Mughal Food Recipe Part III: খানা খানদানি-পর্ব ১১, নদীর পাড়ে তলোয়ার দিয়ে মাছ কুটলেন শাহজাহান—বাপের হুকুমে!

হিন্দের বাদশাহের সব থেকে প্রিয় রাজকুমারকে সে দিন নিজের তলোয়ার দিয়েই মাছ কুটতে হয়েছিল—বাপের হুকুমে! এই না হলে বাদাশাহি হুকুম! 

Mughal Food Recipe Part III: খানা খানদানি-পর্ব ১১, নদীর পাড়ে তলোয়ার দিয়ে মাছ কুটলেন শাহজাহান—বাপের হুকুমে!
মোগলাই খানা মানেই কাঁড়ি-কাঁড়ি মাংস। কাবাব-কষা-কোফতা-কালিয়া সবেতেই গোশ্ত। বিলকুল ভুল। শাক-সবজি তো বটেই, মুঘলরা ছিলেন রীতিমতো মৎস্যপ্রেমিক।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 20, 2021 | 9:04 PM

নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ১১

রাজকুমার খুররম, যিনি কিনা কিছু বছর পরেই হবেন সরজ়মিন-এ-হিন্দের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, শাহ জাহান বাদশাহ, নিজের তলোয়ার দিয়ে, হয়তো বা উবু হয়ে বসে, গলদঘর্ম হয়ে, অতিকায় এক মাছ কুটছেন—আঁশ ছাড়িয়ে পিস্ পিস্ করছেন। বাক্যটা পড়া ইস্তক দৃশ্যটা কল্পনা করে মনে-মনে হাসি থামাতে পারছি না। ভাবছেন এ আবার কি আহাম্মুকে কল্পনা? কল্পনা নয়। বর্ণে-বর্ণে সত্যি। হিন্দের বাদশাহের সব থেকে প্রিয় রাজকুমারকে সে দিন নিজের তলোয়ার দিয়েই মাছ কুটতে হয়েছিল—বাপের হুকুমে! তিনি একাই নন, কোমরবন্ধ্ থেকে নিজ-নিজ তলোয়ার, ছোরা খুলে নিয়ে এ কাজে নেমে পড়তে হয়েছিল সে দিন বাদশাহের এন্টুরাজে তাঁর অন্দরমহলের খাস সঙ্গী প্রত্যেক ডাকসাইটে আমিরকে। এই না হলে বাদাশাহি হুকুম!

Mughal Food Fish Kalia

সে দিন? ৯ এপ্রিল, ১৬১৮। দুরন্ত সে বর্ণনা জাহাঙ্গির বাদশাহ স্বয়ং লিখে গিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথা জাহাঙ্গিরনামায়।

গুজরাটের সেহরা পরগনার একরত্তি জনপদ বাদারওয়ালার বাইরে সে দিন সে কী সাজসাজ রব। তুমুল হট্টগোল। মানুষের চিৎকার। থেকে-থেকে হাতি, ঘোড়া, উট, খচ্চরের ডাক, গরুর হাম্বা। মানুষ আর পশুর পায়ের চাপে কাঁচা রাস্তা থেকে ওঠা ধুলোর মেঘ উড়িয়ে সবার আগে চলেছে বলদ গাড়িতে বসানো বিভিন্ন মাপের কামান। রঙিন ঝালর লাগানো উটের সারি। কম সে কম শ’তিনেক উট, পিঠে বোঝাই মালপত্তর। হরেক কিসিমের ঠেলাগাড়ি আর টানা-গাড়ির লম্বা লাইন—দু’চাকা, তিন চাকা, চার চাকা—শেষ দেখা যায় না। সে সবের ওপর ডাঁই করা কাঠের গুঁড়ি থেকে আরম্ভ করে যত রকমের আসবাবপত্তর কল্পনা করা যায়, মালাক্কা মখমলের বস্তায় বাসনকোষন, জাজিম, বিরাট-বিরাট বস্তা। শতশত তাঁবুর ভাঁজ করা তিরপল, সেগুলো খাঁচানোর সরঞ্জাম। খান কুড়ি টানাগাড়ি বোঝাই শুধু দলিল-দস্তাবেজ। সঙ্গে শতশত লোক-লস্কর। এর পরে সার-সার উটে-টানা ঢাকা-দেওয়া গাড়ি, পাল্কি, ডোলিতে চেপে মহিলার দল। ফের এক দফা ঘোড়া আর হাতির সারি, তাতে সওয়ার বিচিত্র পোশাক পরা সিপাহি সালার। সে দলের মাঝখান থেকে উড়ছে রঙিন ঝলমলে চারকোণা, তিনকোণা অসংখ্য পতাকা, বড়-বড় ডাণ্ডার মাথায়, এই দফায় চলেছেন গণ্যমান্য আমির-ওমরা। আরও এক দফা ঘোড়সওয়ারের সারি, এবারে যেন কাতারে-কাতারে। ঘোড়ার সারির পিছনে, সব শেষে, শতশত ভৃত্যের দল, যাদের সঙ্গে খান পঞ্চাশেক তাগড়াই দুধেল গাই—কারণ বাদশাহের চাই তাজা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। আর এই হাজার-হাজার ঘোড়সওয়ারের বিন্যাসের ঠিক মাঝখানে চলমান পাহাড়ের মতো খান কুড়ি হাতি—একেবারে ঐরাবৎ। অধিকাংশই মখমলের ওপর সোনার জরির কাজ করা কাপড়ে ঢাকা, পিঠে মহার্ঘ্য আসবাব। এই জায়গাটা থেকেই ধুলোর মেঘ ভেদ করে অনেক ওপরে শীতের ঝকঝকে নীল আকাশে উড়ছে শতশত বাদশাহি অলম—দূর্ব্বাঘাস-সবুজ রেশমের জমিনে আঁকা ঝলমলে সোনালি ডান-থাবা-তোলা সিংহ, তার কেশরের পিছন থেকে শানিত রশ্মিচ্ছটা ছড়িয়ে উদয় হচ্ছে সূর্য—শের ও খুরশিদ পতাকা।

জাহাঙ্গিরি অলম-এর নাটকীয় পুনর্নিমাণের ভিডিও

আহমেদাবাদের পথে রওনা হয়ে এখানেই আজ শিবির ফেলার বাসনা করেছেন আলম পনাহ্ অস্-সুলতান-উল-আজ়ম জন্নত মকানি নুর-উদ্দিন মহম্মদ সালিম জাহাঙ্গির।

বাদশাকে ঘিরে রয়েছে যে বিন্যাস, নিমেষে তার মধ্যে দেখা গেল তড়িৎ-গতি তৎপরতা। এই বিন্যাসেই আছে খান দশেক খচ্চর, যাদের পিঠে রঙিন ছোট-ছোট তাঁবুর সরঞ্জাম, দু’টো খচ্চরের পিঠে বাদশাহি পোশাক, একটা খচ্চরের পিঠে হরেক কিসিমের আতর আবার আর একটার পিঠে বোঝাই তাজা সুগন্ধী ফুল—ক্লান্ত বাদশা পথিমধ্যে কোথাও একটু জিরিয়ে নিতে চাইলে বা ঘেমে গিয়ে পোশাক বদল করতে চাইলে ঝপাঝপ খাটিয়ে দেওয়া যাবে এই সব ছোট তাঁবু, সাজিয়ে দেওয়া যাবে ফুলে, ছড়িয়ে দেওয়া যাবে আতর। কান-ও-কান খবর হয়ে গেছে এইখানে থামতে চান বাদশা। (আমার এই বর্ণনা হুইলার এম থ্যাকস্টোন অনূদিত ‘জাহাঙ্গিরনামা’র মুখবন্ধে উদ্ধৃত পিটার মান্ডি-র ১৬৩২ সালের ১ জুন বুরহানপুর শহরের ঠিক বাইরে দেখা শাহজাহান বাদশাহের কারোয়াঁ-র বর্ণনা এবং নিকোলাও মানুচ্চির দেওয়া অওরঙ্গজ়েব বাদশার কারোয়াঁ-র বর্ণনার অনুসারী।)

বাদারওয়ালার কাছে এসে ধাক্কাধাক্কি করে থেমে যাচ্ছে মহাকারোয়াঁ। দূর-দূরান্তের নানা জনপদ থেকে হামলে পড়ে সে দৃশ্য বিস্ফারিত চোখে শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে স্থানীয় মানুষ—আদুড় গায়ে শিশুর দল, ইয়া পাগড়ি আর মলিন আটহাতি ধুতি পরা চাষাভুষোর দল, বলদ গাড়ির পর বলদ গাড়ির ঠেলাঠেলি লাগিয়ে আশপাশের শহরের লালাজিদের দল—সঙ্গে হরেক কিসিমের উপঢৌকন, যদি কয়েক মুহূর্তের বাদশাহি সকাশে তাঁর পায়ের কাছে সে সব রেখে নিজের নামটা তাঁর কানে ধরিয়ে দেওয়া যায়! উপহার পছন্দ হলে, হাত ঝেড়ে পাল্টা নজ়রানায় যা দেবেন বাদশাহ তাতে নাতির পুতির ভবিষ্যৎ মজবুত হয়ে যাবে। সেই ভিড়কে বাদশাহি কারোয়াঁ থেকে দূরে রাখতে সাংঘাতিক হুঙ্কার পেড়ে চাবুক হাঁকড়াচ্ছে সন্ত্রির দল।

শিবির পড়ল। ৫ এপ্রিল। আহা… বসন্ত কাল। নিজের কলমে লিখছেন জাহাঙ্গির, ‘‘এইখানে শোনা গেল কোকিলের ডাক। কোকিল পাখিটা অনেকটা কাকের মতো, তবে ছোট। কাকের চোখ কালো, কোকিলের লাল। মাদীর গায়ে সাদা বুটিবুটি, মদ্দা ঘোর কালো। মদ্দার গলা বড়ো সুরেলা, মাদীর থেকে এক্কেবারে আলাদা। কোকিল সত্যিই হিন্দের বুলবুল…।’’

Recipe Mughal Food

শিবির পড়েছে মাহি নদীর মনোরম কিনারে। ‘‘আমরা থামলাম মাহি নদীর পাড়ে। আর বিষ্যুদবারের মৌজমস্তি হল হারেমে। নদীর পাড়ে দুটো পুকুর রয়েছে, তাদের জল এমন টলটলে যে তাতে একটা পোস্ত দানা ফেলে দিলেও তা পরিষ্কার দেখা যাবে। গোটা দিনটা কাটল হারেমের জেনানাদের সংসর্গে। জায়গাটা এতই মনোরম যে আমি দু’টো পুকুরের পাড়েই মাচা তৈয়ার করার হুকুম দিলাম।’’

এর পরেই সেই বিচিত্র দৃশ্যের দিন। ‘‘শুক্রবার, ৯ এপ্রিল আমরা মাহি নদীতে মাছ ধরতে বেরলাম। জালে বেশ কয়েকটা আঁশওয়ালা বড়-বড় মাছ পড়ল। পুত্র শাহজাহানকে হুকুম করলাম সেগুলোর ওপর তার তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করে দেখতে। তারপরে আমিরদেরও হুকুম করলাম কোমরবন্ধের ফলাগুলো বার করে চালাতে। আমার পুত্রের তোলায়ারই সব থেকে ভাল মাছ কুটলো। উপস্থিত সকলের মধ্যে সে সব মাছ ভাগাভাগি করে দেওয়া হল।’’

এবারে আসা যাক আজকের রেসিপিতে, একেবারে শাহজাহানের খাস হেঁশেল থেকে নেওয়া:

মূল রেসিপি: কালিয়েহ্ মাহি রহু (রুই মাছের কালিয়া) 

রুই মাছ—১ শের (৮৩৬ গ্রাম)

ঘি—১ পোয়া (২০৮ গ্রাম)

ছোলার ছাতু—১ পোয়া (২০৮ গ্রাম)

দুরুচিনি—২ মাশা (২ গ্রাম)

লবঙ্গ—২ মাশা (২ গ্রাম)

ছোট এলাচ—২ মাশা (২ গ্রাম)

গোল মরিচ—১ টাঙ্ক (৪.৪ গ্রাম)

ধনে—২ দাম (৪১.৮৭ গ্রাম)

পেঁয়াজ—১/২ পোয়া (১০৪ গ্রাম)

আদা—১ দাম (২০.৯ গ্রাম)

জ়াফরান—১ মাশা (১ গ্রাম)

টক দই—১/২ পোয়া (১০৪ গ্রাম)

কিশমিশ—১/২ পোয়া (১০৪ গ্রাম)

কাঠ বাদাম—১/২ পোয়া (১০৪ গ্রাম)

নুন—১/২ দাম (১০.৪৫ গ্রাম)

(ওজন শাহ-জাহানি শের-এর হিসেব মতো দেওয়া হল)

প্রথমে মাছ পরিষ্কার করে নিন। ‘গুল/গিল লপত’-এ করে দিন। ‘গুল/গিল লপত’ লাল হয়ে গেলে মাছ আলাদা করে দিন। মাছ থেকে কাঁটা বেছে বার করে দিন। ছোলার ছাতু ও মাছটাকে সব মশলা দিয়ে মেখে ফেলুন। এবার একটা কাঠের হাতা দিয়ে খুব ভাল করে পিটিয়ে নিন। ডেগচিতে অল্প জল, তাতে অল্প টক গুল্ম দিয়ে মাছ ভিজিয়ে নিন। ভেজা মাছ ছোট-ছোট মাছের আকারে গড়ে নিন। আগুনে দিন। মাছ শক্ত মত হয়ে এলে, গোল মরিচ আর ঘিতে সাঁতলে নিন। ভেজা কিশমিশ বাটা দিন। যখন মাছ মোটামুটি তৈরি হয়ে যাবে, বাদাম বাটা এবং চাল (?) এবং দই ও মশলা ও জ়াফরান দিন। যদি চাশনিদার করতে চান, তাহলে মিষ্টি ফলের চাশনি মেশান ও একবার ফুটিয়ে নিন। এটা করতে হলে সব মশলার সঙ্গে চিনি এক পোয়া ও লেবু এক পোয়া দিতে হবে।

—(নুসখা-ই-শাহ-জাহানি। পৃ ২৩। নং ২১)

এ অবধি পড়ে এমনটা মনে করা অস্বাভাবিক নয় যে, আরে মশাই রুই মাছের কালিয়া রেঁধেছেন, বেশ করেছেন। তাতে এত কিস্সা কাহিনির কী আছে? এই আছে যে, যে-কেতাব থেকে এই রেসিপি নেওয়া, সেই ‘নুসখা-ই-শাহজাহানি’ এবং ‘জাহাঙ্গিরনামা’ নামক দুরন্ত কেতাবটি আমার মন থেকে একটা ধারণা চিরকালের মত ঘুচিয়ে দিয়েছে— মোগলাই খানা মানেই কাঁড়ি-কাঁড়ি মাংস। কাবাব-কষা-কোফতা-কালিয়া সবেতেই গোশ্ত। বিলকুল ভুল। শাক-সবজি তো বটেই, মুঘলরা ছিলেন রীতিমতো মৎস্যপ্রেমিক।

Mughal Food

মজার কথা হল, মুঘলদের এই মেছোপনা আমার হিসেবে বাবর-বাদশা থেকেই শুরু আর তা একেবারে মাতামাতির পর্যায়ে পৌঁছয় জাহাঙ্গির বাদশার আমলে। কেন বলছি সে কথা, সেটা জানতে হলে সবুর করতে হবে কাল অবধি।

আরও পড়ুন- Mughal Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০৯, এক গরস বিরিয়ানি মুখে দিয়েই যুদ্ধে ছুটলেন জাহাঙ্গির

আরও পড়ুন- Mughal Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ১০, বুড়ো বাপ ঔরঙ্গজ়েবকে ছেলে দেয়নি নিজের বিরিয়ানি-বাওর্চি

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার

গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস