙালি মাঝবয়সী ওই ভদ্রমহিলা।

প্রায় দু’দশক আগে এই রূপেই আবির্ভাব হয়েছিল বুলাদির। লোকমুখে ছড়িয়েছিল তার নাম। তবে বুলাদি কোনও বাস্তবিক চরিত্র নন। ২০০৪ সালের ১লা ডিসেম্বর, বিশ্ব এইডস দিবসে পশ্চিমবঙ্গের এডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সোসাইটি (WBSPACS)-র উদ্যোগে ‘বুলাদি’র ম্যাসকট আত্মপ্রকাশ করে। ঝুঁকিহীন যৌন আচরণ এবং এইডস প্রতিরোধ সম্পর্কে জন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছিল এই চরিত্র। এর পর চার-পাঁচ বছর, বুলাদির দেখা মিলেছিল টিভির পর্দায়, খবরের কাগজের পাতায়, শহরের বিলবোর্ডে। খোলাখুলি কথার মাধ্যমে যৌনতা বিষয়ক উপদেশ দিতেন। তিনি সরাসরি বলতেন, “ঝুঁকিহীন যৌনজীবনের জন্য কন্ডোমের কোনও বিকল্প নেই।” এইচআইভি এবং এডস নিয়ে সাধারণ মানুষেরপ মধ্যে যে জড়তা ভাব ছিল তা কাটানোর চেষ্টা চালাতেন। এই সংক্রান্ত যে কোনও তথ্য জানতে ১০৯৭ নম্বরে ফোন করার পরামর্শ দিতেন। এটি একটি টোল ফ্রি নম্বর। যে নম্বর এখনও চালু রয়েছে। কিন্ত বুলাদি এখন আর নেই। এক দশকেরও বেশি সময় আগেই বুলাদির প্রচারের ইতি হয়েছে।

বুলাদিকে নিয়ে সমাজের একাংশের নাক সিঁটকানি কম ছিল না। কিন্তু জন সাধারণের মনে যৌনরোগ এবং সুরক্ষিত যৌনতা সংক্রান্ত চেতনা গড়ে তুলতে বুলাদি যে সফল হয়েছিলেন তা উঠে এসেছে একাধিক সমীক্ষায়। এ রাজ্যের সিংহভাগ বাসিন্দা এডস বা এইচআইভি-র ব্যাপারে প্রথম জেনেছিলেন বুলাদির করা প্রচার থেকে। বছর দশেক আগের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, পশ্চিমবঙ্গের ৭৯ শতাংশ বাসিন্দা বুলাদির থেকেই প্রথম এডস সম্বন্ধে জেনেছেন। বুলাদির প্রচারের আগে এ রাজ্যের মাত্র ৯ শতাংশ বাসিন্দা এডস-কে গুরুতর সমস্যা বলে জানতেন। অধিকাংশের মনেই এই গুরুতর যৌনরোগ সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। বুলাদির প্রচার শুনে এডস সম্পর্কে মনোভাব বদলেছে বলে জানিয়েছেন ৮৩ শতাংশ। সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, বুলাদির প্রচার থেকে ৯০ শতাংশ লোক বুঝেছে কীভাবে এইচআইভি-র সংক্রমণ ঘটে। বুলাদির এই প্রচারকে খুবই কার্যকরী মনে করতেন দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা চিকিৎসক স্মরজিৎ জানা। বর্তমানে তিনি বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর হাতে তৈরি সংগঠন যৌনকর্মীদের উন্নয়নের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। দুর্বারের সঙ্গে যুক্ত রতন দলুই সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “আমাদের স্যারের সঙ্গে কথা হত এটা নিয়ে। বুলাদির এই প্রচারকে খুব কার্যকরী বলতেন স্যার। বিশেষ করে যাঁরা যৌনপল্লীর বাইরের লোকজন, তাঁদের জন্য এটা খুবই কাজ দিয়েছে।”

যদিও বুলাদির প্রচার যৌনপল্লীর বাইরেই বেশি কার্যকরী বলে মত রতনের। তিনি জানাচ্ছেন, যৌনপল্লীতে দুর্বারের মতো একাধিক সংগঠন সারাবছর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ চালায়। যৌনপল্লীতে এডসের প্রভাব কতটা তা দেখতে প্রায়শই সমীক্ষা হয়। এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। যৌনকর্মীদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার বাড়াতেও প্রচার চলে বছরের বিভিন্ন সময়। কিন্তু যৌনপল্লীর বাইরেও অনেকে যৌনব্যবসায় লিপ্ত থাকছেন। সাধারণ মানুষ যাঁরা যৌনপল্লীর বাইরে থাকেন বা যৌনপল্লীতে যাতায়াত করেন বা একাধিক যৌনসঙ্গীর সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন তাঁদের মধ্যে সচেতনতা প্রচারে বুলাদির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই প্রচারেই এখন ইতি হয়েছে। যা নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকেই। এ নিয়ে রতন বলছেন, “যৌনপল্লীর মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রোগ্রাম চালায় আমরা। এখানে যাঁরা থাকেন, তাঁদের উপর নজর রাখা সহজ। কিন্তু বাইরে অনেকে এ রকম কাজে যুক্ত। বিভিন্ন হোটেল, লজে অনেকে এই কাজে লিপ্ত। তাঁদের চিহ্নিত করা বেশি কঠিন। তাঁদের পরীক্ষা করে নজর রাখার জন্য কোনও উপায় নেই। এর পাশাপাশি সমকামী, ট্রান্সজেন্ডাররাও রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে এডস ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। বুলাদির প্রচার থাকলে এদের মধ্যে সচেতনতা প্রচার চালানো সহজ হত।”

বুলাদি যখন ছিলেন তখন সোশ্যাল মিডিয়া আসেনি। কিন্তু বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে তথ্য পৌঁছে দেওয়া যেমন সহজ হয়েছে, তেমনই বিভিন্ন প্রচার চালানোও সহজ হয়েছে। উন্নত মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে যদি এ সংক্রান্ত প্রচার আরও জোরদার করা যায়। তাহলে আগামী দিনে এডসের বিরুদ্ধে লড়াই অনেক সহজ হয়ে যাবে।